বুধবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

মীর কাসেমের ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’ ডালিম হোটেল

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে ১২টিই মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে ডালিম হোটেলের টর্চার সেলে নির্যাতন ও হত্যার। পক্ষান্তরে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ৩৫১ পৃষ্ঠার যে রায় ঘোষণা করেছিল তাতে ৮৫০ বার ডালিম হোটেলের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল পর্যবেক্ষণে বলেছে, একাত্তরে চট্টগ্রামে আলবদর বাহিনীর সদর দফতর ডালিম হোটেল রূপ নিয়েছিল ডেথ ফ্যাক্টরিতে। ভয়ানক এই মৃত্যু কারখানার নির্যাতনের কথা মনে পড়লে এখনো আঁতকে ওঠেন নির্যাতিতরা। এই হোটেলে আলবদর বাহিনীর পৈশাচিক নির্যাতনের নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় ছিলেন আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান, একাত্তরে ইসলামী ছাত্রসংঘ চট্টগ্রামের সভাপতি মীর কাসেম আলী। তিনি খোলা জিপ ও অস্ত্র নিয়ে সারা চট্টগ্রাম শহর দাপিয়ে বেড়াতেন সহযোগীদের নিয়ে। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে মীর কাসেম আলী ও বদর সদস্যরা ডালিম হোটেল ছেড়ে পালিয়ে যান। ওইদিনই মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় জনগণ ডালিম হোটেল থেকে বন্দীদের উদ্ধার করেন। জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরের নন্দনকানন এলাকার ডালিম হোটেলের পূর্ব নাম ছিল ‘মহামায়া ডালিম ভবন’। এর মালিক ছিল একটি হিন্দু পরিবার। পাকিস্তানি সেনারা গণহত্যা শুরু করলে ওই পরিবার পালিয়ে যায়। হানাদার বাহিনী ভবনটি দখল করে বানায় ডেথ স্কোয়াড। আলবদর বাহিনী তা ব্যবহার করে বন্দীশিবির হিসেবে। চট্টগ্রাম শহরের কোথাও মুক্তিযোদ্ধারা লুকিয়ে থাকার খবর পেলেই মীর কাসেম ও তার সহযোগীরা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে অভিযান চালাতেন। ধরে নিয়ে আসতেন ডালিম হোটেলে। মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে আরও তিনটি জায়গায় ‘টর্চার সেল’ বানানো হয়। এর মধ্যে ছিল নগরের চাক্তাই এলাকায় দোস্ত মোহাম্মদ ভবন, দেওয়ানহাটের দেওয়ান হোটেল ও পাঁচলাইশ এলাকার সালমা মঞ্জিল। তবে নির্যাতন, ভয়াবহতা ও অমানবিকতায় সব মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল ডালিম হোটেলের টর্চার সেল। ১৯৭১ সালের ২৩ নভেম্বর। নগরের কদমতলী এলাকায় কারফিউ দিয়ে আটক করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয় মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর চৌধুরীকে। ৩০ নভেম্বর ভোরে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় চান্দগাঁও এলাকার মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মো. এমরানকে। একই দিন মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী বদর বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। পাশবিক নির্যাতনে পুরুষত্ব হারান মুক্তিযোদ্ধা লুত্ফুর রহমান ফারুক। মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, নির্যাতন ছিল অমানবিক, পৈশাচিক, রোমহর্ষক। প্রতিদিনই তিন তলা ভবনের বিভিন্ন কক্ষ থেকে বন্দীদের আর্তনাদের শব্দ বেদনাহত করত আমাদের। মীর কাসেমের নির্দেশেই অকথ্য সব নির্যাতন করা হতো। মুক্তিযোদ্ধা লুত্ফুর রহমান ফারুক বলেন, ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতনের কারণে আমি পুরুষত্ব হারাই। ফলে জীবনে বাবা হতে পারিনি। নির্যাতনের শিকার জাহাঙ্গীর চৌধুরী বলেন, এ হোটেলেই মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন করে হাত-পা ভেঙে দেওয়া হতো, রক্তাক্ত করা হতো বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে।ীর কাসেমের উপস্থিতিতেই বদর বাহিনীর সদস্যরা চোখ-মুখ-হাত-পা বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে পেটাতেন। লোহার চেয়ারে বসিয়ে ইলেকট্রিক শক দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ও তাদের অস্ত্রের বিষয়ে জানতে চাইতেন।

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনের মামাতো বোন, মামলার অন্যতম সাক্ষী হাসিনা খাতুন বলেন, ৪৫ বছর পর এ রায়টি পেয়ে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। এখন আমাদের একটাই দাবি— রায় দ্রুত কার্যকর হোক। তবেই আমার ভাইয়ের আত্মা শান্তি পাবে। তিনি বলেন, জসিমকে অকথ্য নির্যাতন করে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

একাত্তরের ৩০ নভেম্বর চান্দগাঁও এলাকার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম শহরের বিএলএফের কমান্ডার সৈয়দ মোহাম্মদ এমরান ও তার পরিবারের পাঁচ সদস্যকে। এমরান বলেন, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড মীর কাসেমের নির্দেশেই হতো। তিনি নিজেই আমার নাম-ঠিকানা এন্ট্রি করেছিলেন। তার নির্দেশেই চোখ বাঁধা অবস্থায় বন্দীদের দিগম্বর করে পেটানো হতো। রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হতো অন্ধকার কক্ষে। খাওয়ানো হতো বাসি খাবার। পানি চাইলে দেওয়া হতো টয়লেট থেকে বদনায় করে। অনেককে পানির বদলে খেতে দিতেন প্রস্রাব।

মামলার সাক্ষী মৃদুল দে বলেন, হাজারি লেনের বাসিন্দা টুনটু সেন ও রঞ্জিত দাশকে অপহরণের পর নির্যাতন করে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন মীর কাসেম। তখন যে তাণ্ডব-অত্যাচার চালিয়েছেন আমি নিজের চোখে দেখেছি। তিনি একাত্তরে যে অপরাধ করেছেন তাতে কেবল একবার নয়, ১৪ বার ফাঁসি হওয়া উচিত। রিভিউ আবেদনের রায়ে ফাঁসি বহাল রাখায় আমি খুবই সন্তুষ্ট। তার সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে। অবিলম্বে তা কার্যকরের দাবি জানাচ্ছি।

সর্বশেষ খবর