মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঊনসত্তরের আগুন ঝরা দিনগুলো

তোফায়েল আহমেদ

ঊনসত্তরের আগুন ঝরা দিনগুলো

প্রতি বছর বাঙালি জাতির জীবনে যখন জানুয়ারি মাস ফিরে আসে তখন ১৯৬৯-এর অগ্নিঝরা দিনগুলো আমার স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে। প্রত্যেক মানুষের জীবনে উজ্জ্বলতম দিন আছে। আমি দুর্লভ সৌভাগ্যের অধিকারী। আমার জীবনেও কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা আছে। ’৬৯ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কালপর্ব। এই কালপর্বে আইয়ুবের লৌহশাসনের ভিত কাঁপিয়ে বাংলার ছাত্রসমাজ ’৬৯-এর ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। জীবনের সেই সোনালি দিনগুলোর প্রতিটি মুহূর্তের কথা মনে পড়ে। অনেক সময় ভাবী, কী করে এটা সম্ভবপর হয়েছিল।

আমার জন্ম ঢাকা নগরী থেকে বহুদূরের দ্বীপজেলা ভোলার প্রত্যন্ত পল্লীতে— একেবারে তৃণমূলে। পাড়াগাঁয়ে লেখাপড়া করেছি। হেঁটে ৫ মাইল দূরের স্কুলে যেতাম। বহু কষ্ট করে পড়াশোনা করতে হতো। তখনকার গ্রাম ছিল অনুন্নত, অন্ধকারে নিমজ্জিত। সেই অনুন্নত গ্রামে প্রথমে প্রাইমারি স্কুল, জুনিয়র হাইস্কুল, বোরহানউদ্দিন স্কুল, এরপর ভোলা গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে ’৬০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। মায়ের কথা মনে হওয়ার কারণে ঢাকা কলেজ ত্যাগ করে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হলাম। ব্রজমোহন কলেজে ভর্তির পর ছাত্রলীগের সদস্য হয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করি। ইচ্ছা ছিল জীবনে ডাক্তার হব এবং সে ব্যাপারেই মন প্রস্তুত ছিল। কিন্তু রাজনীতিতে জড়িয়ে গেলাম। বিএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়ে প্রথমে ইকবাল হলের (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ক্রীড়া সম্পাদক পদে নির্বাচিত হই। ’৬৫-৬৬ সালে মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের সহসভাপতি। ’৬৬-৬৭-তে ইকবাল হল ছাত্র সংসদের সহসভাপতি। ’৬৭-৬৮-তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদ তথা ডাকসুর সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ছাত্র আন্দোলন তথা জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সূতিকাগার। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ’৬০-এর দশকের গুরুত্ব অনন্য। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যখন ৬ দফা দিলেন আমি তখন ইকবাল হলের সহসভাপতি। ইকবাল হলের সহসভাপতির কক্ষ ছিল ৩১৩ নম্বর। আমার এই কক্ষে প্রতিনিয়ত অবস্থান করতেন শ্রদ্ধেয় শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক। আমার কক্ষে বসেই আমরা ১১ দফার ভিত্তিতে গণআন্দোলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করি। ৬ দফা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু দেশব্যাপী ঝটিকা সফর করে ৩২টি জনসভা করেন এবং বিভিন্ন জেলায় বার বার গ্রেফতার হন। শেষবার নারায়ণগঞ্জ থেকে সভা করে ঢাকা আসার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। এর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের ডাকে ৭ জুন দেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতালে ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ৬ দফা দিয়ে বঙ্গবন্ধু আমাদের বলেছিলেন, ‘সাঁকো দিলাম স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।’ অর্থাৎ এই ৬ দফার সিঁড়ি বেয়ে তিনি স্বাধীনতায় পৌঁছবেন। বিচক্ষণ নেতা ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। কাছে থেকে দেখেছি অপরিসীম দৃঢ়তা ছিল তার চিন্তা-চেতনার মধ্যে। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে তিনি রাজনীতি করেছেন। স্বাধীনতার লক্ষ্য সামনে নিয়েই ’৪৮-এ ছাত্রলীগ, ’৪৯-এ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং মহান ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার বীজ বপন করে ৬ দফায় তা প্রতিফলিত করেন। ৬ দফা দেওয়ার পর আইয়ুব-মোনায়েমের নির্দেশে দেশের বিভিন্ন জেলায় বঙ্গবন্ধুর নামে ১০টি মামলা দায়ের করা হয়। প্রতিটি মামলায় জামিন পেলেও দেশরক্ষা আইনে তাকে কারাবন্দী করা হয়। ’৬৮-এর ১৭ জানুয়ারি জেল থেকে মুক্তি পেলেও পুনরায় জেলগেট থেকেই গ্রেফতার করে আগরতলা মামলার ১ নম্বর আসামি হিসেবে অজানা স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথমে আমরা জানতাম না প্রিয় নেতা কোথায় কীভাবে আছেন। আমরা ছাত্রসমাজ এই গ্রেফতারের বিরুদ্ধে মিছিল করি। জগন্নাথ কলেজ থেকে প্রথম প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা প্রতিবাদ মিছিল বের করি। ’৬৮-এর ১৯ জুন আগরতলা মামলার বিচার যখন শুরু হয়, সেদিন থেকেই আমরা জানতাম আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিকাষ্ঠে মৃত্যুদণ্ড দেবেন। কারণ, স্বৈরশাসক আইয়ুব খান পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, সবাইকে বশে আনা যায় কিন্তু শেখ মুজিবকে যায় না। তাই আইয়ুব খান সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এই একটি কণ্ঠ চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দিতে হবে। কেননা একটি কণ্ঠে কোটি কোটি কণ্ঠ উচ্চারিত হয়। এ কণ্ঠটি যদি স্তব্ধ করা যায় তবে বাঙালির কণ্ঠই স্তব্ধ হয়ে যাবে এবং বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ে আর কোনো কণ্ঠ সরব হবে না। আর তাই আইয়ুব খান প্রদত্ত মামলার নামই ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যদের মামলা।’ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি এমন ছিল যে, রাজনীতিক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবীসহ অনেকেই আপসের পথে গিয়েছেন। কিন্তু এই একজন মানুষ বঙ্গবন্ধু, যিনি জীবনের মূল্যবান বছরগুলো কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন, তবু নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও বাঙালির অধিকার আদায়ে কখনো আপস করেননি।

ডাকসুসহ চারটি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে ঐতিহাসিক ১১ দফার ভিত্তিতে ’৬৯-এর ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। আজ যখন স্মৃতিকথা লিখতে বসেছি তখন বার বার মনে পড়ছে ’৬৯-এর ১১ দফা আন্দোলনের প্রণেতা, ছাত্রলীগ সভাপতি প্রয়াত আবদুর রউফ ও সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী; ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) সভাপতি প্রয়াত সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক ও সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দোহা; ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ এবং এনএসএফ একাংশের সভাপতি প্রয়াত ইব্রাহিম খলিল ও সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম মুন্সীর কথা। এই ছাত্রনেতাদের প্রত্যেকেই ছিলেন খ্যাতিমান। আর আমি ডাকসুর ভিপি হিসেবে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক ও মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করি। আমার সঙ্গে ছিলেন ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক নাজিম কামরান চৌধুরী।

’৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি বায়তুল মোকাররমে ‘ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি’ সংক্ষেপে ‘ডাক’-এর, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ১১ দফা প্রণয়নের পর এটাই আমাদের প্রথম প্রত্যক্ষ কর্মসূচি। এর আগে আমরা ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছি। ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠকের পর বৈঠক। আন্দোলনের কৌশলগত দিক নিয়ে আলোচনা, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ইত্যাদি। ১৭ জানুয়ারি বটতলায় আমরা সমবেত হলাম। মাত্র শপাঁচেক ছাত্র জমায়েত হয়েছিল। যদিও কলা ভবনের বারান্দা এবং অন্যান্য স্থানে দূর থেকে দাঁড়িয়ে বিপুলসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী আমাদের কার্যক্রম অবলোকন করছিল। হয়তোবা আমাদের সংগ্রামের সফলতা নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। তারা উপলব্ধি করতে পারছিল না যে, আজকের এই পাঁচ শ আগামীতে রাজপথে পাঁচ হাজার থেকে পাঁচ লাখে পরিণত হবে অথবা তারও বেশি। আমার সভাপতিত্বে সভা শুরু হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে গভর্নর মোনায়েম খান ১৪৪ ধারা জারি করেছেন। সভাপতি হিসেবে আমার দায়িত্ব ছিল সিদ্ধান্ত দেওয়ার যে, আমরা ১৪৪ ধারা ভাঙব কি ভাঙব না। জানি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস এমনকি গুলিও চলতে পারে; গ্রেফতার তো আছেই। জমায়েতে উপস্থিত ছাত্রদের চোখেমুখে ছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দৃঢ়তা। যারা বক্তৃতা করেছিলেন প্রায় সবাই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত ১৪৪ ধারা ভঙ্গের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে শপাঁচেক ছাত্র নিয়েই রাজপথে এলাম। মুহূর্তের মধ্যে পুলিশবাহিনী ক্ষিপ্রগতিতে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বেপরোয়া লাঠিচার্জ শুরু করে। আমরাও যত দূর সম্ভব প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করি। শুরু হয় কাঁদুনে গ্যাস আর ফায়ারিং। ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুর রউফ ঘটনাস্থলেই আহত হন। আমরা ক্যাম্পাসে ফিরে এলাম। আবার জমায়েত হয়ে পরদিনই অর্থাৎ ১৮ জানুয়ারি পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও শনিবার ঢাকা শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ধর্মঘটের কর্মসূচি দিলাম।

’৬৯-এর ১৮ জানুয়ারি বটতলায় জমায়েত। যথারীতি আমি সভাপতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট ছিল বিধায় সকালে বটতলায় ছাত্রজমায়েতের পর খণ্ড খণ্ড মিছিল এবং সহস্র কণ্ঠের উচ্চারণ— ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, আইয়ুব খানের পতন চাই।’ অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম গতকালের চেয়ে আজকের সমাবেশ বড়। সেদিনও বাইরে ১৪৪ ধারা। যথারীতি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজপথে নেমে এলাম। সেদিনও দাঙ্গা পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ আর টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করল। এভাবেই চলল খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ। ফিরে এলাম ক্যাম্পাসে। আবার জমায়েত। এবার মনে হলো ক্রমেই ভয় ভাঙছে এবং আমরা আরও বেশি সাহসী হয়ে উঠছি। পরদিন ছিল রবিবার। সে সময় রবিবার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকত। কিন্তু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় খোলা ছিল। কর্মসূচি নেওয়া হলো ১৯ জানুয়ারি আমরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল শুরু করব এবং ১৪৪ ধারা ভাঙব। রবিবার আমরা ওখান থেকেই মিছিল শুরু করলাম। শুরু হলো লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস। কিন্তু কিছুই মানছে না ছাত্ররা। আজ আর মানতে চাইছে না কিছুই। শঙ্কাহীন প্রতিটি ছাত্রের মুখ। গত দুই দিনের চেয়ে মিছিল আরও বড়। পুলিশ শেষ পর্যন্ত গুলি চালাল। একজন ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ল রাজপথে। ছাত্রলীগের এই কর্মীর নাম আসাদুল হক। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাড়ি দিনাজপুর। ’৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধে তিনি শহীদ হন। পুলিশের বর্বরতা ও গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে আমরা তত্ক্ষণাৎ ২০ জানুয়ারি সোমবার আবার বটতলায় সমাবেশের কর্মসূচি দিলাম।

২০ জানুয়ারি ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের মাইলফলক। এদিন ১১ দফার দাবিতে ঢাকাসহ প্রদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। সভাপতির আসন থেকে বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার পরিসর সমাবেশের তুলনায় ছোট মনে হচ্ছে। প্রথম দিন শুরু করেছিলাম শপাঁচেক নিয়ে আর আজ কয়েক হাজার, যেন জনসমুদ্র। তিন দিনে আমরা সাধারণ ছাত্র ও বিপুলসংখ্যক জনসাধারণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছি। আরও লক্ষ্য করলাম বটতলায় শুধু ছাত্র নয়, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ এসেও ভিড় করেছে। তারা সংগ্রামের কর্মসূচি চায়। আসাদুল হকের রক্তের প্রতিশোধ চায়। আমরা ভাবতেও পারিনি এত বেশিসংখ্যক ছাত্র এবং সাধারণ মানুষ আমাদের সমর্থন করবে। আমি যখন সভাপতির ভাষণ দিচ্ছি তখনো দলে দলে মানুষ আসছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা প্রাঙ্গণে। গুঞ্জন শোনা গেল আরও আসছে। মিল-কারখানা, অফিস-আদালত থেকে দলে দলে মানুষ আসছে। সভাপতির ভাষণে আমি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঘোষণা দিলাম। সেদিন বলেছিলাম, ‘যত দিন আগরতলা মামলার ষাড়যন্ত্রিক কার্যকলাপ ধ্বংস করে শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দীকে মুক্ত করতে না পারব, তত দিন আন্দোলন চলবে। স্বৈরশাসক আইয়ুব-মোনায়েম শাহির পতন না ঘটিয়ে বাংলার ছাত্রসমাজ ঘরে ফিরবে না।’ মুহূর্তে ফুঁসে উঠল মিছিল! কোথায় গেল ১৪৪ ধারা! লাখো মানুষের মিছিলের ঢল নেমে এলো রাজপথে। মিছিলের এক প্রান্ত চলে গেল কত দূর আগে কে জানে! আমরা ছিলাম মিছিলের মাঝখানে। মিছিল যখন আগের কলা ভবন বর্তমান মেডিকেল কলেজের সামনে ঠিক তখনই গুলি শুরু হলো। আমি, ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী ও আসাদুজ্জামান আমরা তিনজন একসঙ্গে ছিলাম। আমাদের লক্ষ্য করেই একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর গুলি ছোড়েন। গুলি লাগে আসাদুজ্জামানের বুকে। সঙ্গে সঙ্গে ঢলে পড়ে আসাদ। আমি আর খালেদ আসাদকে ধরাধরি করে মেডিকেল কলেজের দিকে নেওয়ার পথে আমাদের হাতের ওপরই সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। একজন শহীদের শেষ নিঃশ্বাসটি আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। মৃত্যু এত কাছে হাতের ওপর! আমার পুরো শরীর যেন আগ্নেয়গিরির লাভায় পরিণত! মেডিকেলের সিঁড়িতে আসাদের লাশ রাখা হলো। তার গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত শার্টটি সংগ্রামের পতাকা করে আকাশে উড়িয়ে দিয়ে আসাদের রক্ত ছুঁয়ে শপথ গ্রহণ করে সমস্বরে বলি, ‘আসাদ তুমি চলে গেছো। তুমি আর ফিরে আসবে না আমাদের কাছে। তোমার রক্ত ছুঁয়ে শপথ করছি, আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না।’ এরপর সবাই ছুটে গেলাম শহীদ মিনার চত্বরে। শহীদ আসাদের মৃত্যুর খবর ঘোষণা করলাম বিক্ষুব্ধ শোকার্ত জনতার মাঝে। আসাদের রক্তাক্ত পতাকা সামনে রেখে সমাবেশের উদ্দেশে বললাম, ‘আসাদের এই রক্ত আমরা বৃথা যেতে দেব না।’ আমাদের সত্তা ও অস্তিত্ব আসাদের রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ হলো। শহীদ মিনার থেকে শুরু হলো শোকমিছিল। সবার সামনে আমি এবং অন্য ছাত্র নেতৃবৃন্দ।  হাজার হাজার মহিলা, গৃহবধূ, তরুণী, ছাত্র-ছাত্রী, শ্রমিক, কর্মচারী। শোকমিছিল মুহূর্তেই লাখো মানুষের বিক্ষোভ মিছিলে পরিণত হলো। আসাদের মৃত্যুর খবর ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। চারদিক থেকে মানুষের স্রোত আসছে। শোকমিছিলের সম্মুখভাগ যখন তিন নেতার সমাধিসৌধের কাছে তখন মাইকে পুলিশ ও ইপিআরের কণ্ঠস্বর ‘ডোন্ট ক্রস, ডেঞ্জার-ডেঞ্জার, ডোন্ট ক্রস!’ কিন্তু শোকমিছিল শোকে আর ক্ষোভে উত্তাল। ডেঞ্জার শব্দের কোনো মূল্যই নেই সেই মিছিলের কাছে। মিছিল থামল না, নির্ভয়ে এগিয়ে গেল। সামনে তাক করা অগণিত রাইফেল আর রাইফেলের সামনে পেতে দেওয়া লাখো মানুষের বুক। ডেঞ্জার ক্রস করে রক্তাক্ত লাল পতাকা নিয়ে এগিয়ে যায় আমাদের মিছিল। পল্টনে পৌঁছলাম আমরা। সেখানেও হাজার হাজার মানুষ আমাদের অপেক্ষায়। পল্টনে ঠাঁই নেই। লোকে লোকারণ্য। আসাদের গায়েবানা জানাজা হলো ওখানে। সবকিছুই ছিল অনির্ধারিত। মঞ্চ বা মাইক কিছুই ছিল না। কিন্তু সবাই চায় সংগ্রামের কর্মসূচি। অতঃপর শোকসভায় সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার পর ২১ জানুয়ারি অর্ধদিবস হরতাল এবং হরতালের পর পল্টনে সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করলাম।

২১ জানুয়ারি পূর্বঘোষিত হরতালের কর্মসূচি পালনকালে কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটল। চারদিক থেকে স্রোতের মতো মানুষের ঢল নামল পল্টন ময়দানে। এদিনও মাইক, মঞ্চ কিছুই ছিল না। পল্টনে চারা গাছের ইটের বেষ্টনীর ওপর দাঁড়িয়ে আমাকে বক্তব্য দিতে হলো। বক্তৃতার পর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করি : ২২ জানুয়ারি শোকমিছিল, কালো ব্যাজ ধারণ, কালো পতাকা উত্তোলন। ২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মশালমিছিল, পরে কালো পতাকাসহ শোকমিছিল। ২৪ জানুয়ারি দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল। ২২ জানুয়ারি, ঢাকা নগরীতে আমি এমন কোনো বাঙালি দেখিনি যার বুকে কালো ব্যাজ নেই। বাড়িতে, অফিসে সর্বত্রই কালো পতাকা উড়ছে। সেদিনের কালো পতাকা ছিল শোকের। ঘাতকদের প্রতি ঘৃণার এবং সংগ্রামের দৃঢ় প্রত্যয়ের। একমাত্র ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া ঘৃণা প্রকাশের এই প্রতীকী প্রতিবাদ ছিল সর্বত্র। ২৩ জানুয়ারি শহরের সব অলিগলি থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বের হয় একটির পর একটি মশালমিছিল। সমগ্র ঢাকা পরিণত হয় মশালের নগরীতে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। চোখে না দেখলে বলে বোঝানো যাবে না।

২৪ জানুয়ারি অর্ধদিবস হরতাল পালিত হলো। সর্বাত্মক হরতাল। আমাদেরও যেন অভিজ্ঞতা বাড়ছিল। আগে কখনই বুঝতে পারিনি সাধারণ অচেনা-অজানা মানুষগুলো বঙ্গবন্ধুকে এত ভালোবাসে, এত গভীর সম্পর্ক তার সঙ্গে। সবার একই প্রশ্ন— ‘শেখ মুজিব কবে মুক্তি পাবেন?’ (তখনো তিনি বঙ্গবন্ধু উপাধি পাননি)। ‘কবে আগরতলা মামলা তুলে নেওয়া হবে?’ ‘যদি সরকার না মানে তাহলে?’ ‘এমন সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে যেন আমরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে তাকে মুক্ত করে নিয়ে আসতে পারি।’ ‘এখনই আমাদের তুমুল সংগ্রাম শুরু করা উচিত যেন আইয়ুবের পতন ঘটে।’ ‘আইয়ুব-মোনায়েমের পতন না হলে শেখ মুজিব মুক্তি পাবেন না।’ ঢাকা শহরের সর্বত্র এ ধরনের আলোচনাই চলছিল। হরতালের পরও মিছিলের বিরাম নেই। বিভিন্ন স্থানে যেখানেই পুলিশ বিক্ষোভকারীদের বাধা দিচ্ছিল সেখানেই খণ্ডযুদ্ধ। জনগণ এতটাই ক্ষিপ্ত ও সাহসী হয়ে উঠেছিল যে, পুলিশ-ইপিআরের গুলির ভয় কেটে গেছে তাদের। মিছিলে শরিক তখন শ্রমিক, আশপাশ এলাকার কৃষক, দিনমজুর, হকার, রিকশাচালক, ঠেলাগাড়ি চালক, ঘাটের কুলি, বৈঠা হাতে নৌকার মাঝি, ছোট দোকানদার, আড়তের কর্মচারী, হোটেল শ্রমিক আরও কত শত পেশার মানুষ। এ আন্দোলনের চেহারা অন্য রকম। অন্য রকম এ কারণে যে, এ আন্দোলনে ছিল বিপ্লবের প্রকৃতি ও প্রবণতা। কিন্তু নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে তারা ছাত্রদের তথা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের। এ দিকটায় আমি অত্যন্ত সচেতন ছিলাম। ডাকসুর সহসভাপতি হিসেবে আমার কাঁধে তখন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক ও মুখপাত্রের দায়িত্ব। সমগ্র বাংলাদেশ সংগ্রামের বিস্ফোরণে তখন প্রকম্পিত, অগ্নিগর্ভ। জনরোষ নিয়ন্ত্রণ করে নিয়মতান্ত্রিকতা বজায় রাখা যে কত কঠিন সেদিন আমি মর্মে মর্মে অনুভব করেছি। হরতাল চলাকালে একজন মন্ত্রীর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিল বিক্ষুব্ধ জনতা। কিছুক্ষণের মধ্যে ইপিআর ও পুলিশ মরিয়া হয়ে ওঠে বিক্ষোভ দমনে। যত্রতত্র গুলি চালাতে থাকে। সে গুলিতেই নিহত হয়ে শহীদদের তালিকায় যুক্ত হয় মতিয়ুর, মকবুল, আনোয়ার, রুস্তম, মিলন, আলমগীরসহ আরও অনেক নাম। ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্র মতিয়ুর রহমানের লাশ নিয়ে আমরা পল্টনে যাই। দুপুরে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় পল্টন ময়দানে। এ হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। তখনই শুনতে পাই মোনায়েম খান শহরের নিয়ন্ত্রণভার ছেড়ে দেবেন সেনাবাহিনীর হাতে এবং অচিরেই কারফিউ জারি হবে। আমরা পল্টন থেকে ইকবাল হলে এলাম মতিয়ুরের লাশ নিয়ে। ঢাকা তখন মিছিলের নগরী। চারদিকে বিক্ষোভ আর গগনবিদারী স্লোগান। যখন ইকবাল হলে পৌঁছলাম তখনই রেডিওতে ঘোষণা করা হলো ঢাকা শহরে কারফিউ বলবতের। মতিয়ুরের পকেটে এক টুকরো কাগজে নাম-ঠিকানাসহ লেখা ছিল ‘মা-গো, মিছিলে যাচ্ছি। যদি ফিরে না আসি মা, মনে কোরো তোমার ছেলে বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য, শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য জীবন দিয়েছে। ইতি— মতিয়ুর রহমান, দশম শ্রেণি, নবকুমার ইনস্টিটিউট। পিতা— আজহারউদ্দিন মল্লিক,  ন্যাশনাল ব্যাংক কলোনি, মতিঝিল।’ কারফিউর মধ্যেই আমরা মতিয়ুরের লাশ নিয়ে গেলাম ন্যাশনাল ব্যাংক কলোনিতে। আমরা ওর পিতা-মাতার আকুল আর্তনাদের আশঙ্কা করছিলাম। কিন্তু প্রথমটায় তাদের পাথরের মতো মনে হলেও শেষে শোকবিহ্বলতা ভেঙে স্বাভাবিক হয়ে উঠলেন। মা শুধু আঁচলে চোখ মুছে বললেন, ‘আমার ছেলে চলে গেছে দুঃখ নাই!  আজ থেকে তুমি আমার ছেলে। মনে রেখো, যে জন্য আমার ছেলে রক্ত দিয়ে গেল, সেই রক্ত যেন বৃথা না যায়।’ আজ যখন সেদিনের কথা লিখছি, তখন শহীদ মতিয়ুরের প্রয়াত মায়ের কথা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। যত দিন তিনি জীবিত ছিলেন তত দিন তাকে আপন মায়ের মতোই সম্মান করেছি। সেদিন শহীদ মতিয়ুরের রক্ত আমরা বৃথা যেতে দিইনি। ঢাকা শহরের বিবেক নড়ে উঠেছিল। কারফিউ কোথায়? মানুষ নেমে এসেছে রাজপথে। কজন মারবে ওরা? একসঙ্গে হাজার হাজার, লাখ, লাখ! কটা গুলি ছুড়বে ওরা? ওরাও স্তম্ভিত হয়ে গেল। মানুষের পুঞ্জীভূত ঘৃণা এমন ভয়ঙ্কর ক্ষোভে পরিণত হয়— ওরা প্রচণ্ড বিস্ময়ে দেখল শুধু। একদিকে কারফিউর কথা রেডিওতে বার বার ঘোষণা হচ্ছে, অন্যদিকে রাজপথে বিক্ষুব্ধ মানুষের ভয়াল গর্জন এবং সরকারি ভবনগুলোয় আগুন জ্বলছে। ‘দৈনিক পাকিস্তান’, ‘মর্নিং নিউজ’ এবং ‘পয়গাম’ পত্রিকা অফিস আগুন ধরিয়ে দেয় উন্মত্ত জনতা। আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় আগরতলা মামলার প্রধান বিচারপতি এস রহমান, নবাব হাসান আসকারীর বাড়ি এবং রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধকারী খাজা শাহাবুদ্দীনসহ আরও কয়েক মন্ত্রীর বাসভবন।

ঊনসত্তরের ২৪ জানুয়ারি গণআন্দোলন-গণবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় গণঅভ্যুত্থান। এর পর থেকে ছিল লাগাতার বিক্ষোভ। কারফিউর মধ্যে এক দিনও থেমে থাকেনি আমাদের সংগ্রাম। ইতিমধ্যে দেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানি প্রশাসন বর্জন করেছে। কল-কারখানা, অফিস-আদালত, সচিবালয় সর্বত্র প্রশাসন ভেঙে পড়েছে। পুলিশ দ্বিধাগ্রস্ত। বলতে কুণ্ঠা নেই, বড় বড় সরকারি কর্মকর্তা জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সিদ্ধান্তের জন্য ধরনা দিতেন তখন ইকবাল হলে। কিছু দিনের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের দফতর তথা ইকবাল হলের ৩১৩ নম্বর কক্ষ। ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা ১১ দফার প্রতি ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবীসহ বাংলার সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন আদায় করতে পেরেছিলাম। ১১ দফার পক্ষে নারী-পুরুষ-শিশু-যুবক-বৃদ্ধ সবাই তখন ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল। মহাগণজাগরণের বিপ্লব-স্পন্দিত সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে এখনো জাগরিত হই। ’৬৯-এর জানুয়ারির এই আন্দোলনকেই আমরা ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে গেছি। এরপর সান্ধ্য আইন প্রত্যাহূত হলে ৯ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ‘শপথ দিবস’ পালন করে। শপথ দিবসে আমার সভাপতিত্বে সভা শুরু হয় এবং আমরা ১০ জন ছাত্রনেতা ‘জীবনের বিনিময়ে হলেও ১১ দফা দাবি বাস্তবায়ন করব’— জাতির সামনে এই অঙ্গীকার ব্যক্ত করার শপথ নিয়ে স্লোগান তুলি, ‘শপথ নিলাম শপথ নিলাম মুজিব তোমায় মুক্ত করব, শপথ নিলাম শপথ নিলাম মাগো তোমায় মুক্ত করব।’ ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ হরতাল পালন ও ডাকের জনসভায় জনতার দাবির মুখে বক্তৃতা প্রদান করি। ১৫ তারিখ আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ১৮ তারিখ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা হত্যাকাণ্ডের পর পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। সংগ্রামী ছাত্র-জনতা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু মুজিবের মুক্তির দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে। মানুষ ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। এ অবস্থায় ২১ তারিখ শহীদ দিবসে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভা থেকে স্বৈরশাসকের উদ্দেশে আলটিমেটাম প্রদান করে বলি, ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।’ ২২ তারিখ তথাকথিত লৌহমানব আইয়ুব খান আমাদের দাবির কাছে নতিস্বীকার করে বঙ্গবন্ধু মুজিবসহ সব রাজবন্দীকে নিঃশর্ত মুক্তি প্রদান করেন। ফেব্রুয়ারির ২৩ তারিখ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। এদিন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে সদ্যকারামুক্ত প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এভাবেই আমরা চূড়ান্ত বিজয়ের বীজ বপন করেছি এবং ‘মুক্ত মানব শেখ মুজিব’ গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিয়ে বাংলার মানুষের সর্বজনীন ভোটাধিকার ও সার্বভৌম পার্লামেন্ট নির্বাচনের দাবি তুলে ধরেছেন।

অনেক সময় চিন্তা করি— সেদিন আর এদিন। কত পার্থক্য। সেদিনের ছাত্রসমাজ সুনির্দিষ্ট আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে সংগ্রাম করেছে। গণআন্দোলন চলাকালে ও পরে আমরা দেশের বহু জায়গা সফর করেছি। ডাকসুর ভিপি ও পরে ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে দেশের বহু জায়গায় গিয়েছি। ট্রেনে যখন সফর করতাম আসন ছিল তৃতীয় শ্রেণির কামরায়। তখন এত বিলাসবহুল সুদৃশ্য আধুনিক বাস বা যানবাহন ছিল না। আমরা বাসে করে বিভিন্ন সভাস্থলে যেতাম। ট্রেন থামিয়ে, বাস থামিয়ে মানুষ আমাদের কথা শুনতে চেয়েছে। সেদিনের কথা ভাবলে গর্বে আমার বুক ভরে ওঠে। শিক্ষকসমাজ আমাদের কাছে পিতৃতুল্য ছিলেন। তারাও আমাদের সন্তানতুল্য গণ্য করতেন। তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল রাজনৈতিক নেতা তৈরির কারখানা। ’৬০-এর দশকের অনেক ছাত্রনেতাই আজ জাতীয় নেতায় পরিণত হয়েছেন। তখনকার দিনে নিয়মিত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন নতুন নেতা নির্বাচিত হতেন। আমাদের সময়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভেদ থাকলেও নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল মধুর। যে চারটি ছাত্র সংগঠন আমরা একত্রিত হয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে জাতির সামনে ১১ দফা দাবি পেশ করেছিলাম তাদের মধ্যে মত ও পথের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আমরা একই টেবিলে বসে ১১ দফা প্রণয়ন করেছি। নিজেদের মধ্যে ঐক্যের দিকগুলো প্রাধান্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছি। ছাত্রসমাজের সাধারণ সমস্যাগুলো আমরা সামনে নিয়ে এসেছি। সবার চিন্তাধারাকে সমন্বিত করেছি। ৬ দফা সবাই সমর্থন করতেন না। ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ ৬ দফা সমর্থন করত না। অন্যদিকে ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপ ৬ দফা সমর্থন করত। আবার উভয় গ্রুপই বঙ্গবন্ধুর মুক্তির প্রশ্নে এককভাবে তার নাম দিতে রাজি হয়নি। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতেই আন্দোলন কেন্দ্রীভূত হয়েছে, গতিশীলতা লাভ করেছে। আমাদের লক্ষ্যই ছিল ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। মত ও পথের পার্থক্যকে বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে দূরে রেখেছি। সহনশীল ও পরমতসহিষ্ণু থেকে সামাজিক সম্পর্ককে অটুট রেখেই রাজনীতি করেছি। এসব সত্ত্বেও দেশব্যাপী এমন একটি জনসমর্থিত তুমুল গণআন্দোলন সংঘটিত করতে পেরেছিলাম কেবল মানুষের বিপুল আস্থা আর বিশ্বাস আমাদের ওপর ছিল বলেই। আমরা মানুষের বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়েছি। যেমন শহীদ মতিয়ুরের মা ক্রন্দনরত অবস্থায় বলেছিলেন, ‘আমার সন্তানের রক্ত যেন বৃথা না যায়।’ আমরা মতিয়ুরের রক্ত বৃথা যেতে দিইনি। ’৬৯-এর গণআন্দোলনের কথা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু কেন এই দিবসগুলো যথাযথভাবে পালন করা হয় না? স্বাধীন বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ কেন এই দিবসগুলো যথাযথ গুরুত্ব ও মর্যাদার সঙ্গে পালন করে না? এ প্রশ্ন আমাকে নিয়তই তাড়িত করে। ২০ জানুয়ারি আসাদের রক্তের মধ্য দিয়ে যে আন্দোলন রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল সেই আন্দোলনের সফল পরিণতি— বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তি, প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারপ্রাপ্তি, ’৭০-এর নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে একসাগর রক্তের বিনিময়ে মহত্তর বিজয় অর্জন। এই সবকিছু অর্জনের ড্রেস রিহার্সাল ছিল ’৬৯-এর অগ্নিঝরা দিনগুলো, যা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে এবং থাকবে চিরদিন।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, মন্ত্রী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

[email protected]

সর্বশেষ খবর