সোমবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

পরিবারের সন্দেহ সাবেক স্বামী

নিজস্ব প্রতিবেদক

পরিবারের সন্দেহ সাবেক স্বামী

রাজধানীর গুলশানে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত নীলা আক্তার রানীর সাবেক স্বামী আলমের রহস্যজনক আচরণ সন্দেহের সৃষ্টি করেছে স্বজনদের মনে। মৃত্যুর পর রানীর ফোন নম্বর দিয়েই সর্বপ্রথম আলম তার মৃত্যুর সংবাদটি রানীর বোন তানিয়াকে জানান। লাশ দাফনের আগ পর্যন্ত এক পুরুষ ও অজ্ঞাত বেশ কয়েকজন নারীর উপস্থিতি এবং পরবর্তী সময়ে তাদের সটকে পড়া নিয়েও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। পুলিশ বলছে, নিহতের কাছে কোনো মোবাইল ফোন পাওয়া যায়নি। রানীর মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে অপরাধীদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে। থানা পুলিশের পাশাপাশি খুনের রহস্য উন্মোচনে র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশ কাজ করছে। এদিকে গতকাল সকালে রানীকে স্বামী আলমের গ্রামের বাড়ি জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে নেওয়া হয়। সেখানে জানাজা শেষে স্থানীয় একটি কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়েছে। শুক্রবার রাতে গুলশান-২ নম্বর ৪৩ নম্বর সড়কের ৩৮ নম্বর বাড়ির সামনে থেকে রানীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

পরে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে পাঠানো হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে প্রথমে ঘটনাটিকে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা বলা হলেও পরদিন শনিবার ঢামেক কর্তৃপক্ষ ময়নাতদন্ত শেষে জানায়, ওই নারীর শরীরে দুটি গুলি পাওয়া গেছে।

ওই দিনই মৃতের বড় বোন শাহনাজ ও বান্ধবী পারভীনসহ কয়েকজন রানীর লাশ শনাক্ত করেন। স্বজনরা জানান, রানীর গ্রামের বাড়ি সিলেটের জৈন্তাপুরে। তার এক ছেলে রাকিবুল হাসান শান্ত (১৭) ও এক মেয়ে নন্দিনী (৬)। স্বামীর নাম মোহাম্মদ আলম। কয়েক মাস আগে তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। এরপর প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে কুড়িলের কাজীপাড়ায় থাকতেন রানী। তবে তিনি কী কাজ করতেন তা নিশ্চিত করতে পারেননি স্বজনরা। ঘটনার পর শনিবার রাতেই অজ্ঞাত আসামিদের নামে একটি হত্যা মামলা করেন নিহতের ভাই মুরাদ হোসেন। এ বিষয়ে গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সালাহউদ্দিন মিয়া জানান, নিহতের কাছ থেকে মোবাইল ফোন কিংবা অন্য কিছু পাওয়া যায়নি। তবে নিহতের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে তদন্ত চলছে।

এদিকে মামলার বাদী মুরাদ হোসেন তার বোনের মৃত্যুর বিষয়ে বেশ কিছু সন্দেহের কথা জানিয়েছেন। তিনি জানান, শুক্রবার রাত ৩টার দিকে তার বোনজামাই আলম তাদের ছোট বোন তানিয়াকে রানীর মোবাইল নম্বর থেকে ফোন করেন। বলেন, রানী কুড়িল বিশ্বরোডে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ওই সময়ই মুরাদকে আলম জানান, রানী আট মাস আগে তাকে ডিভোর্স দিয়ে অন্য একটি ছেলেকে বিয়ে করে তাকেও ডিভোর্স দিয়েছে। তাই আইনত মুরাদরাই এখন রানীর অভিভাবক এবং তাদেরই লাশের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

পরে তিনি রানীর মোবাইল নম্বরে ফোন দিয়ে ‘হ্যালো’ বলার সঙ্গে সঙ্গে ফোনটি কেটে দেওয়া হয়। এরপর আলম অজ্ঞাত একটি মেয়ের নম্বর দেন তাদের। ওই মেয়েটিকে ফোন দিলে তিনি তাদের জানান, রানী গুলশানে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। একপর্যায়ে তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। কারণ আলম জানিয়েছিলেন রানী মারা গেছেন বিশ্বরোডে। আর অজ্ঞাত নারীটি বলছেন গুলশানে।

একপর্যায়ে ওই মেয়েটি মুরাদকে বলেন, ‘ষড়যন্ত্র করে তাকে...।’ মেয়েটির কথা শেষ করার আগেই আরকেটি কণ্ঠ মেয়েটির কথা থামিয়ে দেয়। তবে ওই মেয়েটি মুরাদকে বলেন, ‘গুলশান এলাকায় অনেক সিসি ক্যামেরা আছে। রহস্য ঠিকই বের হবে। আপনারা তাড়াতাড়ি ঢাকায় আসেন।’

মুরাদ জানান, শনিবার তিনি থানা হয়ে ঢামেক হাসপাতালে যাওয়ার পর সেখানে বেশ কিছু অপরিচিত মুখ দেখতে পান। এদের অধিকাংশই ছিল নারী। তাদের মধ্যে সেলিম ওরফে শাহিন নামে একটি ছেলেও ছিল। ওই ব্যক্তি মুরাদকে বলেন, ‘এখানে অনেক ব্যাপার-স্যাপার আছে। লাশ দাফনের পর আপনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন।’

এরপর আলমসহ রহস্যময় অজ্ঞাত ওই নারীরা আজিমপুর কবরস্থানে দাফনের সব রকম প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছেন বলে জানান। কিন্তু হঠাৎ করেই রানীর ছেলে শান্তকে আড়ালে ডেকে নিয়ে যান অজ্ঞাত নারীরা। এর পরই তারা সিদ্ধান্ত বদল করে জানান, লাশ দাফন করা হবে আলমের গ্রামের বাড়ি জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে। সেই অনুযায়ী তারা সবাই লাশ নিয়ে রওনা দেন। কিন্তু পথিমধ্যে অজ্ঞাত ওই নারীরা এবং সেলিম ওরফে শাহিন নামের ছেলেটি নেমে যান।

মুরাদ জানান, তিনি অজ্ঞাত নারীদের কাছে তাদের মোবাইল ফোন নম্বর চাইলে তারা এড়িয়ে যান। তবে পরে তিনি সেলিম ওরফে শাহিনের মোবাইল নম্বরে ফোন দিলে তিনি মুরাদকে জানান, তিনি সব তথ্য দিতে পারবেন কিন্তু পুলিশের মুখোমুখি হতে পারবেন না। এসব বিষয়ে আলমের মোবাইল ফোনে কল করা হলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। একইভাবে বন্ধ আছে রানীর ছেলে শান্তর ফোন নম্বরটিও। শান্ত তার বাবা আলমের সঙ্গে থাকেন। আলম পেশায় প্রাইভেটকার চালক।

গতকাল বিকালে সরেজমিনে রানীর কুড়িল কাজীবাড়ী এলাকার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টিনশেডের একটি কক্ষে রানী থাকতেন। কক্ষটি তালাবদ্ধ। কক্ষটিতে টিভি, ফ্রিজ ও খাটসহ বেশ কিছু আসবাবপত্র রয়েছে জানিয়ে বাড়িওয়ালা মান্নান কাজীর মেয়ে রুমা বলেন, ‘১ জানুয়ারি পাঁচ হাজার টাকায় রানী বাসাটি ভাড়া নেন। তার বাইরে যাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট সময় ছিল না। তার ছয় বছরের একটি প্রতিবন্ধী মেয়ে আছে। নাম নন্দিনী। বাইরে যাওয়ার সময় মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন রানী। ফেরার সময় তাকে সঙ্গে নিয়েই ফিরতেন। বাসায় যতক্ষণ থাকতেন এর বেশির ভাগ সময়ই ঘুমিয়ে কাটাতেন রানী। একদিন রান্না করে দুই-তিন দিন খেতেন। তবে তিনি কী কাজ করতেন তা আমাদের জানাননি।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর