রবিবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা
হাওরের ক্ষয়ক্ষতি সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে

পানিতে তলিয়ে ৭ লাখ কৃষকের ২ হাজার কোটি টাকার ফসল

মাসুম হেলাল, সুনামগঞ্জ

বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জ হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে এবং জলাবদ্ধতায় পানিতে তলিয়ে আছে ৭ লাখ কৃষকের ২ হাজার কোটি টাকার ফসল। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বোরো ফসলের এই ক্ষয়ক্ষতি অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে।

সূত্র জানায়, বিস্তীর্ণ হাওর তলিয়ে যাওয়ার পর হাতে গোনা যে বড় কটি হাওর অক্ষত ছিল দুটি বাদে তার সবগুলোই এখন পানির নিচে তলিয়ে আছে। এর ফলে বছরের একটিমাত্র ফসলের ওপর নির্ভরশীল জেলার ২৬ লাখ মানুষের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের অর্থনৈতিক ভিত্তি ভেঙে পড়েছে। ঋণগ্রস্ত কৃষক ও খেতমজুররা অনাহারে অর্ধাহারে দিন যাপন করছেন। এই পরিস্থিতিতে জেলাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা ও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ব্যাপক পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছেন বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন। এদিকে ফসলহারা কৃষকের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জেলার অনেক স্থানে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অস্বাভাবিক হারে চাল ও আটার মূল্য বৃদ্ধি করায় কৃষকের দুর্দশা আরও বেড়েছে। হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন নামের স্থানীয় একটি সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত জেলায় আবাদকৃত ২ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর বোরো ধানের মধ্যে ৮০ ভাগ পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এতে ৭ থেকে ৮ লাখ কৃষক পরিবার প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। তাদের দেওয়া হিসাব মতে, তলিয়ে যাওয়া বোরো ফসলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দুই হাজার কোটি টাকার ওপরে।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত শত শত মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমে কাজের বদৌলতে জামালগঞ্জের পাগনার হাওর ও তাহিরপুরের শনির হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধটি এখন পর্যন্ত অক্ষত রয়েছে। বৃহৎ এ দুটি হাওরে অন্তত ২০ হাজার হেক্টরের ওপরে ধানী জমি রয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় এ রিপোর্ট লেখার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দিরাইয়ের বৃহৎ হাওর কালিয়ারকুটার ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে পানি ঢোকার খবর পাওয়া গেছে।

 স্থানীয় সূত্র জানায়, জেলার বড় ধানী হাওরগুলোর মধ্যে অন্যতম সদর উপজেলার দেখার হাওর, জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়ার হাওর, কাংলার হাওর, শাল্লা উপজেলার ছায়ার হাওর, দিরাই উপজেলার বরাম হাওর, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওর, ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্রসোনারথাল হাওর, ফাসুয়ার হাওর, গুরমার হাওর, জামালগঞ্জ উপজেলার হালির হাওরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ফসলরক্ষা বাঁধ ও বেড়িবাঁধ ভেঙে লক্ষাধিক হেক্টর জমির বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন হাওরের লাখো বোরো চাষি।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার হাছনবসত গ্রামে বোরো চাষি আনোয়ার হোসেন জানান, ৭০ হাজার টাকা ঋণ করে চার একর জমিতে ফসল আবাদ করেছিলেন তিনি। জাওয়ার হাওরের কাঁচা এই ফসল এখন পানির নিচে। একটি মাত্র ফসলের ওপর নির্ভর আনোয়ার আট সদস্যের পরিবার নিয়ে চরম বিপাকে আছেন। তিন সন্তানের লেখাপড়ার খরচ, ভরণপোষণ সবই আসত বোরো ধান বিক্রির অর্থ থেকে। এক দিকে সংসার আর অন্যদিকে ঋণের বোঝা— দুয়ে মিলে চোখে অন্ধকার দেখছেন তিনি।

কৃষি সংশ্লিষ্টদের মতে, চৈত্র মাসের এই সময়ে এসে ধান পাকার আগেই বোরো ফসলের ক্ষয়ক্ষতির এই পরিমাণ অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। নিকট অতীতে তারা এমন পরিস্থিতি আর দেখেননি। আবাদকৃত ফসলের ৮০ থেকে ৯০ ভাগ ফসল তলিয়ে গেছে।

কৃষি বিভাগ জানায়, সুনামগঞ্জে চলতি মৌসুমে দুই লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে বোরো ধান। যেখান থেকে ৮ লাখ ৭৮ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। যার বাজার মূল্য ২ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা। আবাদকৃত এই বোরো ফসলের দুই তৃতীয়াংশ আগাম বন্যার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ৪০টি বড় হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধ ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পাউবোর আওতাধীন ৪০টির মধ্যে ৩৮টি হাওরের ফসলই এখন পানির নিচে।

ভুক্তভোগী কৃষকদের অভিযোগ, ঝড় বৃষ্টির মৌসুমে কাজ শুরু করার কারণে বেশির ভাগ বাঁধে নামেমাত্র কাজ হয়েছে। পর্যাপ্ত ‘কিউরিং পিরিয়ড’ না থাকায় বাঁধগুলো পানির চাপ মোকাবিলার মতো শক্তপোক্ত হয়নি। এদিকে এক মাস সময় বৃদ্ধি করার পরও অনেক ঠিকাদার বিস্তীর্ণ হাওরের ফসল অরক্ষিত রেখে বাঁধ নির্মাণের কাজই শুরু করেননি।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম জানান, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের চেষ্টা চলছে। প্রাথমিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ৩৬০ মেট্রিক টন চাল নগর ১৬ লাখ টাকা ও ২৫৫ বান্ডিল ঢেউ টিন সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় প্রতিদিন ৩ মেট্রিক টন করে চাল ও আটা ন্যায্যমূল্যে (ওএমএস) বিক্রি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে জেলায় খাবারের কোনো সংকট নাই। চালের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টিও আমরা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সেটা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছি।

সর্বশেষ খবর