সোমবার, ১১ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা
ঈদে বাড়ি ফেরা

দ্বিগুণ টাকায় কালোবাজারে মিলছে ‘সোনার হরিণ’

মোস্তফা কাজল

কাউন্টারে টিকিট নেই, অনেক আগেই নাকি বিক্রি হয়ে গেছে। ফলে হন্যে হয়ে কাউন্টারের পর কাউন্টারে ঘুরে ঈদের জন্য ঘরে ফেরা মানুষগুলো সোনার হরিণ নামের টিকিট পাচ্ছেন না। কিন্তু কেউ ভিন্ন পন্থা নিলেই পাচ্ছেন এ হরিণ। দ্বিগুণ টাকা দিলেই কালোবাজারিরা হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে নির্ধারিত যাত্রাদিনের টিকিট। গতকালও বাস টিকিটের জন্য ঘুরে বেড়িয়েছেন অনেক যাত্রী। টিকিট না পেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন তারা। কমলাপুর রেলস্টেশনে বিক্রি আগেই শেষ হয়ে গেছে। তবে বাড়তি দাম দিলেও এখনো মিলছে ঈদের ট্রেনের টিকিট। এসব টিকিট এক শ্রেণির কালোবাজারি বাড়তি দামে বিক্রি করছেন। খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, গতকাল থেকে ৬৮ নৌরুটে লঞ্চ কেবিনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে। তবে বাড়তি দাম দিলেই কেবল পাওয়া যাচ্ছে লঞ্চ, বাস ও ট্রেনের টিকিট। অনেকে জানিয়েছে, ঈদের টিকিট এখন সোনার হরিণ। নির্ধারিত দামের চেয়ে দ্বিগুণ দাম দিলেই পাওয়া যাচ্ছে কাঙ্ক্ষিত দিনের টিকিট।

নেই আর নেই : বাস কাউন্টারে বাসের টিকিট নেই। রেলের নেই বাড়তি যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা। সড়ক পথের তুলনায় এবার রেলপথে চাপ বেড়েছে তিনগুণ। কল্যাণপুরের শ্যামলী পরিবহনের টিকিট কাউন্টারে গতকাল দেখা গেছে, রাজশাহীর ন্যাশনাল সার্ভিসে কর্মরত স্ত্রী ও দুই সন্তানকে উঠিয়ে দিতে এসেছিলেন হাসান আজাদ নামে এক ব্যক্তি। বেসরকারি চাকরিজীবী আজাদ বলেন, গত বছরও পরিবার-পরিজনকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এবার ছুটি অনেক ছোট। তাই আগেই পাঠিয়ে দিচ্ছি। কাউন্টারে টিকিট না পেয়ে প্রতিটি টিকিটের জন্য ২০০ টাকা বেশি দিয়ে রাজশাহীর টিকিট কিনেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নয়ন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে। তাই আগেভাগেই বাড়ি চলে যাচ্ছি। আমাকেও রংপুরের টিকিট ১৫০ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হয়েছে। জানতে চাইলে শ্যামলী পরিবহনের ম্যানেজার পারভেজ আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আগামী ১৪ থেকে ১৬ জুনের টিকিট নেই।

এরপরও ঈদের আগের দিন পর্যন্ত সব বাসস্টেশনে ভিড় অব্যাহত থাকবে। ঈদের অগ্রিম টিকিট সবই বিক্রি হয়ে গেছে। ১২ থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার টিকিট বিক্রি করা হয়েছে।’ তিনি জানান, ঈদের আগের দিন পর্যন্ত স্বাভাবিক নিয়মে প্রতিটি বাস ছেড়ে যাবে। ঈদে ঘরেফেরা মানুষের দুর্ভোগ কমাতে অন্যান্য রুটে চলাচলকারী একাধিক বাস গাবতলীতে রাখা হবে। হানিফ পরিবহনের ম্যানেজার রুহুল আমিন জানান, গতকাল থেকে ঘরমুখো যাত্রীদের চাপ শুরু হয়েছে। এ ভিড় বাড়তেই থাকবে। তাদের প্রতিদিনের টিকিট বিক্রির পরিকল্পনা ছিল প্রায় ৮ হাজার। প্রতিটি রুটে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত বাস চলাচল করবে।

কমলাপুর রেলস্টেশনে ছিল ঘরমুখো মানুষের দীর্ঘ মিছিল। মূলত বেশিরভাগ মানুষই স্ত্রী-সন্তানদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার উদ্দেশে স্টেশনে এসেছিলেন। ছাত্রছাত্রীরাও ট্রেনে চেপে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতি ট্রেনের যাত্রী স্কুল শিক্ষিকা কুসুম আলম অভিযোগ করে বলেন, ৪৫০ টাকার টিকিট ৬০০ টাকায় কিনে বাড়ি যাচ্ছি। সিলেটের উপবনের যাত্রী মিজানুর রহমান বলেন, কাউন্টারে টিকিট না পেয়ে ৩৩০ টাকার টিকিট ৪৫০ টাকায় কিনে বাড়ি যেতে হচ্ছে।

এ ছাড়া নৌপথে ১৫ লাখ মানুষের যাত্রা শুরু কাল থেকে। ৬৮টি নৌরুটে সকাল-বিকাল চলবে নানা ধরনের নৌযান। প্রতি লঞ্চেই ছাড়ার আগে টিকিট বিক্রি করা হবে। ভোলার যাত্রী আবুল কালাম বলেন, তিনি গতকাল এমভি পলাশ নামের নৌযানে কেবিনের টিকিট ১ হাজার ২০০ টাকার স্থলে ১ হাজার ৬০০ টাকায় কিনেছেন। এ ছাড়া পিরোজপুরগামী এমভি নয়নতারা লঞ্চের যাত্রী বাবুল মিয়া বলেন, ‘আমিও ১ হাজার ৪০০ টাকার টিকিট ১ হাজার ৮০০ টাকায় কিনতে বাধ্য হয়েছি।’ লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি মো. শহিদ উল্লাহ বলেন, ‘এবার স্বল্পদূরত্বের লঞ্চগুলো প্রতিদিন দুই ট্রিপ চলাচল করবে। তবে কোনো অবস্থাতেই ধারণ ক্ষমতার বাইরে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করতে দেব না।’ বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল মালিক যাত্রী পরিবহন সংস্থার (যাত্রী পরিবহন) সচিব সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী জানান, এবারের যাত্রী নিরাপত্তায় সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছেন তারা। জানা গেছে, বেশিরভাগ বাস, লঞ্চ ও ট্রেনের টিকিট কালোবাজারিদের কব্জায় চলে গেছে। তারা যাত্রীদের দুর্বলতার সুযোগে হাতিয়ে নিতে শুরু করেছে লাখ লাখ টাকা। এই অবস্থায় ঈদ ঘনিয়ে আসায় রাজধানীর টার্মিনালগুলোতে শুরু হয়েছে টিকিটবাণিজ্য।

রাজধানীর টার্মিনালগুলোতে পুলিশ ও র‌্যাবের অস্থায়ী ক্যাম্প বসানো হয়েছে। গাবতলী বাস টার্মিনালের প্রবেশ মুখে ঢাকা মহানগর পুলিশ একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ করে পুরো টার্মিনালের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তবে দেশের উত্তরাঞ্চলের যাত্রীদের এই দুর্ভোগের বিপরীতে অগ্রিম টিকিটের চাহিদা নেই চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগসহ দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীদের।

এদিকে বড় বড় বাস কোম্পানির টিকিট না পাওয়া গেলেও আগাম টিকিট বিক্রিই শুরু করেনি অপেক্ষাকৃত ছোট বাস সার্ভিসগুলো। এদের অধিকাংশই যাত্রী ভর্তি হওয়া সাপেক্ষে বাস ছাড়ার নীতি নিয়ে রেখেছে। গত সোমবার থেকে বাসের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হলেও বৃষ্টির কারণে অনেকেই তা সংগ্রহ করতে পারেননি। কিন্তু পরদিন কাউন্টারে গিয়ে আর তারা পাননি কাঙ্ক্ষিত দিনের টিকিট।

গাবতলী বাস টার্মিনাল ও কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ড ঘুরে এ চিত্র পাওয়া গেছে। গতকাল সকাল থেকে রাজশাহীগামী দেশ ট্রাভেলস, ন্যাশনাল ট্রাভেলস, হানিফ এন্টারপ্রাইজে ঘুরে কোথাও কোনো টিকিট সংগ্রহ না করতে পেরে একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত রবিউল আলম বলেন, ‘টিকিট কাটতে প্রতিবছর যে হেনস্তা হতে হয়, তাতে প্রতিবারই ভাবী বাড়ি যাব না। কিন্তু প্রাণের টানে যেতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ঈদের সময় টেলিফোনে টিকিট বুকিং দেওয়ার নিয়ম রাখা হয়নি। ফলে হেনস্তার পথ তৈরি হয়েছে।

সর্বশেষ খবর