[পূর্ব প্রকাশের পর]
মানিসায় বসে বসে যুবরাজের ফিরে আসার প্রহর গুনছেন মাহিদেভরান। জ্বর উঠেছে মুস্তফার। হেকিম এসে ওষুধ দিয়ে গেছেন। অনেক্ষণ ‘বাবা’ ‘বাবা’ করে প্রলাপ বকল মুস্তফা। সারা খাতুন প্রাণপণ চেষ্টা করে মুস্তফাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। এরপর মাহিদেভরানের কাছাকাছি এসে বসলেন।
‘আপনার কী মন খারাপ, মালিকা?‘নাহ, সারা তেমন কিছু না।’
‘তাহলে এভাবে বসে আছেন যে!’
‘ছেলেটা অসুস্থ। তার ওপর সুলেমান এখনো ফিরছেন না। আবার কোনো বিপদ হলো না তো?’
সারা খাতুনের দিকে তাকিয়ে বললেন মাহিদেভরান।
‘আরে নাহ! কিসের বিপদ হবে? হুজুরের মা অসুস্থ। তিনি তো তাকে দেখতে গেছেন। দেখবেন, খুব দ্রুতই ফিরে আসবেন তিনি।’
‘তাই যেন হয়—সারা। কিন্তু অটোমানদের কোনো বিশ্বাস নেই।’
‘কেন মালিকা?’
‘কেন আবার? এই অটোমানরা সিংহাসনের জন্য নিজের পিতা, পুত্র কিংবা ভাই-বন্ধু কাউকেই ক্ষমা করে না। নৃশংসভাবে মেরে ফেলে। আমার সুলেমান সেই অটোমান সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী। তাই তাকেও যদি কেউ মেরে ফেলার চেষ্টা করে! আমি ভয় পাব না কেন বল। এসব নিয়ে আমার ভীষণ চিন্তা হয়।’
‘চিন্তা করবেন না মালিকা, দেখবেন হুজুর ঠিকই নিরাপদে পৌঁছবেন। তাছাড়া তার সঙ্গে পারগালি ইব্রাহীমও আছেন।’
‘হুমম।’
‘তাহলে আর কি। পারগালি যতক্ষণ আছেন ততক্ষণ কোনো সমস্যা নেই।’
‘কিন্তু সায়রা, সমস্যাতো অন্যখানে।’
‘কোথায় মালিকা?’
‘সমস্যা হচ্ছে স্বয়ং ওনার বাবা কিংবা প্রাসাদের অন্য কেউ যদি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকে?’
‘আল্লাহ মাফ করুন। এ ধরনের কিছু ঘটবে না মালিকা। আপনি অযথাই এত চিন্তা করছেন। দেখবেন কোনো সমস্যাই হবে না।’
‘কিন্তু আমি যে আজ খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছি।’
‘সব স্বপ্ন ফলে না মালিকা। আপনি আসলে হুজুরকে নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করছেন। তাকে নিয়ে এত বেশি ভাবতে হচ্ছে যে আপনি ঘুমের ঘোরেও ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখেছেন। এসব নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। মনে বিশ্বাস রাখুন। আল্লাহ সব ঠিক রাখবেন।’
সারা খাতুনের কথায় নিশ্চিত হতে পারেন না মাহিদেভরান। তবে মনের ভিতরের অস্থিরতা কমে এসেছে অনেকটাই।
উঠে দাঁড়িয়ে মানিসার আকাশের দিকে একমনে তাকিয়ে থাকলেন মাহি। সত্যি জীবন কত বিচিত্র!
আলবেনীয় সংগীতজ্ঞ মুহাধিনের মেয়ে মাহিদেভরান এখন অটোমান সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ সুলতানা। বাবার বাড়িতে কাটানো পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায় তার। সেই দিনগুলো খুব বর্ণিল ছিল। এখানকার মতো এত নিয়ম-কানুন কিংবা এমন যান্ত্রিক ছিল না। ইচ্ছে করলেই ঘুরে ঘুরে বেড়ানো যেত। বিকালে ঘুরতে বেড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেলেই মার বকুনি খেতে হতো। আর এখন? এখন কত নিয়ম, কত দায়িত্ব। সুলেমানের সঙ্গে সংসার শুরু করার পর প্রতিমুহূর্তেই আতঙ্ক নিয়ে কাটাতে হচ্ছে।
সেদিন কে যেন মাহিদেভরানকে বলছিল, এখনই এত চিন্তা! সুলেমান যখন সুলতান হয়ে যাবে— তখন কি হবে? তখন তো চারদিকের বিপদ আপদ-ভাবনা-চিন্তা সবই বেড়ে যাবে। যুদ্ধ থেকে শুরু করে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র সবকিছুরই মুখোমুখি হতে হয় একজন সুলতানকে। উজির-নাজির পার্শ্বরাষ্ট্রের চক্রান্ত আরও কত কি! এসব শুনে চুপ হয়ে গিয়েছিল মাহিদেভরান। মাঝে মাঝে তার মনে হয় কী দরকার সিংহাসনের? এমনিই তো ভালো আছে ওরা। এখানে তো কোনো কিছুরই কমতি নেই। তাহলে কেন খামোখা জীবনকে বিপন্ন করে তোলা?
হুট করেই পাশের ঘর থেকে মুস্তফার কান্নার শব্দ ভেসে এলো।
সম্ভবত ঘুম ভেঙে গেছে।
সেদিকেই ছুটে গেলেন সারা খাতুন।
মাহিদেভরান তখনো দিনপুরনো ভাবনার যাত্রী।
একটা একটা করে দুর্ভাবনার জঞ্জাল সরানোর ব্যর্থ চেষ্টায় মত্ত একজন।
মাহিদেভরানের কেবল মনে হয়, এই রাজকীয় রীতি, রাজকীয় অভ্যাস, রাজকীয় প্রক্রিয়া কিংবা রাজকীয় জীবন কোনো কিছুর জন্যই সে উপযুক্ত নয়।
কারণ এর কিছুই তার ভালো লাগে না।
জীবনের এত অনিশ্চয়তা বুকে নিয়ে বাঁচতে ভাল্লাগে না।
তার চেয়ে সাধারণ নিরাপদ জীবন ঢের ভালো!
সুলতান সেলিম খান আসছেন শুনে সবাই যার যার জায়গায় স্থির হয়ে গেল। থেমে গেল মনজিলার পা-ও। তাকে করিডোরে পেয়ে থামল সুলতান।
‘মনজিলা, সুলতানা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?’
‘না জাঁহাপনা। তিনি জেগে আছেন।’
শুনতেই স্ত্রীর কক্ষের দিকে পা ফেললেন সেলিম খান।
‘এখন কেমন আছ সুলতানা?’
স্বামীর কণ্ঠ শুনে শোয়া থেকে খানিকটা উঠে বসতে চাইলেন আয়শা হাফসা। হেলান দিয়ে আধ শোয়া অবস্থায় স্বামীকে বললেন,
‘এখন অনেকটাই সুস্থ জাঁহাপনা। আর সমস্যা হবে না।’
‘হুমম। আরেকটু বিশ্রাম নাও। ওষুধগুলো ঠিক মতো খেও।’
ততক্ষণে সামনে রাখা কেদারায় বসে পড়েছেন সেলিম খান। সঙ্গে সঙ্গে গোটা কক্ষই খালি হয়ে গেছে। সুলতান আর সুলতানাকে একান্তে আলাপের সুযোগ তৈরি করাটাই যে এখানকার নিয়ম! স্ত্রীর হাতটা ধরে কেমন করে যেন স্ত্রীর দিকে তাকালেন সেলিম খান। আয়শা হাফসা স্বামীকে বললেন
‘কী হয়েছে জাঁহাপনা?’
উঁহু.. কিছু না সুলতানা। ‘আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন। আল্লাহর কাছে সেই প্রার্থনাই করি।’
‘আমি কিন্তু এখন পুরোপুরি সুস্থ জাঁহাপনা।’
‘হুমম। সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি।’
বলে একটু হাসলেন সেলিম খান। তাল মিলিয়ে হেসে উঠলেন স্ত্রী আয়শাও।
‘জাঁহাপনা, আপনি সুলেমানকে চলে যেতে দিলেন কেন?’
‘উমা! মানিসায় মাহিদেভরান আর মুস্তাফা একা। তাছাড়া ওর অনেক কাজ। অসুস্থতার কথা শুনে দ্রুতই সময়ের মধ্যে চলে এসেছিল।’
‘তাও। দুয়েকটা দিন অন্তত থেকে যেতে পারত।’
‘তাহলে কাজের নাকি কি ঝামেলা হতো।’
‘কাজ না ছাই। মানিসা কি আমি চালাইনি?’
‘হুমম চালিয়েছ তো। অনেক ভালোই চালিয়েছ।’
হাসিমুখে স্ত্রীর প্রশংসা করলেন সুলতান সেলিম খান।
‘ছেলেটা এলো, ভালো-মন্দ কিছুই খাওয়াতে পারলাম না।’
‘এত ভাবনার কী আছে সুলতানা? সুলেমান শিগগির অটোমান সাম্রাজ্যের সিংহাসনের মালিক হতে যাচ্ছে।’
‘সে তো অনেক দেরি।’
আয়শা হাফসা যেন খানিকটা হতাশ।
সে হতাশায় পানি ঢাললেন সুলতান।
‘খুব বেশি দেরি নয় সুলতানা।’
‘আপনি কি এখনই সুলেমানকে সিংহাসনে বসানোর কথা ভাবছেন?’
‘এটা তুমি কি বলছ সুলতানা?’
সুলতানের কণ্ঠে কৃত্রিম রাগ।
ভড়কে গেলেন আয়েশা।
মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন।
‘আমায় মাফ করবেন জাঁহাপনা। আমি ভেবেছি আপনি নিজে অবসর গ্রহণের কথা ভেবেছেন। তাই এভাবে বলেছি। আমাকে মাফ করবেন।’
‘আচ্ছা-আচ্ছা... সমস্যা নেই। অবসর আমি নেব ঠিকই। শিগগিরই তোমার সুলেমানকে সিংহাসনে বসাব। শুধু খানিকটা সময় অপেক্ষা কর।’
আয়শা হাফসাকে ভীষণ খুশি মনে হলো।
আধ শোয়া অবস্থাতেই সুলতানের হাতটা টেনে নিয়ে চুমু খেলেন। সুলতানও বিনিময়ে স্ত্রীকে ছোট্ট করে একটা চুমু দিয়ে দিলেন।
আরও কিছুক্ষণ স্বামী স্ত্রীতে কথা হলো।
সুলতান সেলিম খানের শরীরের খোঁজ নিলেন আয়শা। বললেন, বয়স হয়েছে। এখন আসলে সুলতানের বিশ্রামের সময়।
আয়শার এই কথার জবাবে শুধু মৃদু হাসেন সুলতান।
মনে মনে ভাবেন সিংহাসন এমন এক চুম্বক যে চুম্বকের আকর্ষণ থেকে মুক্ত হতে পারে না কেউ।
যে চুম্বকের আকর্ষণ সমস্ত রক্তের সম্পর্ক, সমস্ত হিসাব-কিতাব সমস্ত ভাবনা উলটপালট করে দিতে বাধ্য।
সিংহাসনের আকর্ষণ এমনই প্রকট যে ছেলে বুড়ো, যোগ্য-অযোগ্য নির্বিশেষে সবাইকেই দারুণভাবেই আকর্ষিত করে। যে আকর্ষণের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে না কেউই।
তিল তিল করে এগিয়ে নিয়ে আসা কিংবা কোথাও কোথাও গড়ে তোলার সঙ্গেও জড়িত এই সাম্রাজ্যের অধিকর্তা সুলতান সেলিম খান। একজন সুশাসক হিসেবে সাধারণ প্রজাদের ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন। তার উজিররা দারুণ ভয়ে থাকে— কখন গর্দান যায়। এই যে উজিরদের জীবন হুমকির মুখে সেটিও কিন্তু সাধারণ মানুষ ও রাজ্যের সঠিক কাজের জন্যই। এত কিছু করার পরই সুলতান সেলিম খান অটোমান সাম্রাজ্যের সিংহাসন অলঙ্কৃত করতে পারছেন। আর সেই সিংহাসন ছাড়ার প্রসঙ্গ যখন আসে তখন বিষয়টা মানতে একটু খটকা লাগতেই পারে! কিন্তু আয়শা হাফসার সেটি বুঝতে পারার কথা নয়। তিনি তো আসলে মমতাময়ী মা। তাই স্ত্রীর সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সুলতান সেলিম খান।
‘হুজুর আমি সত্যি বলছি আমি চুরি করিনি। ওরা সবাই মিথ্যে বলছে।’
‘সবাই মিথ্যে বলছে আর একলা তুমিই কেবল সত্যি বলছ?’
সুলেমান সুর করে জানতে চাইল অভিযুক্ত ব্যক্তির কাছে।
‘জি হুজুর আমি সত্যি বলছি। আমি চুরি করিনি।’
ইব্রাহীম.. ইব্রাহীম.. ইব্রাহীম বলেই চিৎকার করে উঠলেন মানিসার সম্মানিত প্রশাসক সুলেমান খান। ইব্রাহীম পাশের ঘরেই ছিলেন। সুলেমানের কণ্ঠ শুনে দৌড়ে ছুটে এলেন। সুলেমানের কাছাকাছি এসেই
‘হুজুর। আমায় ডেকেছেন?’
‘হুমম। এই শয়তানটা কোনোমতেই চুরির কথা স্বীকার করছে না। ও যদি নিজে থেকে স্বীকার না করে আর যদি না বলে যে চুরির মুদ্রাগুলো কোথায় রেখেছে, তাহলে ওর শাস্তি আরও বেশি হবে। স্বীকার করলে শাস্তি অনেক অনেক কম হবে। এখানে সবাই জানিয়েছে চুরিটা ও-ই করেছে। এবার তোমার পালা। তুমি কীভাবে প্রমাণ করবে?’
‘আমি দেখছি হুজুর। আমি কী ওকে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারি?’
‘অবশ্যই ইব্রাহীম।’
সুলেমান প্রায়ই এই কাজটা করেন। বিচার করতে গিয়ে কখনো আটকে গেলে ইব্রাহীমকে ডাকেন। আবার কখনো কখনো এমনিতেই ইব্রাহীমকে জড়িয়ে নেন কাজের সঙ্গে। এটা একদিকে যেমন ইব্রাহীমের পরীক্ষা অন্যদিকে সুলেমানের আনন্দ।