৭ মে, ২০১৬ ১১:০৯
ধারাবাহিক উপন্যাস

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান (পর্ব-৭)

রণক ইকরাম

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান (পর্ব-৭)

‘সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট’ খ্যাত সুলতান সুলেমান পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা শাসক ছিলেন। ক্ষমতার টানাপড়েনে ষড়যন্ত্র, গুপ্তহত্যা, ভাই-সন্তান হত্যা, দাসপ্রথা আর হেরেমের নানা পরিক্রমা ছাপিয়ে এগিয়ে  গেছে সুলেমানের শাসনকাল। তার আমলেই আলেকজান্দ্রা নামের এক সাধারণ দাসী হয়ে ওঠেন সুলেমানের স্ত্রী ও সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। সম্প্রতি নতুন করে আলোচনায় আসা সুলেমানকে নিয়ে ইতিহাস আশ্রয়ী এ উপন্যাস। অনেক পাঠকই গল্পের সোর্স জানতে চেয়েছেন। এই উপন্যাসের সরাসরি কোনো উৎস নেই। তবে তথ্য-উপাত্তের মূল উৎস অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস বিষয়ক নানা বইপত্র। মূল চরিত্র আর গল্প ঠিক রেখে লেখক তার কল্পনায় তুলে এনেছেন সেই সময়টুকু। টিভি সিরিজ মুহতাশিম ইউজিয়েলের সঙ্গে আমাদের যেমন কোনো বিরোধ নেই, তেমনি এর অনুকরণেরও প্রশ্নই ওঠে না। প্রতি শনিবারের এ বিশেষ আয়োজনে আজ ছাপা হলো ৭ম পর্ব। সব পর্ব একসঙ্গে পেতে হলে ঢু মারতে পারেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনলাইন সংস্করণে।

[পূর্ব প্রকাশের পর]

দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে।

কনস্টান্টিনোপলের আকাশে যে দুর্যোগের মেঘ জমেছিল, আস্তে আস্তে সেই মেঘ কাটতে শুরু করেছে। সুলতান সেলিম খান আস্তে আস্তে সেরে উঠছেন।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে দিন পনেরোর চেয়েও বেশি সময় কেটে গেছে। ধকল কাটিয়ে এখন তিনি অনেকটাই চনমনে।

সুলতানের অসুস্থতার খবর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচার করা হয়নি। এরপরও সবাই জেনে গিয়েছিল। অচেনা উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল কনস্টান্টিনোপলের অন্দরে বাহিরে। সেই উদ্বেগ কাটানোর জন্য এবার সুলতানের সুস্থতার খবর ছড়িয়ে দেওয়া হলো। ধারণাটা এসেছে আয়শা হাফসার মাথা থেকে। তিনিই পীরে মেহমুদ পাশাকে ডেকে পাঠিয়ে নির্দেশ দিয়ে দিলেন। খবরটা প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা রাজধানীজুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। সবার মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করা হলো। সুলতানের দীর্ঘায়ু কামনা করে প্রার্থনারও আয়োজন করল।

অসুস্থ হওয়ার আগে সুলতান সেলিম খান নিজেই হাঙ্গেরি অভিযানের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তখন থেকেই অভিযানের জন্য প্রস্তুত ছিল তাবৎ সৈন্যরা। কিন্তু যুদ্ধে যাওয়ার মতো শারীরিক পরিস্থিতি ছিল না সুলতানের। উল্টো জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সেই অবস্থা যখন অনুকূলে চলে এলো তখন সৈন্যরাই বা বসে থাকবে কেন। সবদিক শান্ত হয়ে উঠলেও অটোমান সৈন্যরা উত্তেজিত হয়ে উঠল। বিশেষ করে অটোমানদের বিশেষ বাহিনী ‘জেনেসারি’ সৈন্যরা নতুন অভিযানের জন্য রীতিমতো হাঙ্গামা শুরু করে দিল।

ওদিকে যুবরাজ সুলেমানও তখন মানিসায় ব্যস্ত দিন কাটাচ্ছেন। বাবার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন সুলেমান। কিন্তু সুলতান সেলিম খানই পুত্রকে অগ্রাহ্য করেছেন। তার যুক্তি বাবার ছত্রছায়ায় নয়, স্বাধীনভাবে রাজ্য শাসন শিখুক সুলেমান। এ কারণেই আয়শা হাফসার অনুরোধ সত্ত্বেও সুলেমানকে দূরে রাখতেই পছন্দ করেন সেলিম খান।

যুদ্ধের জন্য সৈন্যদের আগ্রহ-উত্তেজনা ভাবিয়ে তুলল অটোমান সুলতানকে। স্ত্রী ও সভাসদদের প্রবল আপত্তি থাকার পরও যুদ্ধযাত্রায় মনস্থির করে ফেললেন সেলিম খান। পীরে মেহমুদ পাশার ডাক পড়ল। সুলতানের শারীরিক অবস্থার কথা বলে কিঞ্চিত আপত্তির চেষ্টা করলেন উজিরে আজম। কিন্তু কাজ হলো না।

হাঙ্গেরি অভিযানের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিলেন সেলিম খান। অটোমান সেনাদের মধ্যে হৈহৈ রোল পড়ে গেল।

খবরটা যখন সুলতানের স্ত্রী আয়শার কানে পৌঁছালো, তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। পুরো প্রক্রিয়ায় বাদ সাধতে চাইলেন সুলতানা। তিনি কিছুতেই যুদ্ধে যেতে দেবেন না সুলতানকে। সচরাচর সুলতানের সামনে সবাই সবকিছু বিনা বাক্য বেয়ে মেনে নেয়। এমনকি আয়শাও স্বামীকে সুলতান হিসেবে অনেক সম্মান করেন। বলা চলে সম্মান করতে বাধ্য। এটাই এখানকার নিয়ম। কিন্তু এবারের বিষয়টা যুদ্ধ কিংবা অটোমান সুলতানের শৌর্য-বীর্যের নয়। বিষয়টা একেবারেই ব্যক্তিগত। আয়শা জানেন তার স্বামী কতটা অসুস্থ। কদিন আগেও বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পর্যন্ত ছিল না তার। এখন খানিকটা সুস্থ হলেও সুলতানকে পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত বলা যায় না। এখন যেখানে বিশ্রাম নিয়ে আরোগ্য লাভের উপায় খোঁজা দরকার, সেখানে তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন যুদ্ধযাত্রায়! আয়শা কেন? জগতের কোনো স্ত্রীর পক্ষেই এটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সুলতান সেলিম ভয়াবহ একগুঁয়ে এবং নাছোড়বান্দা। একবার মুখে যে কথা বলে দিয়েছেন, তার কোনো হেরফের তিনি করবেন না কিছুতেই। এতে যদি প্রাণও যায়, তাতেও কিছু আসে যায় না তার।

প্রয়োজনে সুলেমানকে আনিয়ে যুদ্ধে পাঠানোর প্রস্তাব করলেন আয়শা হাফসা। কিন্তু এতেও রাজি হলেন না সেলিম খান। তিনি কিছুতেই সুলেমানকে এখানে আনতে চান না। তার কথা হলো সময় হলেই এখানে পৌঁছে যাবে সুলেমান। আর সেটা কোনোভাবেই সেলিম খানের জীবদ্দশায় নয়। সুলতানের যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে যখন কোনোমতেই পাল্টানো গেল না, তখন আয়শাকেই হার মানতে হলো। যখন কোনো কিছুতেই রাজি হলেন না, তখন হেকিম হালিমের নেসা আর মালিদ আগাকে ডেকে পাঠানো হলো। এই দুজন এসেও তাদের প্রিয় সুলতানকে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার কথা বলল। কারণ সুলতানের যে রোগ, ঘোড়ায় চড়ে বেড়ালে সেই রোগটি আরেকবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। তখন সেটাকে নিন্ত্রণ করা আরও কঠিন হবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সেলিম খান তার সিদ্ধান্তে অটল। সেলিম খানের একগুঁয়েমির কাছে হার মানল সবাই। কোনো বিকল্প নেই। যুদ্ধ হবেই। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার করলেন সেলিম খান। স্ত্রীকে কথা দিলেন হাঙ্গেরি অভিযানই হবে তার জীবনের শেষ অভিযান। এরপর তিনি অবসর নেবেন। বিরাট আয়োজনে পুত্র সুলেমানের হাতে তুলে দেবেন অটোমান সাম্রাজ্যের পতাকা!

যেহেতু যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্তে সুলতান অটল, সেহেতু আর আপত্তি করে লাভ নেই। তাই স্বয়ং আয়শা হাফসাও ব্যস্ত হয়ে উঠলেন সুলতানকে প্রস্তুত করতে। দুই হেকিমের নেতৃত্বে সুলতানের জন্য দুদিন ধরে বিশেষ ধরনের ওষুধ তৈরি হলো। সুলতান সেলিম খান ও পীরে মেহমুদ পাশাকে ওষুধ সেবন ও ব্যবহারের নিয়ম কানুন ভালো মতো বুঝিয়ে দেওয়া হলো। এরপর এলো সেই মুহূর্ত। লক্ষ্য এবার হাঙ্গেরি। রাজা লুইয়ের পতনের প্রার্থনায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল কনস্টান্টিনোপলের আপার জনসাধারণ। সারা রাজ্যজুড়ে ধুমধামের সঙ্গে সুলতান ও অটোমান সেনাদের বিদায় জানানো হলো। সবার প্রার্থনা একটাই— হাঙ্গেরি অভিযানেও যেন সমুন্নত থাকে অটোমান সালতানাতের পতাকা।

রাতের কিনার পৌঁছে গেছে ভোরের কোলে।

মানিসার অন্দরে অন্দরে তখন আরও একটি নতুন ভোরের প্রতীক্ষা।

যুবরাজ সুলেমানের চোখে ঘুম নেই। কী যেন হয়েছে। স্যাক্সোনার সঙ্গ পর্যন্ত ভালো লাগছে না। পাশেই শুয়ে আছে মেয়েটা। ঘুমুচ্ছে অঘোরে। অথচ দুই চোখের পাতা কিছুতেই এক হচ্ছে না সুলেমানের। মনের ভিতর চিন্তার ঢেউ খেলে যাচ্ছে।

সন্ধ্যার পরপরই হারেমে চলে এসেছে। ভেবেছে অস্থিরতা হয়তোবা কেটে যাবে। কিন্তু কোথায় কী! এখানে আসার পরও স্বস্তির কোনো দেখা নেই। এত আযোজন করে-এত কাছে এলো মেয়েটা! অথচ ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখল না সুলেমান। আনমনে বসে সুলেমান যখন এটা-ওটা ভাবছিল, স্যাক্সোনা তখন ঝিমুচ্ছিল। পরে সুলেমানই বলেছে ঘুমিয়ে পড়তে।

পাশ ফিরে স্যাক্সোনার দিকে তাকালো সুলেমান। যুবরাজের কক্ষে ঢোকার আগে যে জৌলুসপূর্ণ পোশাক দেওয়া হয়েছিল সেটা গায়েই ঘুমুচ্ছে সে।

সালতানাতের ঐতিহ্য আর ঐশ্বর্য মাঝে মাঝে আনমনে করে দেয় সুলেমানকে। বছরের পর বছর চলে আসা অনেক রীতিই তার কাছে অর্থহীন-যান্ত্রিক মনে হয়। আবার অনেক ভাবাভাবির পর একটা না একটা তাত্পর্য ঠিক মাথায় চলে আসে। আজ যেমন মাহিদেভরানের সঙ্গে মেজাজ খারাপ হলো। পারগালি সেটা টের পেয়েই সুলেমানকে হারেমের এই ঘরে নিয়ে এসেছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই স্যাক্সেনাকে সাজিয়ে নিয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে হারেমের এই নিয়মটাকে বড্ড অনৈতিক মনে হয় সুলেমানের। আবার পরক্ষণেই ভাবনাগুলো পাল্টে যায়। চারদিকে কত্তো কত্তো দাস-দাসী নির্যাতিত হচ্ছে! সে তুলনায় হারেমের মেয়েগুলোকে দারুণ সুখীই বলা যায়। এখানকার মেয়েদের হারেমের ভিতর যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গে রাখা হয়। সুলেমানের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে তাদের গুরুত্বও দেওয়া হয় প্রচণ্ড। এটা তাদের জন্য ভালোই হওয়ার কথা। একই নিয়ম মানা হয় অটোমান রাজধানীতে সুলতানের হারেমের ক্ষেত্রে। নিজেদের ভোগ বিলাসের বিষয়টিও মাঝে মাঝে পোড়ায় সুলেমানকে। কিন্তু সালতানাতের সংস্কৃতি এই পোড়ানোটাকে সমর্থন করে না। রাজরক্তের আর সালতানাতের ঐশ্বর্যের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে এই হারেম সংস্কৃতি। এরপরও সুলেমান রক্ত মাংসের মানুষ। মানুষ বলেই তার মধ্যে যেমন কামোত্তেজনা আছে, তেমনি ভালো-মন্দ পার্থক্য করার ভাবনাটাও আছে।

আজকের কথাই ধরা যাক। আজ কিন্তু সুলেমান এখানে আসতে চাননি। পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করেছে। স্যাক্সোনার সঙ্গে হারেমে থাকার পেছনে দায়ী মূলত মাহিদেভরান। ছোট্টো একটা বিষয় নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে এমন মনোমালিন্য হওয়াটা কিছুতেই মানতে পারেননি সুলেমান। প্রচণ্ড বিরক্ত হয়েছেন। ছুটে এসেছেন হারেমে। হারেম নিয়ে পারগালি ইবরাহীমের একটা কথা খুব পছন্দ হয়েছে সুলেমানের। পারগালিকে একবার সুলেমান জিজ্ঞেস করেছিলেন— ‘আচ্ছা পারগালি এই যে অটোমান হারেমের প্রচলন। এখানকার শীর্ষকর্তাদের ভোগ বিলাস, এটাকে তুমি কীভাবে দেখ? নির্ভয়ে বলতে পার।’ পারগালি ইবরাহীম তখন সুলেমানকে বলেছিলেন- ‘যুবরাজ.. একেকটা মানুষের জীবন একেক রকম। প্রত্যেকের ন্যায় অন্যায় নিরূপণ করে তার কর্মফল। আর আপনি যে বিষয়টা বলেছেন সেটা অটোমান শুধু নয় প্রাচ্যেও প্রচলন রয়েছে। আমি মনে করি একজন রাজকীয় ব্যক্তির জীবনাচরণের সঙ্গে একজন সাধারণ মানুষের জীবনের পার্থক্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক। একজন সুলতান যখন ক্ষমতার শীর্ষে থাকেন তখন তিনি তার রাজ্য ও জনগণের জন্য কাজ করেন। এমনকি তাদের জন্য নিজের জীবনকেও বিপন্ন করেন। যুদ্ধযাত্রায় সব সময় নিশ্চিত মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। এত দায়িত্ব অনিশ্চয়তা আর ব্যস্ততার মাঝে মধ্যে একটু-আধটু নারীসঙ্গের ব্যবস্থা থাকে। তার চেয়েও বড় বিষয় এই নারীদের জন্যও সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা থাকে। দাসী হিসেবে অন্য কোথাও গেলে কিন্তু তাদের ভাগ্য অনেক বেশি খারাপ হতো। সব মিলিয়ে আমি এতে দোষের কিছু দেখি না। ’

ইবরাহীমের উত্তর সুলেমানের পছন্দ হলেও ব্যাপারটা কেমন যেন পোড়ায়। আজও যেমন স্যাক্সোনাকে ডেকে গল্প করে

রাতটা কাটিয়ে দিল। অথচ স্যাক্সোনা এসেছিল সুলেমানের সেবার জন্য।

সকাল হয়ে এসেছে প্রায়। তবু ঘুম আসছে না। বাবার কথা খুব মনে পড়ছে। এবারও তাকে ছাড়াই যুদ্ধে চলে গেছেন তিনি। এবার লক্ষ্য আরও বড়। শক্তিশালী হাঙ্গেরি। সুলেমানের খুব ইচ্ছে ছিল বাবার সঙ্গে যাবে। কিন্তু হুট করেই রওনা করেছে অটোমান বাহিনী। এবার মানিসা ও আশপাশের এলাকা থেকে সৈন্য নেয়ার জন্যও আসেনি কেউ। সম্ভবত সুলেমানকে জানাতে চাননি সেলিম খান। হাঙ্গেরি অভিযানের খবর যখন সুলেমানের কানে এসেছে ততক্ষণে সপ্তাহখানেক পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে সুলেমান রাজধানী থেকে ঘুরে এসেছেন। মা আয়শা হাফসা আর ছোটবোন হেতিজার সঙ্গে গোটা একটি দিন কাটিয়ে এসেছেন। এরপরও কনস্টান্টিনোপল থেকে আসার পর থেকেই কেমন যেন উদাস উদাস লাগছে। ছোটবেলা থেকেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করেছে সুলেমান। যখনই তার জীবনে বড় কোনো ঘটনা ঘটে তখনই আগে থেকে কীভাবে যেন টের পেয়ে যান তিনি। আজকের অস্থিরতা সত্যি ভাবিয়ে তুলল তাকে। বাবার কোনো বিপদ হলো না তো আবার?

সব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুম নেমে এসেছে টের পাননি সুলেমান। ঘুম ভাঙল ইবরাহীমের কণ্ঠ শুনে। এই ঘরে এভাবে সুলেমানের ঘুম ভাঙানোর কথা নয়। নিশ্চয়ই কোনো বিপদ হয়েছে। ইবরাহীম কুর্নিশ করে অভিবাদন জানাল সুলেমানকে।

‘যুবরাজ। ক্ষমা করবেন, এভাবে আপনার ঘুম ভাঙানোর জন্য।’

‘কী হয়েছে ইবরাহীম। কোনো দুঃসংবাদ।’

‘মাফ করবেন। আমি এখনো কিছু জানি না। কনস্টান্টিনোপল থেকে সার্বা সালেকিন এসেছেন। বলেছেন— পীরে মেহমুদ পাশার বার্তা। ভীষণ জরুরি। সে কারণেই আপনাকে ডেকে তুললাম। আচ্ছা আমি আসছি। সালেকিনকে অপেক্ষা করতে বল।’

সুলেমানের কপালে স্পষ্ট চিন্তার ভাঁজ দেখা গেল। তার ওপর নির্ঘুম রাত যাপন। কে জানে কী সংবাদ অপেক্ষা করছে?

সালেকিনের সামনে জলখাবার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এক গ্লাস পানি ছাড়া আর কিছুই স্পর্শ করল না সে। যুবরাজ সেলিম আসতেই উঠে দাঁড়াল।

‘যুবরাজ। উজিরে আজম পীরে মেহমুদ পাশা আপনার জন্য জরুরি বার্তা পাঠিয়েছেন।’

সুলেমান বার্তা হাতে নিলেন। মুখ দিয়ে একটা শব্দও করলেন না। চিঠিতে স্পষ্ট লেখা—

‘যুবরাজ,

সালাম জানবেন।

অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, মহামান্য সেলিম খান গত ২২ সেপ্টেম্বর রাতে পূর্ব থ্রাস শহরের কাছাকাছি করলু সেনা আস্তানায় ইন্তেকাল করেছেন। মহান আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন।

মহামান্য সুলেমান খান যেন দ্রুত রাজধানীতে চলে আসেন এবং তার দায়িত্ব বুঝে নেন। তাকে এই অনুরোধ জানিয়েছেন আয়শা হাফসা সুলতান।’

— উজিরে আজম পীরে মেহমুদ পাশা

সুলেমানের দুই চোখ বেয়ে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ইবরাহীম প্রশ্নাতুর চোখে তাকিয়ে রইলেন। সুলেমানের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বার্তাটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলেন সুলেমান।

পারগালি ইবরাহীম দ্রুত সেটিতে চোখ বুলিয়ে নিলেন। ঝটপট সুলতানের জান্নাত কামনায় মোনাজাত করলেন ছোট্ট করে। এরপর পাশেই রাখা একটা তলোয়ার হাতে নিলেন পারগালি ইবরাহীম। তারপর হাঁটু গেড়ে সুলেমানের সামনে সেই তলোয়ার নিবেদন করে বলে উঠলেন

‘আমার মালিক আমার প্রিয় যুবরাজ অটোমান সাম্রাজ্য আপনার পদধূলির আশায় পথ চেয়ে বসে আছে। সুলতান সুলেমান খানের জয় হোক।’

এভাবে হুট করে সব ঘটে যাবে একদমই ভাবেননি সুলেমান। তবে ইবরাহিমের উপস্থিত বুদ্ধি ছুঁয়ে গেল সুলেমানকে। পারগালির হাত থেকে তলোয়ার গ্রহণ করলেন। তারপর সেই তলোয়ার উঁচিয়ে দৃঢ়চিত্তে ঘোষণা করলেন—

‘মহান আল্লাহ সুলতান সেলিম খানকে বেহেশত নসিব করুন। অটোমানদের ন্যায়বিচার আর শক্তি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন আমি যেন সে স্বপ্ন পূরণ করতে পারি।’

সবাই সমস্বরে ‘আমিন’ বলে উঠল। সেই সঙ্গে নতুন অটোমান সুলতানকে কুর্নিশ করার মাধ্যমে বরণ করে নিল।

সুলেমান পারগালিকে নির্দেশ দিলেন দ্রুত রাজধানীর দিকে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে।

সার্বা সালেকিনের কাছ থেকে মায়ের খোঁজ নিলেন সুলেমান। সালেকিন জানালেন আয়শা হাফসা থার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। তবে তিনি ভেঙে পড়েননি মোটেই। সব ভালোই সামাল দিচ্ছেন। মায়ের জন্যএকটু খারাপ লাগছে সুলেমানের। বাবার অসুস্থতার সময় থেকেই মা নিজের অসহায়ত্বের কথা বারবার বলছিলেন। সুলেমান নিজেও তার মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য উতলা হয়ে উঠলেন।

সুলতানের মৃত্যু ভারী করে তুলেছিল কনস্টান্টিনোপলের বাতাস। এর মধ্যেই একদল মানুষ নতুন সুলতান সুলেমান খানকে বরণ করে নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। সিংহাসনের একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে রাজধানীতে পা রাখতে চলেছেন সুলেমান খান।

১৪৯৪ সালে ট্রাবজনে জন্ম নেওয়া সুলেমানের তিনভাই ওরহান, মুসা আর কুরকুট মারা গেছেন মহামারীতে। তাই সে-ই এখন একচ্ছত্র উত্তরাধিকারী। সুলতান সেলিম খানের জীবদ্দশাতেও উত্তরাধিকারী হিসেবে সুলেমানকেই নির্বাচিত করে গেছেন।

সুলেমানের আরেক ভাই রাফায়েল উত্তরের রাজ্যে বনবাসে আছে। ছোটবেলা থেকেই শিক্ষা-দীক্ষা, প্রজ্ঞা, ন্যায়বিচার আর বীর হিসেবে নিজের আলাদা একটি পরিচয় গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন সুলেমান। একদিকে তার যেমন সম্রাটসুলভ পুরুষত্ব ছিল তেমনি তার মনের ভিতর বসবাস করে একজন নরম মানুষ। কবিতা লেখার অভ্যাস তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তুলেছে। সুলেমান উসমানীয় তুর্কি ভাষাসহ আরও পাঁচটি ভিন্ন ভাষা জানেন। আরবি ভাষা, সার্বীয়, ফার্সি, উর্দু এবং তুর্কি চাগাতাই ভাষা জানতেন সুলেমান। সুলেমানের এসব গুণের কথা দিনের পর দিন সাধারণ অটোমানদের মধ্যে চর্চা হয়ে এসেছে। তাই আজ যখন অটোমান অধিকর্তা হিসেবে তিনি কনস্টান্টিনোপলে পা রাখতে চলেছেন, তখন তার গুণমুগ্ধ অনেক সমর্থকই খুঁজে পাওয়া গেল। অবশ্য দুয়েকজন ঈর্ষাপরায়ণ মানুষ যে বিরোধিতা করার চেষ্টা করছে না তা কিন্তু নয়। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি সুলেমানের অনুকূলেই ছিল। তাই রাজধানীতে পৌঁছামাত্র বিপুল করতালি, হর্ষধ্বনি আর পুষ্পরাজির মাধ্যমে তাকে অভিবাদন জানালো সাধারণ তুর্কিরা। এসবে মনোনিবেশ না করে সোজা হারেমের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি।

পথে যেতে নামি অনেকের সঙ্গেই দেখা হলো। সবাই পরম শ্রদ্ধায় কুর্নিশ করল নতুন অটোমান অধিকর্তাকে। সুলেমান এর আগেও তোপকাপি প্রাসাদে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এমন শ্রদ্ধার সাক্ষী বহুবার হয়েছেন তিনি। কিন্তু আজ যেন একেবারেই অন্যরকম লাগছে। মানসিকভাবে প্রচণ্ড শক্তি অনুভব করছেন। আর সবার আচরণেও কেমন যেন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার উত্তাপ। সুলেমানও সবার অভিবাদন-অভিনন্দন গ্রহণ করতে করতে এগিয়ে গেলেন মায়ের কক্ষের দিকে।

সুলেমানের আসার সংবাদ পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন আয়শা হাফসা। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন পুত্রকে। সুলেমান মায়ের কাফতান আর হাতে চুমু খেয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করলেন।

‘আমার বীর পুত্র, আমার কলিজা সুলেমান। তোমার বাবার অধরা স্বপ্ন তোমাকেই পূরণ করতে হবে। তুমিই এখন মহান অটোমান সুলতান। তোমার দিকে তাকিয়ে এই সাম্রাজ্যের সব জনগণ।’

‘মা আমার জন্য দোয়া করবেন। আর আপনি আমার পাশে থাকলে আমি সব করতে পারব।’

‘আমি জানি আমার সিংহ সন্তান। তুমি পারবে।’

বলেই সুলেমানের মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিলেন আয়শা। এখন তিনি আর সুলতানা নেই। এখন তিনি বালিদ সুলতান। মহান অটোমান সুলতানের মাতা। সুলতানের সমান ক্ষমতা নিয়ে রাজ্য শাসনে তারও অনেক ভূমিকা রাখতে হবে। মনজিলার দিকে তাকিয়ে কী যেন ইশারা করলেন আয়শা। মনজিলা বুঝতে পারল না। আয়শা মুখ খুললেন— ‘আমার ছেলের নতুন কাফতান তৈরি তো? মনজিলা? নিয়ে এসো।’ ‘জি তৈরি। আমি এখনই নিয়ে আসছি।’

‘আমি নিজে তোমার কাফতান তৈরির ব্যাপারটি তদারকি করেছি। আশা করছি তোমার পছন্দ হবে।’ সুলেমানের দিকে তাকিয়ে বললেন আয়শা।

‘অবশ্যই মা। আপনার পছন্দ আমার অবশ্যই পছন্দ হবে।

ততক্ষণে জলখাবার চলে এসেছে। সুলেমান হাত-মুখ ধুয়ে এসে বসেছেন মায়ের পাশে। জলখাবার নেওয়ার পর কাফতান পরিয়ে দেওয়া হলো সুলেমানকে। পরম মমতায় চোখের ভিতর সুরমা পরিয়ে দিলেন আয়শা হাফসা। বিশেষ সুগন্ধি দেওয়া হলো। সুবাসটা দারুণ পছন্দ হলো সুলেমানের। নিজ হাতে পুত্রকে পাগড়ি পরিয়ে দিলেন আয়শা। এরপর আয়নার সামনে দাঁড় করানো হলো সুলেমানকে। মুগ্ধচিত্তে পুত্রের দিকে তাকিয়ে রইলেন আয়শা। মায়ের দিকে তাকিয়ে সুলেমান বললেন— ‘কী দেখছেন মা? এমন করে?’

 ‘দেখছি কতটা সুন্দর দেখাচ্ছে আমার ছেলেকে। অটোমান সম্রাট হিসেবে কী দারুণ মানিয়েছে!’ সুলেমান বোধ হয় খানিক লজ্জা পেলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন—

‘আমার ওপর আপনার দোয়ার ছায়া রাখবেন সব সময় তাহলেই আমি আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে পারব।’

‘নিশ্চয়ই। যাও সুলেমান— দরবারে চলে যাও। পীরে মেহমুদ পাশার নেতৃত্বে ফেরাত পাশা-কাপ্তান ই দরিয়াসহ সব সভাসদ তোমার অপেক্ষায়। তোমার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে অটোমান সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে সফল করবেন ইনশা আল্লাহ।’

‘ইনশা আল্লাহ।’ মায়ের মুখের শেষ কথাটুকু নিজের মুখে ধরে এগিয়ে গেলেন সুলেমান। সামনে তার অনেক কাজ। অনেক বড় দায়িত্ব। এবার নিজেকে এগিয়ে নেওয়ার পালা। নিজের চোয়াল শক্ত করে দরবারের দিকে পা বাড়ালেন সুলেমান খান। সব বুঝেশুনে বাবার স্বপ্ন আর নিজের স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে।

চলবে... পরবর্তী পর্ব আগামী শনিবার

সর্বশেষ খবর