২৭ অক্টোবর, ২০১৫ ১০:৪৫

বাঘের সঙ্গে বনও বেড়াতে চলে যাচ্ছে

ডক্টর তুহিন মালিক

বাঘের সঙ্গে বনও বেড়াতে চলে যাচ্ছে

এক. কিছু দিন আগে আমাদের বনমন্ত্রী দারুণ একটা কথা বলেছিলেন যে, ‘সুন্দরবনের বাঘরা পশ্চিমবঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার কারণে বাঘের সংখ্যা কমে গেছে’। কিন্তু এবার সত্যি সত্যিই বাঘের সঙ্গে খোদ সুন্দরবনকেও আমরা হারাতে চলেছি। কারণ বিশেষজ্ঞদের মতে, সুন্দরবনের রামপালে নির্মাণাধীন ভারত-বাংলাদেশ কয়লাভিত্তিক যৌথ বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে তা হবে বিশ্বের ইতিহাসে ভয়ঙ্কর একটি পরিবেশধ্বংসী প্রকল্প। রামপালের এই পরিবেশবিধ্বংসী বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউনেস্কো ও রামসার। ভারতের এ প্রকল্পে যুক্ত থাকার  কারণে নরওয়ে ভারতের এনটিপিসিতে অর্থ জোগান বন্ধ করে দিয়েছে। বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ব্যাংকও এ প্রকল্পে টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। বিশ্ব পরিবেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এর জোর প্রতিবাদ ও নিন্দা করলেও দেশের ভিতর সুন্দরবনকে রক্ষার সব দায়িত্ব আমরা যেন আনু মুহাম্মদদের স্কন্ধে চাপিয়ে দিয়েই নিশ্চিন্তে ঘরে বসে আছি। তারা সুন্দরবন রক্ষার জন্য একের পর এক রোডমার্চ করে যাচ্ছেন। আবার পুলিশ এসে সমানে পেটাচ্ছে তাদের। এ সুযোগে দেশি লুটেরারাও সুন্দরবনের জমি দখলের মহোৎসবে ব্যস্ত। ভারত ব্যস্ত সুন্দরবনকে ঘিরে তাদের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির কাজে। সরকার ব্যস্ত ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার স্বার্থে সরকারের যেন পরিবেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার কোনো প্রয়োজনই নেই! আমাদের প্রধানমন্ত্রী পরিবেশের পুরস্কার হাতে নিয়ে সুন্দরবনের বিপর্যয় দেখছেন কীভাবে?

দুই. বিশ্বের কোথাও সংরক্ষিত বনভূমি ও বসতির ১৫ থেকে ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয় না। অথচ ভারতীয় কোম্পানি আমাদের সুন্দরবনের ৯-১৪ কিলোমিটারের মধ্যেই এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। আর বাফার জোন বিবেচনা করলে তো এ দূরত্ব মাত্র চার কিলোমিটারের মধ্যে। অপরদিকে ভারতের নিজেদের বনভূমি ও পরিবেশ সংরক্ষণে রয়েছে শক্ত আইনকানুন। ভারতের ‘বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন ১৯৭২’, পরিবেশের গাইডলাইন ম্যানুয়াল ২০১০ এবং ‘তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত গাইডলাইন ১৯৮৭’ অনুযায়ী সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা যায় না। এ কারণে ভারতের তিনটি রাজ্যে গত কয়েক বছরে তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। আর ভারতীয় কোম্পানি কোথাও এটা করতে না পেরে বাংলাদেশের সুন্দরবনকে বেছে নিয়েছে। ভারতের অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে এ প্রকল্পের কাছেই। সে দেশের হাইকমিশনারকে বলতে শোনা যায়, ‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে পরিবেশবান্ধব’। অথচ গত ১৩ মার্চ ভারতের গ্রিন ট্রাইব্যুনাল কর্ণাটক রাজ্যে এনটিপিসির প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাড়পত্র স্থগিত করে দিয়েছে। ভারতীয় কোম্পানির এসব গুরুতর জালিয়াতির কথা জেনেও বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ভারতের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের এ বিতর্কিত প্রকল্পটিকে ‘অগ্রাধিকার’ প্রকল্প হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। আরও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এর মধ্যে আমাদের মন্ত্রিসভা সুন্দরবনের রামপালে আরও একটি বিদ্যুৎ প্রকল্পের অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে।

তিন. জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা ইউনেস্কো যেখানে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেখানে ভারত-বাংলাদেশের এ যৌথ বিদ্যুৎকেন্দ্র শুধু আন্তর্জাতিক পরিবেশ আইনকেই লঙ্ঘন করেনি, বরং গোটা বিশ্ব মানবসত্তার ১৯৪৮ সালের সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রের প্রতিও চরম অবজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তাছাড়া এ প্রকল্পটি ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় চুক্তিরও ভয়াবহ লঙ্ঘন। কেননা দুই দেশের মধ্যে সুন্দরবন এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগার রক্ষার চুক্তি এখনো বিদ্যমান রয়েছে। অথচ সুন্দরবনের বুক চিরে দশটি খাল ভরাট করে এবং প্রায় দুই হাজার একর কৃষিজমি ধ্বংস করে প্রাণঘাতী এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ চলছে। এ প্রকল্পে আট হাজার পরিবার উচ্ছেদ হয়ে সম্পূর্ণ উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবন থেকে কমপক্ষে ২০ কিলোমিটার দূরে এ ধরনের প্রকল্প নির্মাণ করতে হবে। ভারত তার নিজ ভূমিতে মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক ও তামিলনাড়ুতে এ ধরনের বিদ্যুৎ প্রকল্পকে নিজ দেশের পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে বাতিল করলেও বাংলাদেশের সুন্দরবন রক্ষায় তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। ভারতের পরিবেশ মন্ত্রণালয় মধ্যপ্রদেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রস্তাবিত স্থানকে কৃষিজমির জন্য বিপজ্জনক বিধায় পুরো প্রকল্পটিই বাতিল করে দিয়েছে। তারা নর্মদা নদী থেকে প্রকল্পের জন্য ৩২ কিউসেক পানি উত্তোলনকে অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে। আর এদিকে তারা আমাদের সবক দিয়ে বলছে রামপাল হবে পরিবেশবান্ধব। অথচ এ প্রকল্পের প্রায় আট বিলিয়ন গ্যালন পানির পুরোটাই নেওয়া হবে আমাদের পশুর নদী থেকে। আমাদের পশুর নদী মিঠা ও নোনা পানির ভারসাম্য বজায় রেখে সুন্দরবনকে বঁক্ষাঁচিয়ে রেখেছে। রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে পশুর নদী থেকে প্রতি ঘণ্টায় ৯১৫০ ঘনমিটার করে পানি প্রত্যাহার করতে হবে। এসব জেনেও ভারতীয়দের আর্থিকভাবে অধিক লাভবানের এ অন্যায় আবদারকে আমরা কেন নির্দ্বিধায় মাথা পেতে নিচ্ছি তা কেবল আমাদের সরকারই জানে!

চার. রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে যে শুধু সুন্দরবনের পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য ধ্বংস হবে তা নয়। এতে করে জীববৈচিত্র্য, কৃষিজমি, বনভূমি, জলাশয় এবং বন্যপ্রাণী ধ্বংসসহ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত বিষাক্ত বর্জ্য ও রাসায়নিকে ভয়াবহ বিপর্যস্ত হবে গোটা অঞ্চল। ভস্মীভূত কয়লার ছাই আর উৎপন্ন গ্যাসের কারণে বায়ু ও পানিদূষণে প্রকল্প অঞ্চলের আশপাশে এসিড বৃষ্টি হওয়ার প্রবল আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। অথচ আমরা কেন ভুলে যাই যে, ভারত বাংলাদেশের সুসম্পর্কের চেয়ে বাঁচার জন্য পরিবেশের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক রাখাটাই বেশি প্রয়োজন। যেখানে এ প্রকল্পের ১৫% অর্থায়ন করবে পিডিবি, ১৫% ভারতীয় পক্ষ, আর বাকি ৭০% ঋণ নেওয়া হবে। অথচ লাভের বেলায় ভারত নিয়ে যাবে ৫০% হারে, তাও আবার বিনা শুল্কে, কোনো ট্যাক্স খাজনা না দিয়ে। অথচ এ ১৫% টাকা আমাদের প্রবাসীরা অনায়াসে মাত্র দুই দিনেই তহবিলে জমা দিতে পারে।

পাঁচ. পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন সারা জীবন সিডর-আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে মোকাবিলা করে আসছে। আর আজ আমরা নিজেরাই সুন্দরবনকে ক্ষতবিক্ষত করতে কার্পণ্য করছি না, বন্ধুত্ব রক্ষার স্বার্থে! বৈশ্বিক ঊষ্ণতায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্র বাংলাদেশ আজ যে আত্মঘাতী কাজে হাত দিয়েছে তাতে ভবিষ্যতে আইলা-সিডরের মতো বিপর্যয়ে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারাবে নিঃসন্দেহে। যেখানে গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৮৫ লাখ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে, সেখানে কী করে ছাড়পত্র দিতে পারে আমাদের পরিবেশ অধিদফতর? পিডিবি নাকি প্রয়োজনে আরেকটি সুন্দরবন তৈরি করে দিতে পারবে বলে আশ্বস্ত করেছে পরিবেশ অধিদফতরকে! কার স্বার্থে এসব যুক্তি, কার স্বার্থে এসব তর্ক? কাকে খুশি করতে এসব উদ্ভট প্রতিবেদন আর ছাড়পত্র দিচ্ছি আমরা? অবিবেচকের মতো কেন কাজ করছি আমরা? সুন্দরবন ধ্বংস হলে আর বৃক্ষ না থাকলে মরুর শূন্যতায় পড়বে দেশ। খুব শিগগিরই হয়তো আমরা চলে যাব সমুদ্রতলে। তাই দেশে যদি সম্পূর্ণ ফ্রি বিদ্যুতের ব্যবস্থাও করা হয়, তবুও তা সুন্দরবনকে ধ্বংস করে নয়।

ছয়. রামপালের বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশকে এক মারাত্মক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। অথচ আমাদের রাজনৈতিক দল, মিডিয়া ও সুশীল সমাজ এ ব্যাপারে একেবারেই নিশ্চুপ। সম্প্রতি নেপালের ভারতবিরোধী অবস্থানের সংবাদগুলো যেমন আমাদের মিডিয়ার আলোচনায় অনুপস্থিত, ঠিক তেমনি সুন্দরবনের ধ্বংসের খবরগুলোও আজ আমাদের কাছে সমান অনুপস্থিত। কিন্তু আমাদের প্রতিবাদ তো ভারত বা অন্য কোনো রাষ্ট্রের বিপক্ষে নয়। এটা জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত অতি গুরুত্বপূর্র্ণ জাতীয় একটি ইস্যু। অথচ ভারত-বিরোধিতার ধুয়া তুলে এ জাতীয় স্বার্থকে প্রতিহত করে দমননীতি চালানো কোথাকার দেশপ্রেমের পরিচায়ক? সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিকটি হচ্ছে, সুন্দরবনকে বাঁচানোর জন্য আমাদের কারও কোনো রাজনীতির অঙ্গীকার তো দূরে থাক, বরং জাতীয় ঐক্য ও সংহতির মারাত্মক এক বিপর্যয় ঘটে গেছে জাতীয় জীবনে। সুন্দরবন ধ্বংস করে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন কেন অবৈধ নয় মর্মে গত বছর সরকারের বিরুদ্ধে রুল জারি করেছিলেন আমাদের হাইকোর্ট। অথচ এতদিন পরেও উচ্চ আদালত পর্যন্ত কেন সুন্দরবনকে আর বাঁচাতে পারছে না? সুন্দরবন নিজে কথা বলতে পারে না। তাই বলে কি সুন্দরবনের মতো আমরাও বোবা হয়ে গেছি? বিদ্যুৎকেন্দ্র আরেকটা করা যাবে, কিন্তু সুন্দরবন তো আরেকটা করা যাবে না।  বনমন্ত্রী হয়তো অর্ধেকটা কথাই বলেছেন যে, সুন্দরবনের বাঘরা পশ্চিমবঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার কারণে বাঘের সংখ্যা কমে গেছে।  কিন্তু এবার বাঘের সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরবনও যেন ভিনদেশে বেড়াতে চলে গেছে, বাকি অর্ধেকটা পূরণ করে দিচ্ছে।  তবে বাঘ ফিরে এলেও সুন্দরবনের ফিরে আসার কিন্তু কোনো সম্ভাবনা নেই।

লেখক : আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ।

ই-মেইল : [email protected]


বিডি-প্রতিদিন/ ২৭ অক্টোবর, ২০১৫/ রশিদা

সর্বশেষ খবর