৫ নভেম্বর, ২০১৫ ১৬:১২

ইয়াহিয়ার নাপিত ও পুতুল নাচের নাট্যশালা

ডক্টর তুহিন মালিক

ইয়াহিয়ার নাপিত ও পুতুল নাচের নাট্যশালা

এক. ইয়াহিয়া খানের এক নাপিত ছিল। সে ইয়াহিয়ার বাসায় এসে তার চুল কাটত। নাপিত যখনই তার চুল কাটত তখনই সে ইয়াহিয়া খানকে জিজ্ঞাসা করত, ‘নির্বাচন কবে দিবেন’? এতে চরম বিরক্ত হয়ে এডিসি নাপিতকে বলতেন, ‘তুই ব্যাটা চুল কাটার সময় এই একটা কথাই কেন বলিস?’ উত্তরে নাপিত বলত, ‘এই প্রশ্নটি করলেই স্যারের চুল রাগে খাড়া হয়ে যায়, আর তাতে করে আমার চুল কাটতে সুবিধা হয়।’ আমাদের অবস্থাও হয়েছে অনেকটা সেই রকমেরই। নির্বাচন কবে দিবেন- এ কথাটি যেই বলবে সেই হয়ে যাবে জঙ্গি, স্বাধীনতাবিরোধী। সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, বর্তমান সংসদ হচ্ছে পুতুল নাচের নাট্যশালা। দশম সংসদ নির্বাচন ছিল বিতর্কিত। সে নির্বাচনে বিরাটসংখ্যক আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তাই এ বিতর্ক এড়াতে নতুন নির্বাচন প্রয়োজন। ব্যস, এতেই আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, ‘টিআইবির প্রতিবেদন এবং আইএস-এর জঙ্গি কার্যক্রম একই সূত্রে গাঁথা’। মন্ত্রিসভার এক সিনিয়র সদস্য বলেছেন, ‘টিআইবি বিএনপির অঙ্গসংগঠন’। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও নেতারা কী করে টিআইবিকে স্বাধীনতাবিরোধী, আইএস কিংবা বিএনপির অঙ্গসংগঠন বলতে পারে? যেখানে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হচ্ছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা কবি সুফিয়া কামালের কন্যা সুলতানা কামাল। যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বলেই সবাই জানে। টিআইবির মহাসচিব হচ্ছেন সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, আর কোষাধ্যক্ষ মাহফুজ আনাম। পরিচালনা বোর্ডের সদস্য হচ্ছেন ড. তৌফিক নেওয়াজ, যিনি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দিপু মনির স্বামী। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক তিন উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান, এম হাফিজ উদ্দিন খান ও রোকেয়া আফজাল রহমানও টিআইবির বোর্ড মেম্বার। ২০০৯-এর নির্বাচনে যেখানে আওয়ামী লীগ ভূমিধস বিজয় অর্জন করেছিল, তখনকার প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদা হচ্ছেন টিআইবির আরেক সদস্য। অথচ এরা কেউই বিএনপি-জামায়াতের লোক নন। বরং এদের সঙ্গে আওয়ামী লীগেরই ঘনিষ্ঠতা রয়েছে বেশি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ২০১৩ সালে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ (বাচ্চু রাজাকার)-এর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষিত হলে এই টিআইবি তখন গভীর সন্তোষ প্রকাশ করেছিল। আবার কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশের পরিবর্তে মৃত্যুদণ্ডাদেশের দাবি জানিয়েছিল টিআইবি। গণজাগরণ মঞ্চের ব্লগার রাজীবের মৃত্যুতে নিন্দা জানায় তারা। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসিতে সন্তুষ্টি জ্ঞাপন করে টিআইবি। কিন্তু তখন তারা স্বাধীনতাবিরোধী ছিল না! আর আজকে শুধু নির্বাচন চাওয়ার কারণেই টিআইবি সরকারের চোখে স্বাধীনতাবিরোধী, আইএস জঙ্গি এবং বিএনপির অঙ্গসংগঠন হয়ে গেল?

দুই. স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, টিআইবি বিএনপি-জামায়াতের চেয়েও জঘন্য। আর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল টিআইবিকে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইতে বলেছে। তা না হলে টিআইবির বিরুদ্ধে ‘জনমত গড়ে তোলা’ ও ‘আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ বলে জানিয়েছেন জোটের নেতারা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে টিআইবির অর্থের উৎস ও পৃষ্ঠপোষকদের খুঁজে বের করার আহ্বান জানান তারা। চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ বলেছেন, ‘টিআইবি তার প্রভুদের সুতার টানে নাচে। দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের দেশীয় চক্র এ কাজ করছে।’ এ আন্তর্জাতিক মহল কারা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যারা মুক্তিযুদ্ধ থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের বিরোধিতা করে আসছে, তারাই আন্তর্জাতিক মহল।’ তার মানে চিফ হুইপের কথামতে, টিআইবি পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি!

তিন. ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর অপরাধ তারা সংবাদ সম্মেলন করে ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানায়, সংসদে সরকারি দলের প্রশংসা আর সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী জোটের নিন্দার পরিমাণ অভাবনীয়ভাবে বেড়েছে। বর্তমান দশম সংসদে ১১২ কার্যদিবসে ৭৫০০ বার নিজেদের দলের প্রশংসা করা হয়েছে। অন্যদিকে সংসদে নেই, তবুও বিএনপির সমালোচনা হয়েছে ৭২৬৮ বার। আলোচনার নির্ধারিত প্রসঙ্গের বাইরে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার অব্যাহত রয়েছে। অথচ শৃঙ্খলা রক্ষায় স্পিকার নীরব ভূমিকা পালন করেছেন। শুধু পাঁচটি অধিবেশনেই কোরাম সংকটের কারণে ৩২ কোটি ৪২ লাখ ৩১ হাজার টাকা অপচয় হয়েছে এবং ৪৮ ঘণ্টা ৪১ মিনিট সময় অপচয় হয়েছে। অথচ প্রতিটি বিল পাস হতে সময় লেগেছে মাত্র ৩০ মিনিট। সংসদের তথাকথিত বিরোধী দল দায়িত্ব পালন করছে না। সংসদের বিরোধী দল বর্তমান সরকারেরও একটি অংশ। সে কারণে বর্তমান সংসদ হয়ে পড়েছে পুতুল নাচের নাট্যশালা। টিআইবি আরও জানায়, দশম সংসদ নির্বাচন ছিল বিতর্কিত। সে নির্বাচনে বিরাটসংখ্যক আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া কার্যত নির্বাচন হয় না। যখন সরকার বিতর্কের ঊর্ধ্বে নির্বাচন দিতে পারবে তখন আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন বলতে পারব। তাই এ বিতর্ক এড়াতে নতুন নির্বাচন প্রয়োজন।

চার. এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘টিআইবি নির্বাচন চাওয়ার কে? ওবামা পর্যন্ত বাংলাদেশের তারিফ করে। টিআইবির মুখে কোনো তারিফ নেই।’ আসলে আওয়ামী লীগের যে-ই সমালোচনা করবে সে-ই ষড়যন্ত্রকারী, রাষ্ট্রবিরোধী, উসকানিদাতা, জঙ্গি, স্বাধীনতাবিরোধী ইত্যাকার বিশেষণে বিশেষিত হবেই। হোক না সেটা ব্যক্তিবিশেষ, কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা। বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক একটা প্রতিষ্ঠানকেও পর্যন্ত ‘কানে ধরে ওঠাবসা’ করার দাবি জানায় আমাদের সিনিয়র মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। অথচ একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বব্যাংক তার কোন হাত দিয়ে আর কোন কান ধরে ওঠাবসা করবে তা বোধগম্য নয়। অথচ সরকার চাচ্ছে টিআইবি শুধু সরকারেরই ‘তারিফ’ করুক, আর বিএনপির সমালোচনা করুক। তারা বিদেশি পয়সায় বিএনপির অঙ্গসংগঠন ‘টিআইবি  দল’ হিসেবে সরকারের দুর্নীতির কথাগুলো কেন বলে বেড়াবে? এর আগেও টিআইবির ২০১২ সালের রিপোর্ট প্রকাশের পর চট্টগ্রাম ও কুমিল্লাতে টিআইবির তৎকালীন চেয়ারম্যান এম হাফিজ উদ্দিন খান, নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ও সিনিয়র ফেলো ওয়াহিদ আলমের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে তখন গ্রেফতারি পরোয়ানা পর্যন্ত জারি করা হয়েছিল।

পাঁচ. ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার শেষ দিকে বাংলাদেশ বিশ্বে দুর্নীতির শীর্ষস্থান দখল করে নেয়। ওই বছর টিআইবির এমন একটি প্রতিবেদনে বিএনপি তখন ব্যাপক প্রচারণা-প্রোপাগান্ডা চালালে ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরাট পতন ঘটে। এরপর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ও বাংলাদেশ পরপর চারবার দুর্নীতিতে শীর্ষস্থান অক্ষুণ্ন রাখে। এই ইস্যুকে সামনে রেখেই আওয়ামী লীগ তখন বিএনপি সরকারকে দুর্নীতিবাজ বলে পদত্যাগ দাবি করে। তখন আওয়ামী লীগের আন্দোলনের প্রধান হাতিয়ারই ছিল টিআইবির প্রতিবেদন এবং জরিপগুলো।

অথচ আশ্চর্যজনকভাবে আওয়ামী লীগ গতবার ক্ষমতায় এসেই টিআইবির প্রায় প্রতিটি গবেষণা প্রতিবেদন ও জরিপকে শুধু বিরোধিতাই করেনি বরং তীব্র ভাষায় গালাগাল ও কটাক্ষ করে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকমের হুমকি দিয়ে চলেছে। গত নবম সংসদে টিআইবির প্রতিবেদন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে সংসদের তৎকালীন স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ পর্যন্ত কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। তখন মহাজোটের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন কুৎসিত মন্তব্য করতেও পিছপা হননি। তারা তখন টিআইবির প্রতিবেদনকে  ‘অগ্রহণযোগ্য’, ‘একতরফা, ‘বিভ্রান্তিমূলক, ‘ষড়যন্ত্র’ ও ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় বাধা’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তখনো তারা টিআইবির অর্থের উৎস খুঁজতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আসলে যখনই টিআইবি সরকারের সমালোচনা করেছে তখনই তাদের আয়ের উৎস নিয়ে তদন্ত দাবি করা হয়েছে। কিন্তু যারা দাবি করে আসছে তাদের হাতেই তো রয়েছে তদন্ত করার সব ক্ষমতা। আজ অবধি কখনো তাদের কাউকে এসব তদন্ত করতে দেখা যায়নি কেন?

ছয়. বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় টিআইবির রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে বলেছিল, ‘টিআইবি আওয়ামী লীগের দালাল’। আবার বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বলছে, ‘টিআইবি বিএনপির অঙ্গসংগঠন’। আসলে টিআইবি বিএনপি-আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে তাদের সহায়তা করে আসছে। তা ছাড়া সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি রোধে কাজ করে তারা। সরকারি সেবা খাতগুলোতে যথেচ্ছচার দুর্নীতি-অনিয়ম রোধে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করে চলেছে টিআইবি। দেশে দুর্নীতিবিরোধী একটি সামাজিক ও নাগরিক আন্দোলন সৃষ্টিতে টিআইবি মূলত বিএনপি আওয়ামী লীগ এবং অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নে একটি শক্তিশালী সিভিল সোসাইটির অংশ হিসেবেই কাজ করে, যা বিগত বিএনপি সরকারের সময় আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে। তারপর আওয়ামী সরকারের সময় বিএনপি এর সুফলও ভোগ করেছে। তাহলে তো টিআইবি শুধু আওয়ামী-বিএনপির দালাল নয়, পুরো রাষ্ট্রের যারা মালিক সেই জনগণেরও দালাল। সাত. আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, টিআইবি আবার এ সপ্তাহজুড়ে দুদকের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে সরকারি দফতরগুলোতে দুর্নীতিমুক্ত সেবা প্রদানের গণশুনানি ও তথ্যমেলা অনুষ্ঠান করছে। অথচ টিআইবির আলোচ্য প্রতিবেদনে যে ১২ দফা সুপারিশ উত্থাপন করা হয়েছে তাতে সংসদের ও সরকারের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। সংসদে অসংসদীয় আচরণ ও ভাষার ব্যবহার বন্ধ, সংসদে বিরোধী দলের যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করা, আইন প্রণয়ন কাজে এমপিদের বেশি অংশগ্রহণ করা, প্রশ্নোত্তর ও জনগুরুত্বপূর্ণ নোটিস পর্বে অধিক সময় বরাদ্দ ও অধিক সদস্যের অংশগ্রহণ, পিটিশন কমিটি কার্যকর করা, আন্তর্জাতিক চুক্তিসহ জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংসদে আলোচনার বিধান করা, সর্বোচ্চ উপস্থিতির জন্য স্বীকৃতি প্রদানের চর্চা এবং সর্বনিন্ম উপস্থিত এমপিদের নাম প্রকাশ করা ইত্যাদি এসব সুপারিশ কোনোভাবেই সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য হানিকর বলেও প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে না। টিআইবির অপরাধ শুধু ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচন, ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ঘোষণা, গৃহপালিত বিরোধী দল সম্পর্কে বলা এবং অকার্যকর একদলীয় হাস্যকর সংসদীয় ব্যবস্থার প্রতিকারে সবার অংশগ্রহণে নতুন নির্বাচনের কথা বলা।

আট. আসলে বর্তমান সংসদ থেকে শুরু করে সরকারের কোথাও কোনো প্রকার জবাবদিহিতা নেই। সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকার সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকার কথা ছিল তা আজকের বাংলাদেশে একদলীয় শাসনের কারণে চরমভাবে অনুপস্থিত। গৃহপালিত বিরোধী দল তৈরি করে তাদের আবার সরকারের মন্ত্রিত্বে অংশ দিয়ে এবং দলের প্রধানকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত বানিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রকে তামাশায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। সরকার ও সংসদের কার্যকলাপে প্রশ্ন করার কেউ তো অবশিষ্টই রইল না। সুশীল সমাজের নামে গোষ্ঠীবিশেষের চাটুকারিতায় জবাবদিহিতার বাকি সব পথকেও আজ রুদ্ধ করে দিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণের বদলে জনগণের অর্থের অপচয়, সুশাসনের নামে রাষ্ট্রীয় নির্যাতন আর দুর্নীতি অনিয়মের কথাগুলো টিআইবি তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে জনগণের সামনে তুলে ধরাতেই কি তারা স্বাধীনতাবিরোধী ও আইএস জঙ্গি হয়ে গেল? সরকারের তো জনবল বা টাকা-পয়সার কোনো অভাব নেই। তাহলে টিআইবির এ গবেষণা প্রতিবেদনকে তথ্য, প্রমাণ ও যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করে আরেকটি পাল্টা প্রতিবেদন তৈরি করে জনগণের সামনে প্রকাশ করা হোক। চূড়ান্ত বিচারে জনগণই নির্ধারণ করবে কোনটা সঠিক। সমালোচনাকে শত্রু হিসেবে দেখার অপসংস্কৃতি থেকে আমরা কবে বের হয়ে আসতে পারব? যুক্তিকে যদি যুক্তি দিয়ে মোকাবিলা করার মতো শিষ্টাচার রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায়েই অনুসৃত না হয়, তবে কিসের জন্য আমরা গণতন্ত্রের জন্য এতগুলো জীবনকে বিসর্জন দিলাম? টিআইবির প্রতিবেদন জনমতের প্রতিফলন হলে, সরকারের অস্থিরতার প্রতিফলন এত হিংস্র হবে কেন? সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যেসব ভাষা ব্যবহার করছেন আর যেভাবে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন তাতে টিআইবির প্রতিবেদনের বাইরেও আরও অনেক কিছুরই প্রমাণ জনগণ হাতেনাতেই দেখে নিল।

নয়. ২০১২ সালেও টিআইবি সংসদ সদস্যদের কর্মদক্ষতার ওপর অনুরূপ একটি গবেষণামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। নবম জাতীয় সংসদের এমপিদের মধ্যে শতকরা ৯৭ শতাংশই বিভিন্ন ‘নেতিবাচক কার্যক্রমে’ জড়িত বলে তখন জানানো হয়। এর মধ্যে ৫৩ দশমিক ৫ শতাংশ এমপি সরাসরি অপরাধে জড়িত। আর ২৪ দশমিক ১ শতাংশ এমপির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব অপরাধের মধ্যে আছে হত্যা, দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও প্রতারণা। এ ছাড়া এমপি অস্তিত্বহীন ও ভুয়া প্রকল্প বরাদ্দ, প্রশাসনিক কাজে প্রভাব বিস্তার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়ন বরাদ্দের অপব্যবহার, অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িত হওয়ায় সমর্থন, সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তার, নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্লট বরাদ্দ নেওয়াসহ বিভিন্ন নেতিবাচক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত বলে প্রতিবেদনে প্রকাশ পায়। কিন্তু এটা সত্য যে, বর্তমান সরকারের ক্ষমতাকালে আইনের শাসন ও বিচার ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাই হচ্ছে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া। এমপিদের জন্য নেই কোনো জাবাবদিহিতা। কে কাকে জবাবদিহি করবে তাও কেউ জানে না। আইনের শাসনের কথা বলা হলেও তা সরকারি দলের লোকদের জন্য একেবারেই অনুপস্থিত। ক্ষমতার শুরুতে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী দলীয় এমপিদের আমলনামা তার হাতে রয়েছে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘এখনো সময় আছে সতর্ক হয়ে যান। নিজ নিজ এলাকার দলীয় কর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করুন।’

কিন্তু সংসদ সদস্যরা কি আসলেই সতর্ক হয়েছেন? ইয়াবা সম্রাট, গডফাদার আর যত্রতত্র পিস্তল হাতে নির্বিচারে গুলি করার চরিত্রগুলো তো আজ বর্তমান এমপিদের দখলেই রয়েছে। সংসদে গান গেয়ে প্রশংসাকীর্তন করা কিংবা কবিতা আবৃত্তি করে গুণগান করা তো অহরহ হচ্ছেই। ঘি তেল সবই ঢালা হচ্ছে একদলীয় সংসদের একেকটি অধিবেশনকে সচল রাখার জন্য। এখন বাকি শুধু একজন নৃত্যশিল্পীর। এটা পুরো হলেই হয়তো ‘পুতুল নাচের নাট্যশালা’ পূরণ হয়ে যাবে। শেকসপিয়র বলেছেন, এ জগৎটাই একটা নাট্যশালা। টিআইবি পুতুল নাচের নাট্যশালা বললে এত রাগ কেন?

লেখক : সুপ্রিমকোর্টের আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ।

ই-মেইল : [email protected]

 

বিডি-প্রতিদিন/ ০৫ নভেম্বর, ২০১৫/ রশিদা

সর্বশেষ খবর