৮ নভেম্বর, ২০১৫ ১১:১০

৭ নভেম্বর ১৯৭৫: আমার প্রাণে বেঁচে যাওয়ার দিনটি

সৈকত রুশদী

৭ নভেম্বর ১৯৭৫: আমার প্রাণে বেঁচে যাওয়ার দিনটি


ঊনিশশ' পঁচাত্তর। সাত নভেম্বর। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র তখন আমি|

বনানী থেকে পায়ে হেঁটে, সকাল দশটার দিকে কলেজে যাওয়ার পথে এয়ারপোর্ট রোডে ট্যাংক, ট্রাক ভর্তি উত্তেজিত সৈনিক ও গোলাগুলির শব্দ সত্ত্বেও উত্ফুল্ল ও উত্কণ্ঠিত মানুষের স্রোত দেখলাম। কলেজে গিয়ে শুনলাম পাল্টা অভ্যুত্থানে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম নিহত হয়েছেন। তাঁর মরদেহ কলেজের কাছেই সিএমএইচ-এর মর্গে রাখা আছে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে কলেজের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি হিসেবে খালেদ মোশাররফকে কলেজের ক্যান্টিন ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করতে দেখেছি। এছাড়াও বনানীতে আমাদের পাশের বাড়িতে ভাড়াটে, তাঁর ভায়রা ভাই বিমান চালনা প্রশিক্ষককে কিউ হুদার বাসায় যেতে দেখেছি বহুবার।

সহপাঠী বন্ধু ফারুক (এনামুল হক খন্দকার) ও আরও কয়েকজন ছাত্র ঠিক করলাম খালেদ মোশাররফের মরদেহ শেষবারের মতো দেখে আসি। কলেজ থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের মূল সড়ক ধরে পায়ে হেঁটে সিএমএইচ-এ রওয়ানা হতেই দেখি দ্রুত ধাবমান জীপে করে কয়েকজন অফিসারকে হত্যার উদ্দেশ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে যাচ্ছে সৈনিকরা। সে ব্যাপারে মাইকে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে চলন্ত গাড়ি থেকে। আর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে ছোঁড়া হচ্ছে ফাঁকা গুলি। আমরা রাস্তা ছেড়ে মাঠ দিয়ে গিয়ে পৌঁছালাম মর্গে। হাসপাতালের মূল চত্বরের বাইরে। চারিদিকে প্রায় তিনফুট উঁচু দেওয়াল, তার উপরে কাঁচ ঘেরা এক ঘরের মেঝেতে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে কয়েকটি মরদেহ। তার পাশে বড় বড় বরফের ব্লক। মরদেহের উপরেও কিছু বরফের টুকরো। সশস্ত্র সৈনিকের প্রহরা। মানুষ সারি বেঁধে দেখে যাচ্ছে। নীরবে।

চিনতে পারলাম খালেদ মোশাররফের দেহের পাশেই কর্নেল নাজমুল হুদা ও কর্নেল এ টি এম হায়দারের মরদেহ। কর্নেল হুদা ও কর্নেল হায়দারকে প্রথম দেখি বাংলাদেশ টেলিভিশনে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর (অথবা ১৭ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় লাইভ অনুষ্ঠানে। পাকিস্তান সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ যে এখন সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ পরবর্তী পরিস্থিতিতে ঢাকা মহানগরীর নিরাপত্তা সম্পর্কে নেওয়া কিছু ব্যবস্থা সম্পর্কে বলেছিলেন তাঁরা ঘোষক ও উপস্থাপক সরকার ফিরোজউদ্দিনের সাথে আলাপচারিতায়।

অকুতোভয় তিন বীর মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ এইভাবে মর্গের মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। রেডিওর ঘোষণায় ও সৈনিকদের শ্লোগানে শুনেছি সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের নামে বিজয় ধ্বনি। কৌতুহলী মনের অভ্যাসবশত আমি এক সহপাঠীর কাছে নিচু কণ্ঠে জানতে চাইলাম, "খালেদ মোশাররফ তো জিয়ার বিপক্ষে ছিলেন, হুদা এবং হায়দার কী খালেদের সাথে ছিলেন, নাকি জিয়ার সাথে?"

পেছনে কেউ একজন হুঙ্কার দিয়ে উঠলো, "চুপ, কোন শব্দ করবে না। একদম শেষ করে দেবো।" পিঠে তীক্ষ্ণ কিছুর খোঁচা খেলাম। তাকিয়ে দেখি সেনাবাহিনীর এক নায়েক তার বন্দুকের মাথায় লাগানো ধারালো বেয়নেট আমার পিঠে চেপে ধরে আছে। উত্তেজিত, চোখে জিঘাংসা| মনে হলো গুলি করে দেবে। আমি কিছু ব্যাখ্যা করতে গেলে সে আরও উত্তেজিত। ঠিক সেই মুহূর্তে সহপাঠী ও বনানীর বন্ধু এনু(কাজী এনায়েত উল্লাহ) এগিয়ে এসে ঐ নায়েককে বললো, "আদমজী কলেজের ছাত্র, ছেড়ে দিন।" ছয় ফুটের উপর উচ্চতার এনু ছিল কলেজের অন্যতম প্রিফেক্ট। কলেজের ইউনিফর্ম শাদা শার্ট, নীল প্যান্ট পরনে। বাহুতে মেরুন রঙের কাপড়ের বন্ধনীতে পিতলের ধাতব অক্ষরে বড় করে ইংরেজিতে লেখা পি (P)। বরাবরই সপ্রতিভ এনু ও তার হাতের ব্যাজ দেখে আমার পিঠে সঙ্গীন চেপে ধরা নায়েক তাকে মিলিটারী পুলিশের (MP) মতো কিছু একটা অথবা কী বুঝলো জানিনা। আমাকে ছেড়ে দিল।

আমি দ্রুত সহপাঠী বন্ধুদের সাথে করে পৈত্রিক প্রাণটা নিয়ে ঐ তল্লাট ছেড়ে কলেজে ছুটলাম। প্রাণে বাঁচলাম! ফিরে আসলাম অবিস্মরণীয় এক অভিজ্ঞতা নিয়ে।

সৈকত রুশদী: কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক

টরন্টো, ৭ নভেম্বর ২০১৫

বিডি-প্রতিদিন/০৮ নভেম্বর, ২০১৫/মাহবুব

 

 

সর্বশেষ খবর