৯ নভেম্বর, ২০১৫ ১৪:০৭

সংলাপ এবং নোবেল

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

সংলাপ এবং নোবেল

শান্তিতে নোবেল পেল তিউনিশিয়ার চারটি সংগঠন- যারা গণতন্ত্র রক্ষায় সংলাপের ভূমিকা নিয়ে স্বৈরশাসক, গণতন্ত্রকামী, ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ সব গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করে আরব বসন্তের সূচনাকারী দেশটির গণতন্ত্রকামী মানুষের সংগ্রামের সফলতা এনে দিতে পেরেছিল। ২০১১ সালে তিউনিশিয়ায় স্বৈরশাসনবিরোধী গণবিপ্লবের পর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করার জন্য এই চার সংগঠনকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। শান্তির মুকুট জয়ী নাগরিক সমাজের এ সংগঠনগুলো একসঙ্গে ন্যাশনাল ডায়ালগ কোয়াট্রেট নামে পরিচিত ছিল।  অস্থির ওই সময়ে তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা দেশটিকে সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধের হাত থেকে বাঁচায়। আরব বসন্তের পর তিউনিশিয়ায় যখন চরম অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা ও হানাহানিতে গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা মোটামুটিভাবে হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার মুখে ঠিক তখন ওই চারটি সংগঠন জাতীয় সংলাপের উদ্যোগ নেয়। তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। শান্তি প্রতিষ্ঠায় তারা সহায়কের ভূমিকা নিয়েছিল। কেননা সেটা হলেই কেবল গণমানুষের জন্য আরব বসন্তের সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তিউনিশিয়ায় সেদিন যে পরিস্থিতি ছিল সেই পরিস্থিতিতে স্বৈরশাসক, ইসলামপন্থি দল, ধর্মনিরপেক্ষ দল, মধ্যপন্থি দল- সবার মধ্যে যদি এই হানাহানি একবার বেধে যেত তাহলে তা পুরো আরব বিশ্বকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করত। তিউনিশিয়ার যে চারটি সংগঠন এই ভূমিকা নিয়েছিল আমার দৃঢ় বিশ্বাস তাদের কেউ নিজেরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এই সংলাপের উদ্যোগ নেয়নি। তারা নিয়েছিল একেবারে দেশমাতৃকার টানে।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি ওই সংগঠনগুলো নিঃস্বার্থভাবে দেশমাতৃকার টানে এগিয়ে এসেছিল এবং তাদের একটা গ্রহণযোগ্যতা ওই চারটি রাজনৈতিক গ্রুপের প্রতিও ছিল যার জন্য সেটা সম্ভব হয়েছে।

আজ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি আমরা একবার চোখ বুলিয়ে দেখি তাহলে আমরা দেখব যখনই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কনসেপ্ট আসল তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার জন্য বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যে কি পরিমাণ প্রতিযোগিতা হতো তা দূর থেকে হলেও আমরা কিছুটা আঁচ পেয়েছি। শুধু শেষ তত্ত্বাবধায়কের সময় চারজন অত্যন্ত স্বনামধন্য সাহসী ব্যক্তি তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে পদত্যাগ করেছিলেন এবং নিশ্চয়ই তারা তদবির করে সেখানে যাননি। হ্যাঁ, এরকম চারজন লোক যদি কখনো গণতন্ত্রের জন্য, কোনো সংলাপের জন্য ক্ষমতাসীন দলকে, বিরোধী দল অথবা অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে, আলাপ-আলোচনার ডাক দেন তখন হয়তো সম্ভব হতে পারে। মজার ব্যাপার হলো বাংলাদেশের জনগণের সবচেয়ে বড় যে দুটি দোষ বা গুণ, যাই বলি না কেন, সেটা হলো এদেশের সবাই রাজনীতিবিদ এবং সবাই ডাক্তার। প্রথমেই আমি ডাক্তারদের কথা ধরি। যদি কোথাও দাঁড়িয়ে বলেন, আমার পিঠে ব্যথা হচ্ছে। আপনি একটা রিকশাচালক বা ভ্যানচালক, দিনমজুর অথবা একজন কর্মকর্তাই হোন না কেন- আপনার পাশে দাঁড়ানো ছোট বাচ্চাটাও বলে ফেলবে অথবা ওষুধের দোকানের যে ওষুধ বিক্রেতা সে বলবে যে, আপনি একটা ইনফ্লাম খেয়ে ফেলেন। এই ইনফ্লামটা কখন খেতে হবে তার সঙ্গে আর কি প্রোটেকশন নিতে হবে সেটা কিন্তু সে জানে না। তো রাজনীতির বেলায়ও আমি নিজে দেখেছি গ্রামে-গঞ্জে, যে স্কুল-কলেজে যায়নি, যাকে আমরা অশিক্ষিত ধরতে পারি অর্থাৎ নিজের নামটা সে লিখতে পারে না ভালো করে, সেও কিন্তু রাজনীতি করে। অর্থাৎ আমাদের এই দেশে প্রায় সবাই কোনো না কোনো দলের সঙ্গে বা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। শুধু সম্পৃক্ত বললে ভুল হবে পুরোদস্তুর দলীয় সন্ত্রাসী বা ক্যাডার বা দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণকর্মী।

আমাদের সবারই মনে আছে, সেদিন তিউনিশিয়ায় কী ঘটেছিল। সে সময়টা হলো ২০১১ সালের জানুয়ারি মাস। তিউনিশিয়ার পুলিশের হয়রানি, শিক্ষিত যুবকদের বেকারত্ব, বিশেষ করে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে এক তরুণের আত্মহত্যার ঘটনার জের ধরেই সেই অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল। শুরু হয়েছিল একনায়ক জয়নাল আবেদিন বেন আলীর বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ। গণতন্ত্রকামী মানুষের টানা আন্দোলনের ফলে ওই বছরই তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন। ১৯৮৭ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করেন বেন আলী। বেন আলীর পতনের পর ২০১৩ সালের জুলাইয়ে বিরোধীদলীয় এক নেতা অস্ত্রধারীদের গুলিতে নিহত হন। যেটা ছিল ছয় মাসের মধ্যে দ্বিতীয় রাজনৈতিক হত্যা। এরপর শুরু হয় ব্যাপক সহিংসতা ও বিক্ষোভ। এমন পরিস্থিতিতে বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমোঝোতা গড়ার নেতৃত্ব দেয় এই চার সংগঠন।

যেহেতু এই চারটি সংগঠনের কোনো প্রাপ্তি ছিল না। যাদের কোনো উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল না। যারা শুধু দেশটাকে ভালোবেসেছিলেন। তাই সব রাজনৈতিক নেতা তাদের কথা এবং তাদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে একসঙ্গে বসতে বাধ্য হন এবং সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে নতুন সংবিধান রচনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে পদত্যাগ করে এন্নাহাদা সরকার এবং সে বছরই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশে ডায়ালগ বা সংলাপের অনেক চিত্রই আমাদের কাছে আছে। আমরা দেখেছি দুই আবদুলের সংলাপ। অর্থাৎ যাদের দুজনের কেউই এখনো বেঁচে নেই। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল এবং বিএনপির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। কতদিন এই সংলাপ চলল। সংলাপ থেকে বেরিয়ে দুজনেরই বক্তব্য ছিল আমরা অনেক এগিয়েছি। কেউ কখনো বলেননি যে, তাদের সংলাপের মধ্যে কোনো স্থবিরতা আছে। মতানৈক্যের সম্ভাবনা আছে। শেষ পর্যন্ত সংলাপ ব্যর্থ হলো। এ ছাড়াও বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রাক্কালে অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরুর প্রাক্কালেও পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সংলাপের এক অভিনয় নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল কিন্তু সেখানেও কী পরিণতি হয়েছে আমরা দেখেছি।  সবকিছুর পরও দুনিয়ার সব জায়গায় সব সংলাপ সফল হলো। একমাত্র জায়গা বাংলাদেশ, যেখানে কোনো সংলাপ কখনো আলোর মুখ দেখেনি।

বলছিলাম নোবেলের কথা। মহৎ কাজের জন্য, শান্তির জন্য, সুন্দর একটা পৃথিবীর জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। পার্বত্য শান্তিচুক্তির জন্য, গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির জন্য, ছিটমহল সমস্যা সমাধানের জন্য, এমন কি পরিবেশ উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য যথাক্রমে শেখ হাসিনা-সন্তু লারমা, শেখ হাসিনা-ড. মনমোহন, শেখ হাসিনা-মোদি, সর্বশেষ শেখ হাসিনাকেসহ অন্য পরিবেশ আন্দোলনে সম্পৃক্ত বিশ্ব নেতাদের নোবেল শান্তি পদক দিতে পারতেন।

কিন্তু সেটা কখনো সম্ভব হবে না। কারণ শেখ হাসিনা দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী নেতায় পরিণত হচ্ছেন। পার্বত্য শান্তিচুক্তির পরে সাদেক হোসেন খোকা পুলিশের ছোড়া গুলি অপসারণের নামে সুইডেনে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন, প্রমাণ করার জন্য তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী অত্যাচারী বা স্বৈরাচারী শাসক।  একই সঙ্গে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের একজন হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সময়ে একই উদ্দেশ্যে বক্তৃতা রাখতে গিয়েছিলেন। তাদের কাছে বাংলাদেশের সুনাম বড় নয়, শেখ হাসিনার দুর্নাম একটা বিরাট অহংকারের ব্যাপার।

সুতরাং বাংলাদেশ নিজের তথা বিশ্বের উন্নয়ন ও শান্তির জন্য যাই করুক না কেন, আমরাই আমাদের পথের কাঁটা হয়ে রব।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

 

 

সর্বশেষ খবর