৯ নভেম্বর, ২০১৫ ১৪:১৫

বিএনপি ‘মালিক-মহলে’ শমসের মবিন বোমাতঙ্ক!

কাজী সিরাজ

বিএনপি ‘মালিক-মহলে’ শমসের মবিন বোমাতঙ্ক!

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, হঠাৎ ‘বোমা’ ফাটিয়েছেন। এ বোমার স্পি­ন্টার কারও বক্ষ বিদীর্ণ করেনি, কিন্তু এ রাজনৈতিক বোমা বিএনপির মালিক-মহলকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ বোমা বিস্ফোরণে দলের উপরি কাঠামোর নড়বড়ে ভিত কেঁপে উঠেছে, দলের প্রকৃত দরদীরা ভাবছেন, এমন আরও বোমা ফাটাফাটিতে কখন না আবার বড় আকারের ধস নামে বিএনপিতে। তার পদত্যাগ এবং অবসর সমগ্র দলের মধ্যেই বেশ অস্বস্তির জন্ম দিয়েছে।  পদত্যাগ এবং অবসর একসঙ্গে উল্লেখ করলাম এ কারণে যে, তিনি আগে দলের প্রাথমিক সদস্য পদ পর্যন্ত সব দলীয় দায়িত্ব ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে পরে অবসরের কথা বলেছেন। শমসের মবিন কোনো ক্যারিয়ার রাজনীতিবিদ ছিলেন না ঠিক, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমেই প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা। বলা হয়ে থাকে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সুবাদেই তিনি রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের একটি সর্বোচ্চ পদ পররাষ্ট্র সচিব হয়েছিলেন। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর হঠাৎ হয়ে গেলেন ‘রাজনীতিবিদ’! তাও বিএনপির মতো একটি বিরাট রাজনৈতিক দলের একেবারে ভাইস চেয়ারম্যান। যেইসেই ভাইস চেয়ারম্যান নন; দলের আরও যে দেড় ডজন ভাইস চেয়ারম্যান আছেন, তিনি ছিলেন তাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, অনেক বেশি মূল্যবান নেতা! খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে তিনি ছিলেন কার্যত দলের তৃতীয় ক্ষমতাবান ব্যক্তি। দলের কর্মকাণ্ড নিয়ে, করণীয় নিয়ে বিলাত থেকে অন্য কারও সঙ্গে নয়, শমসের মবিন চৌধুরীর সঙ্গেই কথা বলতেন উত্তরাধিকার সূত্রে বিএনপির ‘মালিক’ তারেক রহমান। দুজনের মধ্যকার একটি টেলিফোন সংলাপ জনগণের শোনার সৌভাগ্যও হয়েছিল বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ৭১-এর মাধ্যমে। সেই ফোনালাপে তারেক রহমান সব রাজনৈতিক-সাংগঠনিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কঠোর ও নেতিবাচক সমালোচনা করেছিলেন; আন্দোলন চলাকালে তিনি কেন আন্ডারগ্রাউন্ডে আছেন বা ছিলেন তার সমালোচনা করেছিলেন তারেক রহমান। অথচ দলের অগণিত নেতা-কর্মীকে বিলাত থেকে ভুল পথে পরিচালিত করে বিপদের মুখে তিনি ঠেলে দিয়েছেন সাত সাগর তের নদীর অপর পাড়ে নিরাপদ দূরত্বে থেকে, এমন অভিযোগ আছে দলের অনেকেরই। কৌতুক করে অনেকে একে ‘বাঘ মারতে সতীনের ছেলেকে পাঠানোর’ সঙ্গে তুলনা করেন। বাঘ মরলেও লাভ, সতীনের ছেলে মরলেও লাভ। বাঘ মরলে এক ধরনের অনাস্বাদিত আনন্দের লাভ, আর যদি সতীনের ছেলে মরে যায় তাতে আফসোসের কিছু থাকে না, নিজের ছেলের জন্য যেমন আফসোস থাকে। তাতে সম্পত্তির হকদার কমে যায়। বলছিলাম বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের কথা, শোনা যায় তিনি তারেক রহমানের বদনজরে পড়েছেন এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ‘সরকার উৎখাতের সহিংস আন্দোলনে’ সফল নেতৃত্ব দিতে পারেননি বলে। কঠোরভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন বিএনপিতে বড় পদপদবির ভাগ্য নির্ধারক তারেক রহমান কর্তৃক। অথচ অনেকেরই জানা যে, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছিলেন তারেক রহমানেরই চয়েস। নবম সংসদ নির্বাচনের (হাওয়া ভবনের অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্তে প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের প্রধান উপদেষ্টার পদ দখল এবং তৎপরবর্তী ছেলেমানুষী কর্মকাণ্ডের ফলে যে নির্বাচনটি ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার করতে পারেনি) আগে দলের বক্তব্যসংবলিত আটটি অডিও-ভিডিও ক্যাসেট তৈরি করা হয়েছিল সারা দেশে প্রদর্শনের জন্য- এর আগে অষ্টম সংসদ নির্বাচনে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর উপস্থাপনায় ‘শাবাশ বাংলাদেশ’ ক্যাসেটের অনুকরণে। আটটি ক্যাসেটেই উপস্থাপক বা একমাত্র বক্তা হিসেবে বাছাই করা হয় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে। তখন তিনি দলে তত বড় মাপের নেতা ছিলেন না। চয়েস ছিল তারেক রহমানের। সব হয়েছিল ‘হাওয়া ভবন’ থেকে তারই তত্ত্বাবধানে। বার্তাটি তখনই পাওয়া গিয়েছিল যে, মির্জা ফখরুল অনেককে ডিঙিয়ে দলের অনেক উপরে উঠে আসবেন। বলে নেওয়া উচিত হবে যে, তারেক রহমানের এ যাবৎকালের নানা সিদ্ধান্তের মধ্যে এ সিদ্ধান্তটিই বোধহয় ছিল সঠিক। দলের উচ্চাসনে উঠে আসার লোক হয়তো আরও ছিল বিএনপিতে; কিন্তু সর্বমহলে এ স্বীকৃতি মিলেছে যে, মির্জা ফখরুল যোগ্যতম ব্যক্তি হিসেবেই উপরে উঠেছেন। তিনি একজন ক্যারিয়ার রাজনীতিবিদ না হলেও ছাত্রজীবনেও রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। আইয়ুববিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাঁপিয়েছেন অন্যতম নেতা হিসেবে। সেই ফখরুল ইসলাম আলমগীরই অপছন্দের হয়ে গেলেন তারেক রহমানের কাছে। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মানে গঠনতান্ত্রিকভাবে দলের নির্বাহী প্রধান।

শমসের মবিন চৌধুরীর চেয়ে দলে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী তো বটেই! সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে বললেন কার কাছে? শমসের মবিন চৌধুরীর কাছে। অর্থাৎ ততদিনে শমসের মবিন চৌধুরী মাতা-পুত্র-খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের কাছে মির্জা ফখরুলের চেয়ে বেশি আপন, বেশি বিশ্বস্ত ও বেশি গুরুত্বপূর্ণ! এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তার বিএনপিতে যোগদানের পর থেকেই। সবাই জানেন যে, বিএনপির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে দলের প্রভাবশালী নেতা সাইফুর রহমানের সঙ্গে এবং তার মৃত্যুর পর বিএনপির অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের এককালীন প্রাণপুরুষ ইলিয়াস আলীর সঙ্গে সিলেটের রাজনীতি ও সংগঠন নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন তিনি। বিশেষ করে, ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল গুম হয়ে যাওয়া দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর সঙ্গে। ইলিয়াসের গুম হওয়ার পর তার অনুগতদের হাত থেকে সিলেট বিএনপির নেতৃত্ব কব্জা করার লড়াইও চলে শমসের মবিন গ্রুপের। শমসের মবিন চৌধুরী সর্বদাই পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন দলের ‘মালিক’ বলে খ্যাত খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের। ফলে পদের চেয়েও বেশি ওজনদার ছিলেন বিএনপি ছেড়ে দেওয়া এই নেতা। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরাও ছিলেন তার কাছে ‘নস্যি’! স্থায়ী কমিটির যে দু-একজন এখন তার বিরুদ্ধে নানা কথা বলছেন, প্রবাদের মতো শোনা যায়, শমসের মবিনের সঙ্গে কথা বলতে তাদেরও ‘টিকিট’ কাটা লাগত। এমন একজন নেতা দলের সব পদ-পদবি থেকে ইস্তফা দিয়ে রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে নিলেন শুধু ব্যক্তিগত বা স্বাস্থ্যগত কারণে? মনে হয় না। চেয়ারপারসনের কাছে তার লেখা পদত্যাগপত্র বা অবসর গ্রহণের ঘোষণাপত্রটি অতি সাধারণ। কিন্তু এ ‘সাধারণ’ পত্রটিই ‘অসাধারণ’ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে শুধু বিএনপিতে নয়, গোটা রাজনৈতিক অঙ্গনে। দলের বড় বড় পদধারী কয়েকজন তার পদত্যাগ নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য মন্তব্য করলেও এতে তাদের ‘পেটের গুড়গুড়ি’ স্পষ্ট শোনা যায়। কেউ বলছেন ভয়ে করেছেন এ কাজ, আবার কেউ বলেছেন সরকারি চাপে করেছেন। দু-একজন ‘পণ্ডিতের’ এতদিন পর হঠাৎ মনে হয়েছে যে, তিনি তো আদতে রাজনীতির লোক নন, তাই রাজনীতিটা তার কাছে কঠিন মনে হচ্ছে। অথচ এ লোকগুলো এতদিন তাকে নেতা হিসেবে পারলে মাথায় নিয়ে নাচত। সবচেয়ে সতর্ক মন্তব্য করেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। (৩ নভেম্বর অসুস্থ এই বিএনপি নেতাকে আবার জেলে ঢুকানো হয়েছে। মির্জা ফখরুলকে বারবার গ্রেফতারে জনমনে এই প্রশ্নোদয় অসঙ্গত নয় যে, সরকার কি বিএনপিকে ভদ্র, রুচিশীল ও শিক্ষিত রাজনীতিবিদশূন্য করে দিতে চায়? কারা-নির্যাতনের ভয়ে তো এ ধরনের সজ্জন ব্যক্তিরা হয় রাজনীতিতে আসবেন না, নয়তোবা রাজনীতি ছেড়ে দেবেন শারীরিক কারণে, পারিবারিক চাপে। কিন্তু এ শূন্যস্থান যে তখন অরাজনৈতিক, অর্থলোভী ও দুর্বৃত্তদের দ্বারা পূর্ণ হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং কোনো দল এ ধরনের ব্যক্তিদের খপ্পরে পড়লে রাজনীতির চেহারা আরও কি সহিংস ও ভয়ঙ্কর হতে পারে, সরকার কি তা ভাবছে?)

 

 

তিনি বলেছেন, ‘শমসের মবিন চৌধুরী পার্টি চেয়ারপারসন দেশে ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারতেন।’ অন্যরা যে বলছেন, তার চলে যাওয়ায় দলের কোনো ক্ষতি হবে না বা সরকার বিএনপি ভাঙার যে চেষ্টা করছে এটা সেই প্রক্রিয়ারই অংশ, মির্জা ফখরুল তেমন কোনো অবান্তর মন্তব্য না করে যা বলেছেন তা অর্থপূর্ণ। মনে হয় দুজনই একটা বিষয় জানেন বা আন্দাজ করছেন যে, তাদের পার্টি চেয়ারপারসন দেশে ফিরতে আরও দেরি হতে পারে। শমসের মবিন চৌধুরী তত দেরি করতে চাননি। আর মির্জা ফখরুল ইসলাম হয়তো মনে করছেন, এ পদত্যাগ বা অবসর আরও পরে হলে এতে দলের যে ক্ষতি হলো বা আরও হবে তা আপাতত ঠেক দেওয়া যেত। অর্থাৎ ক্ষতিটাও তিনি কবুল করছেন আবার খালেদা জিয়া যে ৩ নভেম্বর দেশে ফিরবেন বলে ‘বিলাতি’ বিএনপি থেকে জানানো হয়েছিল তাও সত্য নয় বলে ইঙ্গিত দিলেন। আমরা এখন শমসের মবিন চৌধুরীর পদত্যাগ এবং বিএনপিতে এর আশু ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব এবং ফলাফল নিয়ে আলোচনা করব। বিএনপির বিভিন্ন পদধারী (নিযুক্ত বা নিয়োজিত) তার পদত্যাগ বা অবসর নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে মূল বিষয়ে কোনো কথা বলছেন না। শমসের মবিন চৌধুরী একজন ক্যারিয়ার রাজনীতিক নন, এটা অবিতর্কিত বিষয়। কিন্তু যারা এখন তাকে নিয়ে কথা বলছেন, তাদের চেয়ে শহীদ জিয়ার সঙ্গে তার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা অনেক আগের ও দৃঢ় ছিল। পরিচয়টা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ক্ষেত্রে। এর আলাদা একটা মূল্য তো দিতেই হবে। জিয়াকে এবং তার চিন্তাভাবনাকে তার বোঝার সময় ও সুযোগ ছিল বেশি। তিনি খালেদা জিয়া আর তারেক রহমানকে দেখে বিএনপিতে যোগদান করেননি, করেছেন জিয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে- তার বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার হয়েছে। তিনি দুটি মূল্যবান কথা বলেছেন দল ছাড়ার প্রাক্কালে- এক. বিএনপি এখন জিয়ার আদর্শে নেই, দুই. সহিংস রাজনীতি জনগণ পছন্দ করে না। আমার মনে হয়, এ দুই বক্তব্যের মধ্যে তার দল ছাড়ার মূল কারণ নিহিত। বিএনপি জিয়ার আদর্শে অবিচল নেই, এ কথা দৃঢ়তার সঙ্গে এর আগে বলেছিলেন দলের প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব ও সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী। তাকে যখন অন্যায় ও অপমানজনকভাবে দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয় কিছু রাজনৈতিক ‘বালকের’ বালখিল্যতায়, তারপর নিজ দল ‘বিকল্প ধারা’ প্রতিষ্ঠাকালে তিনি এ কথা বলেছিলেন। একই কথা বলেছিলেন শহীদ জিয়ার এককালীন নিত্যসঙ্গী এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ তার দল গঠনকালে। সর্বশেষ এ ব্যাপারে জোরালো অবস্থান নিয়েছিলেন বিএনপির সবচেয়ে দীর্ঘকালীন ও সফল মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। ২০০৭ সালের ২৫ জুন দলে সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপনকালে তিনিও বলেছিলেন, বিএনপি জিয়ার আদর্শ থেকে বিচ্যুত। লুটেরা সংস্কৃতি ও দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি শহীদ জিয়ার প্রতিষ্ঠিত দলকে ‘ফোকলা’ করে দিচ্ছে। নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন নেই, স্তুতিকার ও তোষামোদকারীদেরই পোয়াবারো। আদর্শের কোনো মূল্য ও চর্চা নেই। দলের মধ্যে মতাদর্শগত লড়াইয়েরও কোনো সুযোগ নেই। গণতন্ত্রের লেশচিহ্ন নেই দলে। দলের গঠনতন্ত্রের ৭ দফার (ঙ) অনুচ্ছেদে আছে, ‘সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ ও কুখ্যাত বলে পরিচিত ব্যক্তি জাতীয় কাউন্সিল, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, জাতীয় স্থায়ী কমিটি বা যে কোনো পর্যায়ে যে কোনো নির্বাহী কমিটির সদস্য পদের কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী পদের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে’; অথচ এ প্রকৃতির লোকরাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে দল দখল করে বসে আছে। শুধু তাই নয়, ‘দলের মালিকদের’ কাছে এদের অনেক সমাদর। অথচ জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন দুর্নীতিমুক্ত সজ্জন ব্যক্তি, এটা তার শত্রুরাও স্বীকার করে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের যে কালোত্তীর্ণ দর্শনের আলোকে তিনি দলকে এবং দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে আপ্লুত ও উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, সে দর্শনের চর্চা ও অনুশীলন খালেদা-তারেক বিএনপিতে এখন নেই। এখন কজন আছেন বিএনপিতে (একদম নেই তা বলছি না) যিনি বা যারা পাঁচ মিনিট বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ওপর বলতে পারবেন? পদের ওজন তো একেকজনের কয়েক টন! দল গঠনের আগেই যে ১৯ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে শহীদ জিয়া কাজ শুরু করেছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে সেই ১৯ দফাকে দলীয় কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, কজন আছেন বিএনপিতে যিনি বা যারা (সবার কথা বলছি না) এ ১৯ দফা সম্পর্কে জানেন? দলে এ কর্মসূচির কী গুরুত্ব আছে? কথাগুলো আবারও মনে করিয়ে দিলেন শমসের মবিন চৌধুরী। তিনি যথার্থই বলেছেন যে, বিএনপি এখন আর জিয়ার আদর্শের দল নেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তো উত্থিত হবেই যে, যারা জিয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বিএনপি করছেন এবং করতে চান, তারা এ বিএনপি কেন করবেন? শমসের মবিন চৌধুরীর মতো তারা তো দল ছাড়তেই পারেন। শহীদ জিয়া বিএনপিকে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক দল হিসেবেই গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চাকে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে যে একদলীয় বাকশালী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে শহীদ জিয়ার আমলেই সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফের প্রবর্তিত হয় দেশে। কমিউনিস্ট পার্টিসহ সব দলের সামনেই প্রকাশ্য গণতান্ত্রিক রাজনীতির দ্বার উন্মোচিত করেছিলেন তিনি, যাতে দেশে বাহাত্তর-পঁচাত্তরের মতো হিংসা-হানাহানির, জাসদীয় তাণ্ডবের মতো সশস্ত্র ও সহিংস রাজনীতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তার সেই রাজনৈতিক-আদর্শিক দর্শন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ গ্রহণ করেছিল বলেই মাত্র সাড়ে তিন বছরের রাষ্ট্রশাসনে তিনি জনচিত্ত জয় করেছিলেন। জীবিত জিয়ার চেয়ে মৃত জিয়া এখনো তাই এত শক্তিশালী। কিন্তু বর্তমানে খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান কি জিয়ার সেই শান্তিপূর্ণ, অহিংস, গণতান্ত্রিক রাজনীতির পতাকা উড্ডীন রেখেছেন? ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত আন্দোলনের নামে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট যা করেছে, তা সে কথা বলে না। ওই সময়কার সব ঘটনার জন্য হয়তো তারা দায়ী নন, জনগণের কাছে তাদের ‘ডিফেইম’ করার জন্য সরকারও কিছু চালাকি করে থাকতে পারে। কিন্তু সহিংসতায় যখন জাতির জীবন অতিষ্ঠ, ‘নীরোর’ মতো তারা বাঁশি বাজিয়েছেন কেন? অবরোধ কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো প্রত্যাহার করা হচ্ছে না কেন? শমসের মবিন চৌধুরী নিশ্চয়ই এ খারাপ প্রবণতার প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন। তার সিদ্ধান্ত বিএনপির জন্য অবশ্যই একটি সতর্ক বার্তা। তিনি অতি কাছে থেকে, খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থেকে তার গভীর পর্যবেক্ষণই তুলে ধরেছেন তার বক্তব্যে। বিএনপি এখনো বিপুলভাবে জনসমর্থিত একটি রাজনৈতিক দল। একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে জিয়ার বিএনপি যদি নমিনেশন বেচাকেনা না করে সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ বা কুখ্যাত বলে পরিচিত ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে সৎ, আদর্শবাদীদের প্রার্থী করে, তাহলে সরকারি দলের প্রার্থীদের হারাতে হয়তো তাদের কোটি কোটি টাকার প্রয়োজন হবে না বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। কিন্তু তা না করে আদর্শবিচ্যুত, সহিংস রাজনীতির পথ ধরে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে দলের আরও অনেকেই শমসের মবিন চৌধুরীর পথে পা বাড়াতে পারেন। এ আলোচনা এখন তৃণমূল পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়েছে। যারা এ পরিপ্রেক্ষিতে বড় বড় হাঁকডাক দিচ্ছেন, তাদের কথার দাম দেয় কে? দলের লোকেরা তাদের চেনেন না? রাজনীতি, আদর্শ ঠিক না থাকলে, তার চর্চা ও প্রয়োগ না থাকলে একটি রাজনৈতিক দল মরে যায়। যারা বিএনপির ক্ষেত্রে তা চান না, সঠিক পথে না চললে শমসের মবিন চৌধুরীর সিদ্ধান্তে সাহসী হয়ে তারা দলের ভিতর সাহসী মতাদর্শগত লড়াইয়ের সূচনা করতে পারেন। যারা বলছেন, আগেও অনেকে চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু কিছু করতে পারেননি। মান্নান ভূঁইয়া বেঁচে থাকলে এসব তেলবাজ টের পেতেন কত ধানে কত চাল হয়।  সে কথা না হয় বাদই দিলাম। এবার যদি কিছু হয় তো আদর্শের জন্য হবে, দলের সঠিক রাজনৈতিক লাইনের জন্য হবে।  শমসের মবিন চৌধুরী কী করবেন জানি না, তবে তিনি শহীদ জিয়ার আদর্শের অনুসারী প্রকৃত গণতন্ত্রীদের চোখের তারায় নতুন স্বপ্ন ছড়িয়ে দিয়েছেন। বেগম খালেদা জিয়া কি সেই স্বপ্নের রূপকার হবেন?

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

ই-মেইল : [email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর