১১ নভেম্বর, ২০১৫ ১৪:২৩

সংলাপ চাহিয়া লজ্জা দিবেন না

ডক্টর তুহিন মালিক

সংলাপ চাহিয়া লজ্জা দিবেন না

এক. বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দেশে ক্রান্তিকাল চলছে উল্লেখ করে জাতীয় স্বার্থে সংকট উত্তরণে জাতীয় সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। পক্ষান্তরে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ নাকচ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দল। জোটের মুখপাত্র স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিম বলেছেন, খালেদার সঙ্গে কোনো সংলাপ হতে পারে না।  তবে খালেদা ক্ষমা চাইলে ২০১৯ সালে সংলাপ। মাঠে আসুন সেখানে দেখা যাবে কে জিতে কে হারে। তার মানে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করার আগে মাঠে মারামারি করে জিতে আসতে হবে। তবে মারামারিটা করতে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে ঠিকই কিন্তু মাঠে যে কাউকে আসতেই দেওয়া হচ্ছে না। মারামারি করে জয়-পরাজয় নির্ধারণ হবেটা কী করে? এদিকে আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সোজা বলে দিলেন, সংলাপ ইজ ‘টোটাল রাবিশ, অল স্টেটমেন্ট ইজ রাবিশ, রাবিশ’। একি কথা বলছেন মন্ত্রী মশাইরা? কোনো দেশের জাতীয় সংলাপের প্রস্তাবও আবার রাবিশ হয় নাকি? সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়ে দিলেন, যোগ্যতা ছাড়া কোনো সংলাপ হয় না। আন্দোলন করার যাদের শক্তি নেই, তারাই এখন ঘন ঘন সংলাপের কথা বলে। সংলাপে বসার জন্য নিজেদের শক্তি, যোগ্যতা, সাহসের প্রমাণ রাখতে হবে। না হলে কার সঙ্গে সংলাপ হবে? খালেদা জিয়া কি এমন অথরিটি যে তার সঙ্গে বসব? ওবায়দুল কাদেরের দাবি মতে, আন্দোলন আর সংলাপ এক জিনিস। সংলাপ করতে হলে তাই আন্দোলন করতে হবে। পেট্রলবোমা মারলে হবে না, এটম বোমা মেরে সাহসী ও যোগ্য হতে হবে। না হয় ২০০৬-০৭ এর মতো জ্বালাও-পোড়াও করতে হবে। প্রকাশ্য রাস্তায় পশুর মতো পিটিয়ে লাশের ওপর নৃত্য করতে হবে। আনতে হবে ১/১১। অর্থাৎ সংলাপের পূর্বশর্ত হচ্ছে খুনখারাবি ও ধ্বংসযজ্ঞ। লগি-বৈঠা-জ্বালাও-পোড়াও ধরনের আন্দোলন করতে না পারলে কোনো সংলাপই নয়। সংলাপের প্রস্তাবকে ‘আন্দোলনের প্রস্তাব’ দিয়ে সরাসরি নাকচ করে দিলেন তিনি। এদিকে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বললেন, ‘ধূর্ত শৃগালের সঙ্গে মুরগির সংলাপ হতে পারে না। শৃগাল তো মুরগিকে বধ করতে চাইবেই’। কথা সত্য। নির্বাচন হলেই তো মুরগি বধ নিশ্চিত জেনে শৃগালের কাছে যাবে কোন পাগলে? তাই সরকার যখন ২০১৯, ২০৪১ রূপকল্প নিয়ে ব্যস্ত, তখন অযথা সংলাপ চাহিয়া লজ্জা দিবেন না।

দুই. এদিকে সংলাপ না করার পক্ষে সরকারি দল আজব সব যুক্তি হাজির করছে। একসময় বলা হতো জামায়াতকে ছেড়ে এলেই সংলাপ হবে। এখন বলা হচ্ছে বোমাবাজদের সঙ্গে আবার সংলাপ কিসের। এর আগে বলা হতো, ১৫ আগস্টের খুনিদের সঙ্গে এবং ২১ আগস্টের হামলাকারীদের সঙ্গে সংলাপ নয়। তার মানে খুনের বদলা খুন। সব খুনের হিসাব শেষ হোক তারপর দেখা যাবে। ইটের বদলা পাথরে দেওয়া হবে। অথচ গণতন্ত্রের দাবি করলে তো কথা বলতে অস্বীকৃতি জানানোর কথা নয়। আবার অনেক বিদগ্ধজন ইদানীং বলেন যে, আমাদের দেশে সংলাপ কি কখনো সফল হয়েছে? কিন্তু সংলাপ না হলেও সফল আলোচনা তো হয়েছে। না হলে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন কী করে সফল হলো? তিন জোটের রূপরেখাইবা কী করে হয়েছিল? রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার থেকে সংসদীয় পদ্ধতি কী করে করা হয়েছিল? নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি কীভাবে প্রবর্তন করা হয়েছিল? এমনকি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা শান্তিবাহিনীর সঙ্গেও তো আমরা পার্বত্য শান্তিচুক্তি করেছি। আর নিজ দেশের ভিতর প্রতিপক্ষ দলের সঙ্গে কোনো আলোচনা নিষিদ্ধ করছি কোন যুক্তিতে? পশ্চিমবঙ্গেও ঝাড়খণ্ডে আলোচনার মধ্যে সমাধান করার দৃষ্টান্ত রয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতার মধ্যে সংলাপ চেয়ে ২০১৩ সালের মার্চ মাসে রুল জারি করেছিলেন আমাদের হাইকোর্ট। রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন এবং তাদের নেতৃত্বাধীন জোটের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠানের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে নাÑ তা জানতে চাওয়া হয়েছিল এ রুলে। চার সপ্তাহের মধ্যে এ রুলের জবাব দিতে বলা হলেও আজ অবধি কোনো দলই আদালতের প্রতি কোনো সম্মানবোধটুকু দেখাতে সচেষ্ট হয়নি।

তিন. মানুষের অধিকার, সংবিধান ও গণতন্ত্র আজ প্রহসনে পরিণত হয়েছে। আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের অভাবে জনগণই আজ সবচেয়ে বেশি শক্তিহীন হয়ে পড়েছে। অথচ এর বদলে সব ধরনের ক্ষমতায়ন হয়েছে দুর্বৃত্তদের। আর এর প্রায় পুরোটাই আজ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের কব্জায়। যে দল ক্ষমতায় যায় রাষ্ট্রের সব শক্তিকে ব্যবহার করে তারাই হয়ে যায় একেকটা মহাদুর্বৃত্ত। সেখানে কদিন আগের ক্ষমতায় থাকা আরেক মহাদুর্বৃত্তও হয়ে পড়ে সবচেয়ে অসহায়। এ যেন আজব এক যুদ্ধ বিজয়ের মতো অবস্থা। বিজয়ী দল রাতারাতি যেন রাজত্ব, রাজকন্যা আর সব রাজভাণ্ডারের অধিকারী হয়ে যায়। পরাজিতরা শুধুই গুলি খেয়ে মরে আর কারাগারে মৃত্যুর প্রহর গুনে। এ কারণে কেউ আর এখন পরাজিত হতে চায় না। যে কোনো মূল্যে ক্ষমতাকে ধরে রাখতে চায়। এটা প্রাচীনকালে রাজা-বাদশাহর আমলে সম্ভব হলেও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এসব হবে কেন? জনগণই সব ক্ষমতার উৎস এ কথাটার সঙ্গে সঙ্গে পবিত্র সংবিধান পর্যন্ত আজ গণমানুষের আস্থার সংকটের মুখে উপনীত। মানুষের বেঁচে থাকার যে একটা অধিকার আছে, মানুষ সেটাও আজ আর বিশ্বাস করতে পারছে না। উপরন্তু ভোটের অধিকার তো বাহারি একটা কল্পনাবিলাস মাত্র! আগে পাঁচ বছর পরপর অন্তত মানুষ এক দিনের জন্য হলেও ‘বাহাদুরি’ দেখাতে পারত। এখন তো সেটারও কোনো খবর নেই। আমরা পরাধীনতার কষ্ট পাকিস্তনি আমলে অনেক সহ্য করেছি। কিন্তু মানুষের ভোটাধিকার হরণের কষ্টটা বোধহয় স্বাধীন দেশেই আমরা আরও বেশি ভোগ করেছি। শুধু দলের মধ্যে নয় সমাজের প্রতিটি স্তরে চাটুকারদের স্তুতিবিজ্ঞান, সুবিধাদর্শন, স্তবসাহিত্য ও গুণকীর্তনতত্ত¡ আজ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে।

চার. গত সাত বছরে কত মানুষ জীবন হারিয়েছে, কত মানুষ আগুনে পুড়েছে, কত যানবাহনে আগুন লেগেছে, কত প্রাণ ক্রসফায়ারে মরেছে, কত মানুষ গুম হয়েছে, কতজন পঙ্গু হয়েছে, ঘরছাড়া হয়েছে কত পরিবার, লাশের মিছিল কত দীর্ঘতম হয়েছে, কারাগার ভরেছে গিজগিজ করে, কত পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়েছে? মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রতিনিয়ত এসবের ভয়াবহ বিবরণ তুলে ধরেছে। অথচ মাঠে এসে মারামারি করার ঘোষণা দিয়ে মন্ত্রীরা তো প্রকারান্তরে এসব সহিংসতাকেই আবারও আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। আসলে সহিংসতা ও সন্ত্রাস করে কি কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলন করা সম্ভব? অবিভক্ত ভারতের যুগান্তর অনুশীলনের আন্দোলন, ক্ষুদিরাম বা সূর্যসেনের সশস্ত্র কর্মকাণ্ডকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? কিন্তু তারপরও তাদের এ আন্দোলন কিন্তু ভারতকে মুক্তি দিতে পারেনি। কারণ রাষ্ট্রনীতি ও গণমানুষের রাজনীতি সব সময় সংঘাত ও নৈরাজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। নৃশংস আন্দোলন কখনো জননীতির পরিচায়ক হতে পারে না। কিন্তু সরকার তার প্রতিপক্ষের গণতান্ত্রিক দাবিকে কঠোর হার্ডলাইনে গিয়ে নকশালী কায়দায় তা দমন করতে চাচ্ছে। সরকার মানুষ মারার সব লাইসেন্স প্রশাসনের হাতে তুলে দিয়েও হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে পারছে না কেন? কথিত বন্দুকযুদ্ধে মানুষ মেরেও কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না কেন? বরং স্বয়ং দায়িত্বরত পুলিশকে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হতে হচ্ছে। পুলিশ বা র‌্যাবপ্রধান যতই বলুক না কেন, আক্রান্ত হলেই গুলি করা হবে। কিন্তু এ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ তো কয়েক বছর ধরেই অবিরামভাবে চলছে। কই, তাতে তো সহিংসতা এতটুকুও কমেনি। যেভাবে গণহারে ধরপাকড় করা হচ্ছে এতে প্রকৃত সন্ত্রাসী কতজন ধরা পড়ছে তা কি কেউ বলতে পারবেন? বরং এসব ধরপাকড় ও গণগ্রেফতারের নামে বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষকেই নিশ্চিহ্ন করতে চাওয়া হচ্ছে। যে সমস্যাটি রাজনৈতিক, তা রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে। প্রশাসন দিয়ে গদি রক্ষা সম্ভব হলেও রাজনীতি রক্ষা সম্ভব নয়। গত সাত বছরে আওয়ামী লীগ প্রশাসনকে শুধু দলীয়করণ করেনি; দলকেও প্রশাসনিক করেছে। প্রশাসনের কর্মচারীরা আওয়ামী লীগের নেতাদের মতোই কথা বলছে। আর দলীয় নেতারা প্রশাসনের মতোই হুকুম নির্দেশ দিচ্ছে।

পাঁচ. দেশের প্রতিটি হত্যাকাণ্ডকে উগ্র জঙ্গিবাদের কারণ বলা হলেও গত সাত বছরে একটি ঘটনারও রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বরং তারা রাজনীতিবিদ ও নেতাদের মতোই বিরোধীদের দোষারোপ করে দায় এড়াতে চেষ্টা করেছে। আইনশৃঙ্খলার এ অসহায়ত্বই প্রমাণ করে যে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা আজ কতটা ভঙ্গুর কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সরকার বলছে দেশ জঙ্গিতে ভরপুর। অথচ ঘটনা ঘটলেই আবার বলছে দেশে কোনো জঙ্গির অস্তিত্ব নেই। কারও সঙ্গে কারও কথার কোনো মিল নেই। বিদেশি শক্তিকেও আবার কখনো দায়ী করে বলা হচ্ছে, তারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাচ্ছে। এতে বিদেশিরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দেশ থেকে তাদের ব্যবস্যা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ গুটিয়ে নিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা, জননিরাপত্তা ও অর্থনীতি তো বটেই দেশের ক্রীড়াঙ্গন পর্যন্ত আজ মারাÍক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও নিরপেক্ষ বিচারের স্বার্থে ‘জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল’ গঠন করে অনতিবিলম্বে সবার আস্থা অর্জন করতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে সরে এসে দেশকে অনতিবিলম্বে একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র থেকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে দলবাজি ও দলদাস মনোবৃত্তি বাদ দিয়ে পেশাদারিত্ব ও দায়বদ্ধতাকে ফিরিয়ে আনতে হবে।

ছয়. সংকট নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনায় না বসলে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদে অনিশ্চয়তায় পড়বে। আর এক্ষেত্রে সংলাপের বিকল্প হচ্ছে সংঘাত-সংঘর্ষ। জরুরিভাবে সর্বদলীয় বৈঠকের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যের প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে হলে নির্বাচিত শাসন প্রয়োজন। অনির্বাচিত শাসন কখনো জবাবদিহি করে না। জনগণের মালিকানার পুরোটাই চলে যায় তখন অনির্বাচিতদের হাতে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না হলে তখন ক্ষমতার সবটুকু নিয়ে জš§লাভ হয় ভয়াবহ স্বৈরশাসনের। শাসকরা কার কাছে তখন স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা বা দায়বদ্ধ থাকতে চাইবে? সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অগণতান্ত্রিক শাসনের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে আÍপ্রকাশ করে। গত সাত বছরে আমরা ইসলামকে চেতনার প্রতিপক্ষ করেছি। গণতন্ত্রকে উন্নয়নের প্রতিপক্ষ বানিয়েছি। আর দেশকে একটি জঙ্গিপ্রধান রাষ্ট্রে পরিচয় করাতে পেরেছি। আসলে সরকার বিএনপির কথা শুনবে কোনো যুক্তিতে। এ কথা তো সত্য যে, বিএনপির আন্দোলন করার সাহসী কোনো নেতা অবশিষ্ট নেই। সরকারের মন না ভাঙিয়ে নরমসরম কথা বলা নেতারাই এখন দল চালাচ্ছে। এ কারণেই সরকার এখন দমন-নিধন চালিয়ে প্রচণ্ডভাবে শক্তিশালী। তবে অতিরিক্ত যোগ্যতাও অনেক সময় ভয়ঙ্কর সর্বনাশ ঘটাতে পারে। তেলাপোকার পাখি হওয়ার জন্য দুটো পা-ই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু অতিরিক্ত চারটা পা তাকে পাখি হতে দিল না। সাত. কদিন আগে দীর্ঘ ৬৬ বছর পর চীন ও তাইওয়ানের দুই প্রেসিডেন্ট করমর্দন করলেন। যা গত এক সপ্তাহ আগেও কেউ কল্পনা করতে পারেনি। কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর চিয়াং কাইশেক তার অনুগতদের নিয়ে চীন সীমানায় একটি দ্বীপে ঘাঁটি গেড়ে তাইওয়ান রাষ্ট্রের জš§ দেয়। তখন থেকেই চীন বরাবরই দ্বীপটিকে উদ্ধারের লড়াই চালিয়ে আসছে। অন্যদিকে তাইওয়ানিরা চীনের সঙ্গে একীভ‚ত হওয়ার বিপক্ষে। কিন্তু গত কদিনের বিরোধপূর্ণ দক্ষিণ চীন সমুদ্র অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হলে বিশ্বকে অবাক করেই চীন-তাইওয়ান বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে। ৬৬ বছরের দীর্ঘ বিরোধকে যদি তারা জাতীয় স্বার্থে ভুলে গিয়ে এক হয়ে এগিয়ে আসতে পারে, তাহলে নিজ দেশের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জাতীয় স্বার্থে আলোচনা করতে অসুবিধা কোথায়? পুরো বিশ্ব ব্যবস্থা যখন পাল্টাচ্ছে তখনো আমরা ‘ঘাড়টেরা’ হঠকারী রাজনৈতিক খেলায় মগ্ন। অন্যদিকে কদিন আগে এ বছরের শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো তিউনিশিয়ার এমন চারটি সংগঠনকে যারা গণতন্ত্র রক্ষায় দেশের বিবদমান সব গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করে আরব বসন্তের সূচনা করেছিল। যারা এতদিন ধরে নোবেল কামনা করে আসছেন তাদের জন্যও এটা বড় ধরনের একটা বার্তা নয় কি? তিউনিশিয়ার স্বৈরাচারবিরোধী গণবিপ্লবের পর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করার জন্য নোবেল পেয়ে গেল তারা। আর আমরা দীর্ঘদিন স্বৈরশাসনের কবলে থাকার পর গণতন্ত্রের স্বাদ পেতে না পেতেই আরেক স্বৈরশাসনের খপ্পরে পড়ে গেলাম। আজকের বাংলাদেশের যে অবস্থা তিউনিশিয়াও একই অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল। তিউনিশিয়ায় তখন স্বৈরশাসন, ইসলামপন্থি দল, ধর্মনিরপেক্ষ নামক উগ্রপন্থি এবং মধ্যপন্থি দলগুলোর মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল নোবেল বিজয়ী এ চারটি সংগঠন।

আট. সংলাপকে অস্বীকার করা মানে গণতন্ত্র ও সংবিধানকে অস্বীকার করা। সংবিধানের মূল নীতি নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। কিন্তু যার যার মতো করে সংযোজন-বিয়োজন করে মারাÍক বিভেদ সৃষ্টি করেছি আমরা। ধর্ম নিয়ে তো কোনো বিভেদ এদেশে কখনো ছিল না। অথচ গত সাত বছরে সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত করা হলো ধর্মকেই। বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনকে জঙ্গি উপাধি দিয়ে দেশকে বহির্বিশ্বে জঙ্গি রাষ্ট্র বানিয়ে দেওয়া হলো। মহান মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় দখলদারিত্ব ও চেতনাকে ব্যবসায় পরিণত করে বিরোধী মতকে স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি তকমা দিয়ে চেতনাকে সস্তা স্লোগানে পরিণত করা হলো। গণতন্ত্রকে অসুস্থ রাজনৈতিক দখলদারিত্বের আষ্টেপৃষ্ঠে জর্জরিত করে ফেলা হলো। গণতন্ত্রের বদলে উন্নয়নের প্রপাগান্ডা করে দেশকে একটি অগণতান্ত্রিক স্বৈররাষ্ট্রে রূপান্তর করা হলো। জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদ মোকাবিলা করতে হলে জাতীয় সংলাপ ও জাতীয় ঐক্য লাগবেই। জঙ্গিবাদ নিয়ে অপরাজনীতি করলে আর সব দায়ভার প্রতিপক্ষ দলের কাঁধে ঠেলে দিলে একদিন জঙ্গিদেরই বিজয় ঘটবে। তখন কি আওয়ামী লীগ, কি বিএনপি, কেউ রেহাই পাবে না। দেশে গণতন্ত্র থাকলে উগ্র জঙ্গিবাদীরা কখনো মাথাচাড়া দেওয়ার সাহস পাবে না। আমাদের রাজনৈতিক বিভাজন ও সংঘাতের সুযোগই নিচ্ছে জঙ্গিরা। বিএনপি ক্ষমতাকালে এবং বিরোধী দলে থাকাবস্থায় হাজারও ভুল করেছে সত্য। কিন্তু তাই বলে কি বিএনপিকে একেবারে নিঃশেষ করতে হবে? দলকে নিশ্চিহ্ন নয়, বরং যুক্তি দিয়ে এবং রাজনৈতিক আদর্শ উপস্থাপন করে বিরুদ্ধ মতবাদকে পরাস্ত করুন। আওয়ামী লীগের দুশাসন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে যদি দেশে কোনো একটা উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির অস্তিত্ব না থাকে তবে নিশ্চিতভাবেই এটা সম্পূর্ণভাবে চলে যাবে উগ্রপন্থিদের কারও হাতে। তখন হয়তো আমাদের সবই হারাতে হবে।  বহু মানুষের রক্তে পাওয়া দেশকে বাঁচাতে একটি উদার গণতান্ত্রিক দলের এরকম নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা কারও জন্যই কখনো শুভ ফল বয়ে আনবে না।  উগ্রবাদীদের রুখতেই বিএনপির মতো একটি উদার গণতান্ত্রিক দলকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

লেখক : আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ।

e-mail: [email protected]


বিডি-প্রতিদিন/ ১১ নভেম্বর, ২০১৫/ রশিদা

সর্বশেষ খবর