২৩ নভেম্বর, ২০১৫ ১১:০৭

অজ্ঞেয় ও বিশ্বাসী

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

অজ্ঞেয় ও বিশ্বাসী

ধর্ম, কর্ম, স্রষ্টা এবং সৃষ্টি একে অপরের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ধর্ম সম্বন্ধে অনেক বড় বড় মনীষী, সাধু-সন্ন্যাসী, অলি-আউলিয়া, যাজক-পুরোহিতদের অনেক কথা আছে। তেমনি কর্ম সম্বন্ধেও তাদের অনেক বক্তব্য বা উপদেশ বাণী রয়েছে। ধর্ম বিশ্বাসী মহামানবগণ কখনো ধর্মকে কর্ম থেকে আলাদা করেননি। ভাগবত গীতায় স্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘ফলের প্রত্যাশা না করে যদি তুমি কর্ম করে যাও তাহলে ধর্ম করে যে প্রশান্তি বা স্বস্তি পাবে ঠিক একই স্বস্তি তুমি এ ক্ষেত্রেও পেতে পার।’  ধর্ম যে ক্ষেত্রে দেয় আত্মতৃপ্তি ও আত্মশুদ্ধি, সেক্ষেত্রে কর্ম শুধু নিজের জন্য নয় অনেক ক্ষেত্রেই পরোপকারে আসে। এ প্রসঙ্গে একজন অবিশ্বাসী এবং একজন বিশ্বাসী লোকের মন্তব্য তুলে ধরছি। এদের একজন হলেন খুসবন্ত সিং আর অপরজন এপিজে আবদুল কালাম। দুজনের মধ্যে প্রচণ্ড মিল। দুজনই অত্যন্ত পড়ুয়া, যাদের কাছে বই পড়া একটা প্রধান শখ, পণ্ডিত ব্যক্তি এবং দুজনেরই কিছু না কিছু লেখা একটা বিশেষ শখ। খুসবন্ত সিং একজন মহান লেখক ও বিশ্লেষক এবং ৯৫ বছর বয়সেও তিনি অবিরাম লিখে চলেছিলেন। ২০০৭ সালে তিনি তার এক কলামে এপিজে আবদুল কালাম সম্পর্কে লিখেছিলেন যার সংক্ষিপ্ত রূপটি ঈশ্বর সম্বন্ধে খুসবন্ত সিং এবং এপিজে আবদুল কালামের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণিত হয়েছিল এবং যেগুলা ছিল অত্যন্ত কৌতূহল উদ্দীপক। খুসবন্ত সিং এপিজে আবদুল কালাম সম্পর্কে বলেছিলেন যে, আমার কোনো ধারণা নেই অবসর গ্রহণের পর তিনি গবেষণায় ফিরবেন, নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন, না সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করবেন। তিনি ৭০ বছর বয়স পার করেছেন। আমার একবার উনার সঙ্গে আধা ঘণ্টা কাটানোর সময় হয়েছিল। আমার গৃহে এসে আমায় রাষ্ট্রপতি কালামজী সম্মানিত করেছিলেন। রাষ্ট্রের প্রধান যখন সাধারণ একজন কেরানীর সঙ্গে দেখা করতে আসেন তখন তার বিনম্রতাই প্রকাশ পায়। খুসবন্ত সিংয়ের ভাষায় আমাদের দুজনের মধ্যে খুব সামান্য মিল আছে। তিনি তামিল আর আমি তামিল ভাষার মাত্র দুটো শব্দ জানি। আমি একজন অজ্ঞেয় বাদী এবং বিশ্বাস করি ‘বিজ্ঞান এবং ধর্ম একসঙ্গে পথ চলতে পারে না।

এপিজে আবদুল কালাম হলেন একজন বিজ্ঞান সাধক এবং অত্যন্ত ধার্মিক। একটা হলো যুক্তিনির্ভর আর একটা হলো বিশ্বাসনির্ভর। ওর সঙ্গে কথা বলে ওর লেখা পড়ে মনে হলো মহাত্মা গান্ধীর মতোই এক ধর্ম বিশ্বাসী। বাপুজীর সব মতবাদ গ্রহণ করার অক্ষমতা সত্ত্বেও খুসবন্ত সিং নিজেকে গান্ধীবাদী বলে মনে করেন। এপিজে আবদুল কালাম যেমন ধার্মিক পরিবারের সন্তান এবং নিজে ধর্মপরায়ণ ও ধর্মানুরাগী এবং সব ধর্মের প্রতি সমান সম্মান প্রদর্শন হলো যার মর্মবাণী, ঠিক তার উল্টোটা হলেন খুসবন্ত সিং। তিনি ধর্মে বিশ্বাস করেন না, সে ব্যাপারে কিন্তু তিনি অন্যকে অবিশ্বাসী হতে উপদেশ দেন না এবং তার মতবাদ প্রচারের চেষ্টাও করেন না।

সিং ২০০৭ সালে তার কলামে কালামজীকে নিয়ে একটা নিবন্ধ লিখেছিলেন যার কিছু অংশ কালামজী তার ঞঁৎহরহম চড়রহঃ (সন্ধিক্ষণ) বইতে লিখেছিলেন, যা এখানে তুলে ধরছি, ‘আর কয়েক মাসের মধ্যে আমাদের প্রজাতান্ত্রিক দেশের একাদশতম রাষ্ট্রপতি আবদুল কালাম পাঁচ বছরের পূর্ণ মেয়াদকাল সমাপ্ত করে অবসরগ্রহণ করবেন। সর্বোচ্চ পদাধিকারী হিসেবে তিনি ছিলেন ইসলাম ধর্মের তৃতীয় ব্যক্তি। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আমাদের দাবির এটাই এক সুষ্ঠু প্রমাণ এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের কাছে শিক্ষণীয়।’ একবার খুসবন্ত সিং এপিজে আবদুল কালামকে প্রশ্ন করেন তিনি কি ‘শেষ বিচারের দিন’ আমাদের সবাইকে জীবনের উপরে পুরস্কার অথবা শাস্তি নিতে হতে পারে এ বিষয়টি বিশ্বাস করেন? গবেষক, বিজ্ঞানী এবং জ্ঞানতাপস এপিজে আবদুল কালাম পাশ কাটিয়ে উত্তর দিলেন, ‘স্বর্গ এবং নরক মনের মধ্যে থাকে।’ প্রশ্ন ওঠে ঈশ্বর সম্পর্কে কালামের মত তাহলে কি? যা মসজিদ বা মন্দিরে খুঁজে পাওয়ার নয়, তাকে যুদ্ধ করে বা আত্মসুদ্ধি করে খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমন আমাদের দেশের বিভিন্ন ধর্মের মূল প্রচারকরা করে থাকেন। তারা একে অপরের রক্তপাত করার পর ঘোষণা উঠে-

আলোক থেকে সহসা বজ্রনিনাদ গর্জিত হলো

‘শোনো সবাই! আমি তোমাদের কারও নই!

প্রেম ছিল আমার ব্রত, আর তোমরা ঘৃণায় তা অপচয় করেছ,

আমার হর্ষকে হনন করে, জীবনকে শ্বাসরোধ করে।

জেনো : খোদা আর রাম

উভয়েই এক, ভালবাসায় তাঁরা প্রস্ফুটিত।’

কোনো যুক্তিবাদী ঈশ্বরত্ব সম্বন্ধে কালামের দৃষ্টিভঙ্গি সমালোচনা করতে পারবেন না। ‘কেউ ঈশ্বরকে দেখেন সত্যরূপে, কেউ প্রেমরূপে। কালামের কাছে ঈশ্বরত্ব হলো সহানুভূতি...।’ আসলে ধর্মকর্মের একটা বিরাট অংশ হলো দান। ইসলাম ধর্মের বিধান মতে, নিজের ধন সম্পদের একটা বিরাট অংশ আত্মীয়স্বজন, গরিব ও সহায়সম্বলহীন লোকদের মধ্যে বণ্টন করার যে রীতি আছে অর্থাৎ দান করা সেটাই হলো ধর্ম এবং কর্মের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করার একটা অন্যতম পথ। দানের মাধ্যমেই মানুষের প্রাপ্তি ঘটে। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা ধনসম্পদে সৌভাগ্যবান এবং অনেকেই আছেন সে ধনসম্পদ নিজের মধ্যে কুক্ষিগত করে রাখেন। আবার কেউ কেউ আছেন তারা সেটা বিলিয়ে দিয়ে আনন্দ উপভোগ করেন। এ বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যে একটা বিশাল আনন্দ আছে যে আনন্দটা মানুষকে সৃষ্টির একটা প্রেরণা দেয়। এখানে ধনসম্পদে সৌভাগ্যবান হওয়ার পেছনেও কিন্তু স্রষ্টার একটা হাত রয়েছে এবং স্রষ্টা সেই ধনী ব্যক্তির সৃষ্টিতে অকুণ্ঠভাবে আশীর্বাদ বা সহায়তা করেন বলেই সৃষ্টি পরম রূপ লাভ করে এবং সেই সৃষ্টি থেকে তার ধনসম্পদ দিন দিন বাড়তে থাকে। পৃথিবীতে এমন অনেক লোক আছে যারা তাদের ধনসম্পদের সবটুকুই মানব কল্যাণে ব্যয় করে গেছেন বিভিন্ন ট্রাস্ট বা সেবামূলক কর্মের মাধ্যমে। আবার অনেকে আছেন যারা তাদের ধনসম্পদকে কুক্ষিগত করে রাখতে গিয়ে ধনসম্পদ কোথায় রয়েছে তার বংশধররাও কেউ জানতে পারেনি। ধর্ম এমন একটা জিনিস সেটা মানুষের মনকে পবিত্রতা এনে দেয়। মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সৃষ্টি করে। মানুষ মানুষকে হিংসা না করতে শেখায়। একে অপরের প্রতি পরম প্রেমানন্দ বিলিয়ে দেওয়ার জন্য ধর্মই শিক্ষা দিয়ে থাকে। হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলাম, খ্রিস্টান, পার্শি, জৈন, শিখ সব ধর্মেরই মূল কথা প্রায় একই এবং সেই মূল কথার প্রতিপাদ্য জিনিস যেটা সেটা হলো ‘কখনো মিথ্যা বলবে না, পারলে নিজেকে পরোপকারে ব্রতী কর, কারও কোনো অনিষ্ট কর না। দরিদ্রের সম্পদ লুণ্ঠন না করে নিজের যে সম্পদ আছে তা দরিদ্রের মধ্যে বিলিয়ে দাও। রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন না করে রাষ্ট্রকে আরও সম্পদশালী করতে নিজে সচেষ্ট হও।’ এ ব্যাপারে মাদার তেরেসার সেই বিখ্যাত উক্তি ‘রোব, রোব ্ রোব, টহঃরষ রঃ যঁৎঃং’ প্রণিধানযোগ্য- জগতের প্রত্যেকটা মানুষ যদি নবীজী (সা.)-এর সেই আদর্শ অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার উপদেশ মেনে চলতেন এবং সবাই যদি স্বীয় ধর্মের প্রতি অবিচল থাকতেন, তাহলে শুধু ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম নয়, একই ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের মধ্যে আজ হানাহানি হতো না। এ ব্যাপারে প্রকৃতির অর্থাৎ এ পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মান্তরিতের কাহিনী দেখে মনে হয় : ‘মানুষ, প্রলোভিত, প্ররোচিত অথবা প্রতারিত হয়ে বা প্রতারণা করার জন্যই শুধু ধর্মান্তরিত হয়।’

শেষ কথা আমার পরম শ্রদ্ধেয় কালামজী সম্পর্কে, তিনি তার রাষ্ট্রপতি শপথ অনুষ্ঠানটি কীভাবে সাজিয়েছিলেন তা দেখলেই বোঝা যায় শুধু শিশু নয়, সব ধর্মকে সমানভাবেই ভালো বাসতেন। তার মতে, ‘২৫ জুলাই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের অতিথি তালিকা তৈরি করা এক বিভ্রান্তিকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। সংসদের সেন্ট্রাল হলে মাত্র ১০০০ জনের স্থান সংকুলান সম্ভব। সংসদের সদস্য, রাজ্যসভা-লোকসভার অফিস বেয়ারা, স্বরাষ্ট্র এবং অন্যান্য মন্ত্রিসভার আমলা, বিদায়ী রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণের অতিথিদের বাদ দিয়ে আর মাত্র ১০০ জনের জায়গা হতে পারে। যা টেনেটুনে ১৫০ এর মতো করা হয়েছিল। সেই ১৫০ জনের মধ্যে কে থাকবে সে এক সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। পারিবারিক বন্ধুর সংখ্যাই ৩৭। তার মধ্যে আমার পুরনো পদার্থবিদ্যার শিক্ষক অধ্যাপক চিন্নাদুরাই যেমন ছিলেন তেমনি মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক কেভি পানদালাই, রামেশ্বরম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত পক্ষীভেঙ্কট সুব্রাহ্মনিয়ম শাস্ত্রীগল, রামেশ্বরম মসজিদের ইমাম নুরুল খুদা, রামেশ্বরম চার্চের রেভারেন্ড এজি লিওনার্ড এবং অরবিন্দ আই ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা চক্ষু বিশারদ ডা. জি বেঙ্কটস্বামীও ছিলেন। অতিথিদের মধ্যে আরও ছিলেন নৃত্যশিল্পী সোনাল মান সিং, ছিলেন শিল্পপতি, সাংবাদিক এবং ব্যক্তিগত বন্ধুরাও। খুব তাৎপর্যপূর্ণভাবে আমার অতিথি তালিকায় দেশের বিভিন্ন রাজ্যের ১০০ জন শিশুকে আনা হয়েছিল। তাদের জন্য আলাদা করে জায়গার ব্যবস্থা ছিল। বড়দের নিযুক্ত করা হয়েছিল তাদের দেখাশোনার জন্য। সে দিনটা বেশ গরম ছিল কিন্তু প্রত্যেকেই ঐতিহাসিক সেন্ট্রাল হলের অনুষ্ঠানে যোগদান করার জন্য বিধিসম্মত আনুষ্ঠানিক পোশাক পরিধান করেছিলেন।’

২০০২ সালের আগস্ট মাসে অর্থাৎ গুজরাট দাঙ্গার কয়েক মাস পরে ভারতের একাদশতম রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম ওই এলাকা পরিদর্শনে যান। এটা ছিল তার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর ব্যাপার। যেই গুজরাট মহাত্মা গান্ধী, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল এবং বিক্রম সারা ভাইয়ের মতো মহান ব্যক্তিদের জন্ম দিয়েছে, সেই রাজ্যের ক্ষতস্থানে প্রলেপ দেওয়ার জন্যই তিনি ওই সময়ে গুজরাট গিয়েছিলেন। সেখানে এ মহান ব্যক্তির মানবতার প্রতি উক্তি- ‘প্রত্যেক ব্যক্তির তার নিজের ভাষা সংস্কৃতি এবং ধর্ম বিশ্বাসের অনুশীলন করার মৌলিক অধিকার আছে। আমরা কোনোভাবে তা বিঘিœত করতে পারি না।’ এ প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ছে দার্শনিক রুমির সেই বিখ্যাত উক্তি- ‘দেবদূত মুক্ত কারণ তার আছে জ্ঞান,/ অজ্ঞানতার জন্য পশুও মুক্ত,/এই দুই এর মাঝে সংগ্রাম করে মানব সন্তান।’  মানব সন্তানকে, বিবেক কখনো বন্দী আবার কখনো মানুষ নামক পশুর সঙ্গে সন্ধি করে হানাহানিতে লিপ্ত করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয় না।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর