২৫ নভেম্বর, ২০১৫ ১০:৫১
পর্যবেক্ষণ

জঙ্গিবাদ দমনের একমাত্র পথ গণতন্ত্র

আমীর খসরু

জঙ্গিবাদ দমনের একমাত্র পথ গণতন্ত্র

বাংলাদেশ অধিকাংশ সময়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে খবর হয় তার নেতিবাচক ঘটনাবলির জন্য, ইতিবাচক সব অর্জন ও ঘটনা খুব কম ক্ষেত্রেই সংবাদমাধ্যমের খবরের স্থান দখল করতে পারে। দুর্ভাগ্য যে, দেশটি খবর হয় দৈব-দুর্বিপাক, কোনো বিপর্যয় বা খারাপ খবরের জন্যই। আগে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বন্যাসহ এ-জাতীয় বিপর্যয়ের খবরই ছাপা হতো, তবে গেল কিছু দিন ধরে এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যে খবরাখবর এবং বিশ্লেষণ প্রকাশিত হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাপারে, তা জঙ্গিবাদের উত্থান সম্পর্কিত বিষয়াবলি। এ নিয়ে দেশবাসীর কী অবস্থা তার বয়ান না দিলেও, প্রবাসে বাংলাদেশিরা কতটা অস্বস্তিতে আছেন, তা সহজেই আন্দাজ করা যায়। আর আমাদের ভাবমূর্তিগত সংকটেরই বা কী হাল হয়েছে তা-ও বোধ করি বোঝা যাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক প্যারিসের ঘটনা। কোনো বাংলাদেশি ওই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত না হলেও উদার মুসলিম  দেশটিও যে এখন বিপদের মুখোমুখি তা নিজ দেশে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা ঘটার পরই স্পষ্ট হয়ে গেছে। বাংলাদেশে আইএস বা আল-কায়েদার ভারতীয় শাখার অস্তিত্ব আছে কি নেই, এ প্রশ্নটিই হামেশা উঠছে। ওঠার কারণ, দুই বিদেশি নাগরিক- ইতালির তাভেলা সিজার ও জাপানের হোশি কোনিওকে গুলি করে হত্যা, শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলায় হতাহতের ঘটনা, ঢাকার অদূরে একজন পুলিশ সদস্যকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএস। সবশেষ ইতালির আরেক নাগরিক খ্রিস্টান যাজক পিয়ারো পারোলারিকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করে হামলার ঘটনার দায়ও আইএস স্বীকার করেছে। ২৮ সেপ্টেম্বর তাভেলা সিজারকে হত্যার পর ১৮ নভেম্বর পিয়ারো পারোলারির ওপর হামলা- কোনো ঘটনারই কূলকিনারা করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারা একযোগে কোরাস গেয়ে যাচ্ছে দেশে আইএস নেই। এর মধ্য দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে যে জঙ্গিগোষ্ঠী রয়েছে তাদের হালহকিকত কী, সে বিষয়টিরও এখন আর কোনো খোঁজখবর পাওয়া যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে দু-এক জনকে ধরা হয়, কিন্তু বাকিদের কী অবস্থা এবং তাদের বিরুদ্ধে অভিযানেরই বা কী পরিস্থিতি, তার কোনো খবরাখবরই মিলছে না। তবে আইএস বা আল-কায়েদার ভারতীয় শাখা নেই- এমন কথা সরকার বলেই যাচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে বার বার বলা হচ্ছে এবং সতর্ক করা হচ্ছে ওইসব জঙ্গি সংগঠন সম্পর্কে। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানটি পুরোপুরি ভিন্ন। তারা যত জোরে বলা যায় তত জোরেই বলছে যে, দেশে আইএস বা আল-কায়েদার ভারতীয় শাখার কোনোই অস্তিত্ব নেই। একের পর এক ব্লগার হত্যার সময় এ কথা বলা হয়েছিল। সাম্প্রতিক ঘটনাবলির ক্ষেত্রেও সরকারের বয়ান একই। একটি ঘটনা ঘটে তখন যে কথা বলা হয়, এর পরে যখন আবার আরেকটি ঘটনা ঘটে তখন আগের বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি করা হয়। এ কারণেই গণজাগরণ মঞ্চসহ অনেকের পক্ষ থেকেই এ প্রশ্নটি উত্থাপিত হচ্ছে যে, এর পরে কে? এর মধ্যে আতঙ্ক যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত। সরকার বরাবরই বলছে ষড়যন্ত্রতত্ত্বের কথা। এতদিন ইনিয়ে-বিনিয়ে বললেও প্রধানমন্ত্রী ৮ নভেম্বর যে সংবাদ সম্মেলন করেছেন তাতে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, ষড়যন্ত্রটি কত বিশাল এবং বড় মাপের। তিনি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দিয়ে যা বলেছেন তার মোদ্দা কথা হচ্ছে, ‘আইএসের কথা স্বীকার করিয়ে নিতে পারলে তারা বাংলাদেশের ওপর হামলে পড়তে পারে’। এই ‘তারা’ যে আন্তর্জাতিক কোনো কোনো শক্তি এবং ইঙ্গিতটি তাদের প্রতিই করা হয়েছে তা সহজেই বোঝা যায়। আর কাদের কথা বলতে চেয়েছেন তা-ও মোটামুটি স্পষ্ট। এ অনুমান যদি সত্যি হয় তাহলে ঘটনা গুরুতর। এই শক্তির বিরুদ্ধে কি প্রধানমন্ত্রী দেশে আইএস বা আল-কায়েদার অস্তিত্ব নেই বলে প্রতিরোধ ঘোষণা করেছেন? তা ছাড়া সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘চক্রান্তকারীদের বহু পরিকল্পনা আছে। তারা আরও বেশি দূর যেতে চায়’। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, একের পর এক যে ঘটনাগুলো ঘটছে তা কি সব ওই আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ? দেশে জঙ্গি বা এমন কোনো শক্তির আসলে কি অস্তিত্ব নেই? যদি চক্রান্তের ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ না থাকে এবং তথ্য-প্রমাণাদি থেকে থাকে তাহলে কেন এ চক্রান্ত প্রতিহত করা হচ্ছে না ও কেনই বা এমন একটি গুরুতর বিষয়কে অভিযোগ হিসেবেই প্রচার করা হচ্ছে? একটি বিষয় বলতেই হবে, জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে সরকার যে অবস্থান গ্রহণ করেছে তা কতটা বাস্তবসম্মত সে বিষয়টিও পুনরায় ভেবে দেখতে হবে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক চক্রান্তের যে গুরুতর অভিযোগ প্রধানমন্ত্রী করেছেন তা তিনি কি এককভাবে সামাল দিতে চাচ্ছেন? যদি তাই হয় তাহলে বলতেই হবে, সরকার ভুল পথে এগোচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সবার আগে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সমবেত ও ঐক্যবদ্ধভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা। এ কারণেই সংলাপের প্রশ্ন উঠেছে। আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ফরেন পলিসিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশবিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক লিসা কার্টিজ নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রকাশিত এক নিবন্ধে সংলাপ অনুষ্ঠানের তাগিদ দিয়েছেন। অন্যান্য নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরও মনোভাব তাই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সরাসরি সংলাপের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। তার সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, এ নাকচের কারণ সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক। এ জন্য তিনি তার ওই বক্তব্যের রাজনৈতিক পটভূমি এবং কারণও ব্যাখ্যা করেছেন। যদিও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য তাদের পক্ষের নিজস্ব বয়ান। এ বক্তব্যে যাদের বিশ্বাস নেই তাদেরও একটি দৃষ্টিভঙ্গি এবং বক্তব্য আছে। সে প্রসঙ্গে আলোচনা করা এ মুহূর্তে সমীচীন হবে বলে মনে করি না। তবে প্যারিস ঘটনা থেকে বাংলাদেশেরও শিক্ষণীয় হচ্ছে এই যে, ফ্রান্সের মতো উন্নত ও গণতান্ত্রিক দেশ যখন আইএসের হামলার শিকার হতে পারে, সেখানে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর ব্যাপারে আরও চিন্তাভাবনা করা উচিত।

কোনো একটি দেশে গণতন্ত্র সচল রয়েছে কিনা তার যে মাপকাঠি আছে তাতে একটি বিষয় হচ্ছে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে প্রতিযোগিতা, সংঘাত-সহিংসতার মাধ্যমে প্রতিপক্ষ দমন নয়। পাশের দেশ ভারতের প্রসঙ্গই যদি উল্লেখ করা হয় তাহলে দেখা যায় যে, কোনো বড় ধরনের বিপর্যয় বা ঘটনা ঘটলে, সঙ্গে সঙ্গে শুধু প্রধান বিরোধী দলই নয়, অন্যান্য দলকে নিয়ে সংলাপের আয়োজন করা হয় জাতীয় স্বার্থে। আর এটি করে থাকে ক্ষমতাসীন সরকার। এটাই হচ্ছে সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতি। কিন্তু এ দেশে চলে ঠিক তার উল্টো। এর বিপদটি হচ্ছে, সবকিছুকে ‘না বলার রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ (পলিটিক্স অব ডিনায়েল) শুধু ওই-সংশ্লিষ্ট সরকার বা দলের ক্ষতির চেয়েও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপদাপন্ন হয় দেশ এবং এর জনগণ। প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে সিরিয়া, মিসর, পাকিস্তানের উদাহরণও দিয়েছেন। এসব দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে দীর্ঘকালের গণতন্ত্রহীনতা এবং একনায়কতান্ত্রিক শাসনের কারণে। আর ওইসব দেশের শাসকরা ‘না বলার রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ চর্চার মাধ্যমে জঙ্গিবাদের উত্থানের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন।

তবে লেখাটি শেষ করতে চাই নোয়াম চমস্কি ও গিলবার্ট এখকারের গ্রন্থ প্যারিলাস পাওয়ার : দ্য মিডল ইস্ট অ্যান্ড ইউএস ফরেন পলিসি-ডায়ালগস অন টেরর, ডেমোক্রেসি, ওয়ার অ্যান্ড জাস্টিস গ্রন্থের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে (পৃষ্ঠা : ১৩)। তারা বলছেন, বিশ্বের অর্ধেক দেশের সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাবলি প্রয়োগ করে থাকে তার নিজস্ব জনগণকে অবরুদ্ধ এবং নিষ্পেষণের জন্য। আর এই ‘সংগ্রামে’ কে লাভবান হয় সেই প্রশ্নে তারা বলছেন, এতে সব শাসক ও শাসনযন্ত্রই আসলে লাভবান হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে বলা চলে, গণতন্ত্রবিহীন, কর্তৃত্ববাদী শাসকরা যে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয় তা নিশ্চিত করে বলা যায়। এ কথা মনে রাখতে হবে, যেসব দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি বিদ্যমান সেসব দেশে কখনই জঙ্গিবাদের ব্যাপক বিস্তার বা উত্থান সম্ভব হয় না। গণতন্ত্রহীনতার কারণে না বলার সংস্কৃতির পথ ধরেই জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভ করে। কাজেই গণতন্ত্রই হচ্ছে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের গ্যারান্টি- এ কথাটি মনে রাখতেই হবে। 

আমীর খসরু : সম্পাদক, আমাদের বুধবার ডটকম


বিডি-প্রতিদিন/ ২৫ নভেম্বর, ২০১৫/ রশিদা

সর্বশেষ খবর