৪ এপ্রিল, ২০১৬ ১৪:০১

সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলা ও আগামী দিনের বিশ্ব

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলা ও আগামী দিনের বিশ্ব

২২ মার্চ সকাল ৮টায় বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের প্রধান বিমানবন্দরে ভয়াবহ আত্মঘাতী জঙ্গি হামলা সারা বিশ্বের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের বড় ধরনের উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখে (৯/১১) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারের সেই ভয়ঙ্কর আক্রমণের পর এবারই প্রথম জঙ্গিরা হার্ড টার্গেট অর্থাৎ শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে ব্রাসেলস বিমানবন্দরের ভিতরে সফলভাবে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালাতে পেরেছে। এর মাধ্যমে আইএস, আল-কায়েদা তাদের নতুন সামর্থ্যের কথা সবাইকে জানিয়ে দিল। গত বছর ১৩ সেপ্টেম্বরে প্যারিস আক্রমণের সঙ্গে ২২ মার্চ ব্রাসেলসে আক্রমণের যোগসূত্র স্পষ্ট। ইউরোপের যে কোনো দেশে যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আইএস হামলা চালাতে পারে এমন পূর্বাভাস সব দেশই পেয়েছিল। হুমকির বিষয়টি প্রকাশ করায় মিডিয়ার মাধ্যমে সারা বিশ্ববাসী তা জেনেছেন। তাতে ধরে নেওয়া যায় প্রতিরোধমূলক সব ধরনের ব্যবস্থাও তারা নিয়েছিলেন। এত নিরাপত্তা ও সতর্কতার পরেও ব্রাসেলস বিমানবন্দরের আক্রমণ ঠেকানো যায়নি। একই কারণে আইএসও মনে করছে তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে এবং হুমকি দিয়েছে আগামীতে এ ধরনের আরও আক্রমণ চালানো হবে। লেখার পরবর্তী অংশে যাওয়ার আগে এ জায়গায় আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। তাহলো— ৯/১১-এর পরে এবং ব্রাসেলস বিমানবন্দরে হামলার আগে বিশ্বের অন্য কোথাও জঙ্গিরা হার্ড টার্গেটে আক্রমণ করতে না পারলেও পাকিস্তানে একাধিকবার হার্ড টার্গেটে বড় ধরনের সফল আক্রমণ চালাতে তারা সক্ষম হয়েছে। পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমান ঘাঁটিতে জঙ্গিরা সফল আক্রমণ চালিয়েছে। অবশ্য পাকিস্তানের অবস্থান ও পরিবেশ অন্যান্য দেশের থেকে ভিন্ন। আজকের যে জঙ্গিরা বিস্ময়ভাবে বিশ্বব্যাপী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তার উত্থান পর্ব শুরু হয় পাকিস্তান থেকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা ও পৃষ্ঠপোষকতায়। গত শতকের আশির দশকে সারা বিশ্বের জঙ্গিরা এসে আস্তানা গাড়ে পাকিস্তানে। সেখানে তারা অফিসের জায়গা, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র পায়। র‌্যাডিক্যালাইজেশন বা জঙ্গিয়ায়নের উর্বর ক্ষেত্র হয় পাকিস্তান, যা এখনো বহাল আছে। গত প্রায় দুই-তিন বছর ধরে পাকিস্তান ভালো জঙ্গি এবং মন্দ জঙ্গি নামে একটা দ্বিমুখী নীতি অনুসরণ করছে। মন্দ জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান, আর ভালো জঙ্গিদের তারা লালন-পালন করছে। এতে পাকিস্তানের অবস্থা আরও সঙ্গীন ও নাজুক হয়ে পড়েছে। ভালো জঙ্গি নামে লস্কর-ই-তৈয়বা, জঈশ-ই-মুহম্মদের মতো ভয়ানক উগ্রবাদীদের পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে, যার সাম্প্রতিক উদাহরণ জঈশ-ই-মুহম্মদের সদস্যদের দ্বারা ভারতের পাঠানকোট বিমান বাহিনী ঘাঁটিতে আক্রমণ। পাকিস্তান ভিন্ন কৌশলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত।

গত এক বছরে ঢাকার পাকিস্তান দূতাবাসের দুজন কর্মকর্তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জঙ্গি তত্পরতায় জড়িত থাকার কারণে স্বদেশে ফেরত যেতে বাধ্য হয়েছে। দ্বিমুখী নীতির কারণে জঙ্গি দমনে পাকিস্তানের কোনো সফলতা নেই। বরং প্রতিনিয়তই বিশ্ববিদ্যালয়, শিশুদের স্কুল ও খেলার মাঠ জঙ্গিদের হামলার শিকার হচ্ছে। যার সর্বশেষ উদাহরণ গত ২৭ মার্চ তেহরীকে-ই-তালেবান জঙ্গি সংগঠনের কট্টর অংশ জামায়াত-উল-আহরা কর্তৃক লাহোরের শিশুপার্কে আক্রমণ। ওই আক্রমণে নারী-শিশুসহ ৭২ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও প্রায় তিনশ। আশির দশকের শুরুতে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে (রাশিয়া) উত্খাতের মিশনে আমেরিকা, পাকিস্তান ও মধপ্রাচ্যের দেশসমূহের সম্মিলিত উদ্যোগে যে মুজাহিদ বাহিনীর সৃষ্টি হয় তারাই পরবর্তীতে আল-কায়েদা, তালেবান এবং অন্যান্য বহুবিধ ব্যানারে উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই জঙ্গিগোষ্ঠীসমূহের শেকড় আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন ১৯৯৮ সালে ফতোয়া জারি করেন এই মর্মে যে, আমেরিকান ও ইহুদিদের হত্যা করা সব মুসলমানের জন্য অবশ্য কর্তব্য। এ ঘোষণার ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালের আগস্ট মাসে কেনিয়া ও তানজেনিয়ায় অবস্থিত আমেরিকান দূতাবাসের ওপর একই দিনে আল-কায়েদা ভয়ঙ্কর আক্রমণ চালায়, যাতে প্রায় তিনশর বেশি মানুষ নিহত হয়। এরপর ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংস করে আল-কায়েদা। এ ঘটনার জের ধরে আল-কায়েদাসহ উগ্রবাদী ইসলামিস্ট জঙ্গি দমনের নামে বিশ্বব্যাপী আমেরিকার নেতৃত্বে শুরু হয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এ যুদ্ধ শুরু হওয়ার ১৬ বছর পর এসে যে যুদ্ধ এখনো চলমান আজকে আমরা এর কী পরিণতি দেখছি এবং বিশ্ব পরিস্থিতি আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে প্রসঙ্গত সেগুলোর ওপর একেক করে সংক্ষিপ্তভাবে একটু নজর বোলাই।

এক. আধুনিক ও উগ্র ধর্মান্ধমুক্ত দুটি দেশ ইরাক ও লিবিয়া আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব, আইএস-আল-কায়েদা উগ্রবাদী জঙ্গি ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সেক্টরিয়ান গ্রুপগুলোর বহুমুখী আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণে আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সিরিয়ারও প্রায়ই একই অবস্থা। এ তিনটি শক্তিশালী, সমৃদ্ধ এবং অভাব-অনটনহীন দেশ অচিরেই ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র আবির্ভাবের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আশঙ্কা সত্য হলে নতুন রাষ্ট্রগুলো আগামী দিনে মধ্যযুগের মতো নিজেদের মধ্যে সব সময় যুদ্ধ আর সংঘর্ষে লিপ্ত থাকবে। এর বিরূপ প্রভাব পড়বে সৌদি আরবসহ গালফ রাষ্ট্রগুলো এবং শক্তিশালী মিসর ও তুরস্কের ওপর। আরও পশ্চিমে আলজেরিয়া ও মরক্কোও শান্তিতে থাকতে পারবে না। তেল আহরণ, সরবরাহ ও উন্নয়নের নামে পশ্চিমা বিশ্বের যেসব নাগরিক তখন এই অঞ্চলে কাজ করবে তাদের রক্তে অহরহ লাল হবে আরব মরুভূমি। এমতাবস্থায় ইরানের আঞ্চলিক গুরুত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে। তবে একই সময়ে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠা ইসরায়েলকে একাই মোকাবিলা করতে হবে ইরানকে। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার মুসলমানপ্রধান দেশের ওপরও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। নিকট অতীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর একবার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরেকবার এবং এখন তৃতীয়বারের মতো মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে পরিবর্তন হতে যাচ্ছে।

দুই. ঔপনিবেশিক লেগেসি ও আরও বহুবিধ কারণে ইউরোপ থেকে কয়েক হাজার সদস্য ইরাক-সিরিয়ায় এসে আইএস বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। এদের একটি অংশ আবার প্রশিক্ষণ নিয়ে ইউরোপে ফেরত গেছে। এরাই আজ ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিরিয়ার এক কোটি উদ্বাস্তু ও শরণার্থী আজকে যে মহা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে সেটি আগামীতে ইউরোপের নিরাপত্তার সংকট আরও বৃদ্ধি করবে। বারাক ওবামাসহ তার সামরিক কমান্ডাররা বলছেন আইএসের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হবে।

তিন. ইরাক-সিরিয়ার বর্তমান ভূখণ্ড থেকে আইএসকে সম্পূর্ণভাবে উত্খাত ও পরাজিত করতে হলে সামরিক বাহিনীর স্থল অভিযানের প্রয়োজন হবে। তাতে যে আকারের বেসামরিক লোকজন হতাহত হওয়ার আশঙ্কা আছে সেটি আরও বড় আকারের মানবিক বিপর্যয় ঘটাতে পারে। চার. উত্তর-পূর্ব আফ্রিকায় জঙ্গিরা শক্তিশালী অবস্থানে আছে এবং ক্রমশ তাদের বিস্তার ঘটছে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তান ব্যতীত দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্য কোনো দেশে উগ্রবাদী জঙ্গিরা এখনো শক্ত ঘাঁটি গাড়তে পারেনি। তবে ভবিষ্যতের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ইরাক-সিরিয়ায় আগামীতে আইএসের ওপর সামরিক চাপ বৃদ্ধি পেলে আপাত কৌশল হিসেবে এসব যোদ্ধা সব মুসলমানপ্রধান দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আইএস, আল-কায়েদাকে যদি সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা না যায়, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশসমূহ থেকে যদি উগ্রবাদী ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির অবসান ঘটানো না যায় তাহলে এসব দেশের অভ্যন্তরে আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের নাগরিক ও সম্পদ সব সময় নিরাপত্তার হুমকিতে থাকবে। আইএস, আল-কায়েদাসহ জঙ্গি সংগঠনগুলো এবং ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মের নামে যা করছে তাতে পবিত্র ধর্ম ও মুসলিম সম্প্রদায় বিশ্বব্যাপী হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছে। এমন বর্বরতার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই, এ কথা একাধিকবার বিশ্বের বড় বড় ইসলামিক গ্র্যান্ড মুফতিরা বলেছেন। এ উগ্রবাদী ধর্মাশ্রয়ী জঙ্গিগোষ্ঠী ও তাদের রাজনৈতিক প্রশ্রয়দাতাদের প্রতি বিশ্বের মোট মুসলমানদের অতি সামান্য সংখ্যক মানুষের সমর্থন রয়েছে, যা জনসমর্থনের বিবেচনায় একেবারে নগণ্য। তবে একটি অসুবিধা হলো— স্ব-স্ব দেশীয় মূল স্রোতের রাজনৈতিক দলগুলো সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য অনেক সময় এদের কাজে লাগাতে চান। তবে ২০০৫ সালে ২১ জুলাই লন্ডনের পাতাল রেলে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনাকারীদের একজন তার জবানবন্দিতে যে কথা বলেছেন তার প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বকে দৃষ্টি দিতে হবে। হুসেন ওমর নামের ওই জঙ্গি বলেছেন—“Religion had nothing to do with this. We watched films. We were shown videos with images of the war in Iraq. We were told we must do something big. That’s why we met.” (সূত্র : অরুন কুন্দনানি— দ্য মুসলিমস্ আর কামিং, দিল্লি-২০১৪, পৃ।-১১৫)। একবিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তি, শিক্ষা, বিজ্ঞানের যে শক্তি তাতে উগ্রবাদী জঙ্গি ধর্মাশ্রয়ী শক্তি বিশ্বের কোথাও পরিপূর্ণ সফলতা পাবে না। তবে আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব যদি সাপ ও ওঝার দ্বিমুখী খেলা ত্যাগ না করে তাহলে বিশ্বব্যাপী চলমান রক্তক্ষরণ থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো পথ নেই। পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া তার আগের পরাশক্তির মর্যাদা ফিরে পাওয়ার লড়াইয়ে সফল হলে তার সঙ্গে উদীয়মান পরাশক্তি চীন যদি সম্মিলিত অবস্থানে দাঁড়ায় তাহলে বিশ্বব্যবস্থায় একটা নতুন ভারসাম্য আসলেও আসতে পারে। তবে যে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে তাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব মানচিত্র ও ব্যবস্থায় যে নতুন চিত্র দেখা যায় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সেটি আরও যেভাবে নতুন আকার ধারণ করে সেখান থেকে আগামীতে বিশ্বব্যবস্থা যে আরেকটি টার্ন নেবে তা প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায়।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর