শিরোনাম
২৩ জুলাই, ২০১৮ ১৭:০৯

বিশ্বের বৃহত্তম ভারতীয় ভিসা সেন্টার কেন বাংলাদেশে?

হাসান ইবনে হামিদ

বিশ্বের বৃহত্তম ভারতীয় ভিসা সেন্টার কেন বাংলাদেশে?

প্রতীকী ছবি

ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং ১৩-১৫ জুলাই তিন দিনের সরকারি সফরে শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকা আসেন। দু’দেশের মধ্যে নিয়মিত হওয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের ৬ষ্ঠ বৈঠকে অংশ নিতেই তার এই ঢাকা সফর। ভারত-বাংলাদেশ এর রুটিন ওয়ার্কের অংশ হিসেবেই রাজনাথ সিং এই সফর করে গিয়েছেন। তবে এই সফরকে শুধু নিয়ম রক্ষার সফর হিসেবে ভাবলে ভুল হবে। দুই প্রতিবেশী দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে নিরাপত্তা সহযোগিতা, বিশেষ করে সন্ত্রাসবাদ দমনে সহযোগিতা, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, অস্ত্র, মাদক ও অবৈধ মুদ্রা পাচারসহ আন্তসীমান্ত অপরাধ দমনের বিষয়গুলো এই সফরে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। দু’দেশের মধ্যে যাতায়াত আরও সহজ করা এবং রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়টিও আলাদাভাবে উঠে এসেছে। 

বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারলাম, তরুণদের উগ্রপন্থায় দীক্ষিত করতে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা রোধের বিষয়ে দুই মন্ত্রী বিশদ আলোচনা করেছেন। নিঃসন্দেহে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেননা উভয় দেশেই চরমপন্থা মাথাছাড়া দিয়ে উঠছে এবং তরুণদের বিভ্রান্ত করেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এই কাজ করছে। এমনকি গত বছরের আগস্টের পর থেকে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়ায় তাদের উগ্রপন্থায় পরিচালিত করার ঝুঁকির বিষয়টিও আলোচনায় উঠে এসেছে । বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের হত্যা বন্ধের প্রসঙ্গটিও আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে। 

উল্লেখ্য, এবার ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরটা এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন গত ছয় মাসে ভারতের সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে একজনও প্রাণ হারায়নি। এ ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আলোচনায় ভারত থেকে অপরাধী ও বন্দী প্রত্যর্পণের প্রসঙ্গটি তোলা হয়েছে। পক্ষান্তরে ভারতের পক্ষ থেকে গরু, অস্ত্র, গোলাবারুদ, মাদক পাচার বন্ধের পাশাপাশি অবৈধ ভারতীয় মুদ্রা পাচারের প্রসঙ্গগুলো এসেছে। এ ক্ষেত্রে আন্তসীমান্ত অপরাধ রোধে যেসব প্রক্রিয়া রয়েছে, তা আরও জোরালো করার তাগিদ দিয়েছে ভারত। 

এই সফরের আলোচিত বিষয় হচ্ছে, বিশ্বের বৃহত্তম ভারতীয় ভিসা সেন্টার কেনো ঢাকায় হলো? অনেক সংবাদের শিরোনাম বা অনেকের বক্তব্য দেখে এই উপলব্ধি যে কারো আসতে পারে যে, এটা মহাঅন্যায় বা গর্হিত কাজ করেছে সরকার! বিস্তারিত না বুঝে বা বাস্তবতাকে স্বীকার না করে এই বক্তব্য আপনি দিতেই পারেন কিন্তু আপনি যখন ভালো করে এর প্রয়োজনটা উপলব্ধি করবেন, তখন আপনিও চাইবেন বৃহত্তম ভিসা সেন্টার এই দেশেই হোক। আমি বিষয়টা একটু খুলেই বলছি। 

গত ১৪ জুলাই শনিবার রাজধানী ঢাকার যমুনা ফিউচার পার্কে ভারতীয় একটি ভিসা আবেদন কেন্দ্র উদ্বোধন করেছেন ভারত ও বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। যা কিনা বিশ্বের সবচাইতে বড় ভারতীয় ভিসা সেন্টার। ঢাকার বিলাসবহুল শপিং-মল যমুনা ফিউচার পার্কে সাড়ে আঠারো হাজার স্কয়ার ফিটের মতো বিশাল জায়গা জুড়ে তৈরি এই ভিসা সেন্টারটি তৈরি করা হয়েছে। যা চালুর সাথে সাথে দুই ধাপে ঢাকার অন্যান্য ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। নতুন ভিসা সেন্টারটি দেখতে রীতিমতো পাঁচ তারা হোটেলের লবির মতো। এই কেন্দ্রে রয়েছে ৪৮ টি কাউন্টার, চা-কফির জন্য ভেন্ডিং মেশিন, হালকা খাবারদাবার বিক্রির স্টল, এবং বয়স্ক ব্যক্তি ও নারীদের জন্য আলাদা কাউন্টার। আগে যেখানে রাস্তাতেই দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে সেখানে নতুন এই কেন্দ্রে রয়েছে এয়ার-কন্ডিশনিং সম্বলিত আরামদায়ক ওয়েটিং রুম। সেখানে আবেদন জমা নেওয়ার জন্য রয়েছে আটচল্লিশটি কাউন্টার। প্রবীণ নাগরিক, মহিলা ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আলাদা কাউন্টারের ব্যবস্থা রয়েছে। ব্যবসায়িক ভিসার আবেদনের জন্যও পৃথক কাউন্টারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিদিন এখানে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার পাসপোর্ট গ্রহণ করা সম্ভব হবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বের সবচাইতে বড় ভারতীয় ভিসা সেন্টারটি কেন বাংলাদেশে হলো? কেনোই বা বাংলাদেশীদের এত আদর যত্নের দরকার পড়ছে? এর উত্তর কিন্তু আমাদের সবারই জানা। ভারতে যত বিদেশী পর্যটক যাচ্ছেন তার মধ্যে বাংলাদেশীরা শীর্ষস্থানে আছে। অর্থাৎ পর্যটন খাতে বাংলাদেশীদের কাছ থেকেই সবচাইতে বেশি মুদ্রা অর্জন করছে ভারত। শুধু তাই না, প্রচুর বাংলাদেশী ভারতে ব্যবসা চাকুরী করছে এবং সবচাইতে বেশি রেমিটেন্স ভারত থেকে নিয়ে আসছে বাংলাদেশীরাই। তাই শুধুমাত্র পর্যটনের উদ্দেশ্যে না বরং প্রতিনিয়ত তাদের যাতায়ত পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। তাই আমাদের যাতায়তের সুবিধে অসুবিধের সাথে আমাদের যেমন স্বার্থ জড়িত ঠিক তেমনি তাদেরও। আমরা ভিসার জন্য যে ভোগান্তির শিকার হই তার থেকে উত্তরণ ঘটবে এখন। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে, ই-টোকেন সিস্টেমে ভিসা পেতে যে সমস্যা হতো তা থেকে এখন মুক্তি মিলিবে আমাদের। বাংলাদেশে ভারতীয় ভিসার আবেদনকারীদের ‘ই-টোকেন’ সংগ্রহ করতে অপরিসীম ভোগান্তি ও অর্থদন্ড দিতে হতো। মধ্যবর্তী দালালরা হাতিয়ে নিতো বিপুল অর্থ। তাছাড়া ই-টোকেন পদ্ধতি নিয়ে বাংলাদেশে যে বিপুল অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল দিল্লী সে সম্পর্কে অনেক আগেই অবগত। তাই এই ভিসা প্রসেসকে সহজ ও দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা নেবার জন্যই তাদের এই উদ্যোগ। ভিসা ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ, সুসংহত এবং সহজলভ্য করে তোলার জন্যই এই ই-টোকেন ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশে তাদের লোকবলের তুলনায় ভিসাপ্রার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি বলেই বৃহত্তম ভিসা সেন্টার খুলার দরকার পড়েছে। বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে যাচ্ছেন তাদের সংখ্যা প্রচুর বেড়ে যাওয়াতে আগে যে ভিসা সেন্টারগুলো ছিল তাতে আর কুলোচ্ছিল না। সেজন্য নতুন করে এই ভিসা সেন্টার খোলা ছিলো সময়ের দাবি। 

ভারতে যাতায়তের ক্ষেত্রে যদি পরিসংখ্যান দেখেন তবেই বুঝতে পারবেন কেনো তা অতীব জরুরি ছিলো। গত বছর ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ভারতে সবচাইতে বেশি বিদেশি পর্যটকের যাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এমনকি যুক্তরাষ্ট্রকেও ছাড়িয়ে প্রথম অবস্থানে চলে এসেছে। ২০১৬-১৭ সালে বাংলাদেশে ১৫ লাখের মতো ভারতীয় ভিসা ইস্যু হয়েছে। এর একটি বড় অংশই মেডিকেল ভিসা। মেডিকেল ট্যুরিজম থেকে ভারতের যে আয় হয় তারও একটি বড় অংশ আসে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া চিকিৎসা প্রত্যাশীদের কাছ থেকে। মাত্র কিছুদিন আগেও ভারতের ভিসা পেতে বেশ ভোগান্তির শিকার হতে হতো বাংলাদেশিদের। সেটি সহজ করার জন্য নানা ব্যবস্থা নিয়েছে ভারত। তার আওতায় এখন পাঁচ বছর পর্যন্ত ভিসা দেয়া হচ্ছে। দফায় দফায় পরিবর্তন করা হয়েছে নিয়ম। আবেদন জমা দেয়া প্রক্রিয়া সহজ করা, এমনকি বিশেষ উৎসব মৌসুমে বাংলাদেশীদের আকর্ষণ করতে পর্যটকদের জন্য নানা সুযোগ সুবিধা ও অফারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেমন এইসব ব্যবস্থার মধ্যে আছে সীমান্ত চেকপোস্টে উষ্ণ ব্যবহার, চিকিৎসা সংক্রান্ত হয়রানির অভিযোগ জমা নেওয়া, হালাল খাবারের দোকান সম্পর্কে তথ্য দেয়া ইত্যাদি। এমনকি পশ্চিমবঙ্গ নেমেছে অন্য প্রদেশের সাথে প্রতিযোগিতায়। আর এর কারণই হল বাংলাদেশিরা ভারতে গিয়ে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করেন। বাংলাদেশেরা ভারতে যাচ্ছেন মূলত ঘুরতে, কেনাকাটায় ও ডাক্তার দেখাতে। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর হিসেবে ২০১৭ সালে টুরিস্ট ভিসায় ভারতে যাওয়ার জন্য ৬০ মিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা কিনেছেন বাংলাদেশিরা যা আগের বছরের তুলনায় বেশি। তাহলে এবার বুঝেন কেনো বৃহত্তম ভিসা সেন্টার খোলা দরকার ছিলো বাংলাদেশে! 

এই সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সারদায় ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী ভবন’ উদ্বোধন। সন্ত্রাস মোকাবেলায় দু’দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের এক নিদর্শন হচ্ছে এই মৈত্রী ভবন। বর্তমানে এই অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ অনেক ছড়িয়েছে। যা সবার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এই সন্ত্রাসবাদ দমনে পুলিশ বাহিনীকে আরো দক্ষ এবং পেশাদার করে গড়ে তুলার লক্ষ্যেই ২০১৫ সালে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন করেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে এই মৈত্রী ভবন। রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমিতে দুই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশ বিভাগের নতুন আইটি (ইন্টারনেট টেকনোলজি) এবং ফরেনসিক পরীক্ষাগারের ভবন উদ্বোধন করেন। এরপর পুলিশ বিভাগের উন্নয়নে দুই দেশের মধ্যে একটি সমাঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়।

তেরঙ্গা-লাল সবুজ সম্পর্ক এক অভিন্ন ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতি, পরিবার ও আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। বাংলাদেশরে স্বাধীনতা যুদ্ধে দুই দেশের সমন্বিত বাহিনী লড়াই করেছে, যা ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। দু’দেশের সৈনিকেরা একসঙ্গে রক্ত বিসর্জন দিয়েছে। ‘গণভবন থেকে জনপথ রোড’ এর এই বন্ধন ভ্রাতৃত্বের ও চিরন্তন এবং সময়ের পরীক্ষায় তা অটল থাকবে। আর এ সম্পর্কের বর্তমান অবস্থাকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে কাজ করছে দু’দেশ।

লেখকঃ রাজনৈতিক বিশ্লেষক। 

বিডি-প্রতিদিন/ ই-জাহান

সর্বশেষ খবর