৫ আগস্ট, ২০১৮ ১৬:৫৭

তবু কেন পুলিশ এত পর

মনিরুজ্জামান মানিক

তবু কেন পুলিশ এত পর

মনিরুজ্জামান মানিক

মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন অনেক বিজ্ঞজন, সুশীতল সমাজ! দুইফোঁটা বৃষ্টি পড়লে যারা মুখে খৈ ফোটান তাদের গভীর নীরবতা জাতিকে ভাবিয়ে তুলছে। তাঁরা কি পুলিশকে ভিলেন বানিয়ে মজা দেখছেন ! শুনেছি, দু'একজনের জন্মদাতাও নাকি পুলিশ ছিলেন। তাতে কী! বাবা তো এখন আর পুলিশে নেই। রেশনের পঁচা চাউলের ভাতের গন্ধও এখন আর নাকে শুকতে হয় না। ওপারে বসে তিনি ছেলের বেদনা কতটুকুই বা উপলব্ধি করবেন। কেউ পুলিশকে বকলেই কী, গায়ের পোশাক খুলে ফেললেই বা কার কী আসে যায়। পুলিশকে মার খেয়েছে শুনলে কার না ভাল লাগে!

কোন এক পুলিশ দিনাজপুরে আছাড় খেলো তাই শুনে ঢাকার পান দোকানি আক্কাছ মিয়া বললো, ‘আলহামদুলিল্লাহ, খুব ভালো হইছে, শুনেও আরাম পাইলাম।’ আমাদের নীতি, নৈতিকতা, মনন, ভাবনা এমন কি স্নায়ু পর্যস্ত পুলিশবিদ্বেষী হয়ে গেছে। পুলিশ কী এতই অপরাধী? অথচ পুলিশ ছাড়া কি আমাদের একটি দিনেও কি চলে? নাকি চলবে ভাবা যায়। নাকি রাষ্ট্র চলে! জীবনের সূচনায় পুলিশ, কিয়ামতের আগ পর্যন্ত পুলিশ। জন্ম মৃত্য বিয়ে এই তিনটি বিষয় বিধাতা নিজে নির্ধারণ করলেও তিনটি কার্য সম্পন্ন করতেই পুলিশকে ব্যবহার করতে হয়। গতিহীন মানুষের গতি তো পুলিশই দিয়ে থাকে। আর রাজনীতিক নেতার কাছে পুলিশ ঠিক টিস্যু পেপারের মতো। ক্ষমতায় থাকাকালে অতি আদর, ক্ষমতা হারালে নাই কদর, মানুষ টিস্যু পেপার ব্যবহারের পর ডাস্টবিনে ফেলে দেয়, কিন্তু কাজ শেষে তারা পুলিশকে ছুঁড়ে ফেলেন পায়ের নীচে, জুতার নীচে।

মায়ের গর্ভে ভালো সন্তানের পাশাপাশি কিন্তু হিজড়া সন্তানও জন্মে। ভালো সন্তানের জন্য মা গর্ববোধ করলেও হিজড়া সন্তানের জন্য মা আজীবন নীরবে নিভৃতে কাঁদেন। লোকলজ্জার ভয়ে কোনদিনও বুকে জড়িয়ে বলেন না, এটাও আমার সন্তান, আদরের ধন, আমার সোনা মানিক।

বড় অদ্ভূত মানব চরিত্র! সন্তান জন্ম দিয়েও মা নিজকে পাপী ভেবে নিজের নাড়িছেঁড়া ধনকে অস্বীকার করেন। আর নিখুঁত সন্তানকে আজীবনই বুকে আগলে রাখেন। আমার কথায় কেউ সন্দেহ পোষণ করলে তৃতীয় লিঙ্গ জন্মদাত্রী অন্তত একজন মাকে পুরো বাংলাদেশ খুঁজে বের করে প্রমাণ দেখান। আমার তো মনে হয় পাবেন না। যে মা সমাজের ভয়ে দশ মাস দশদিন গর্ভে লালিত সন্তানকে অস্বীকার করেন, সে সমাজে হিজড়া সন্তানের স্বীকৃতি কে দিবে?

সেদিন এক ভদ্রলোক ফেসবুকে লিখেছেন, বৃদ্ধ মায়ের বিয়ের আগের অবৈধ সন্তানটি নাকি পুলিশে চাকরি করে! তার মানে পুলিশ হিজড়া সন্তানের চাইতেও অধম? এমন কথা জারজ সন্তান ছাড়া কি কেউ বলতে পারে নাকি লিখতে পারে? কোন শিক্ষিত লোকের মুখের ভাষা কি এত নোংরা হয়?

চলমান ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনে লিপ্ত আমাদের সোনামণিদের কারও কারও ভাষা ‘অতুলনীয়।’ মনে হয় রসময় গুপ্তের চটি বইয়ের ভাষার চাইতেও যৌন উত্তেজক। রসময় গুপ্ত বেঁচে থাকলে হয়তো কিছু শব্দ এদের কাছ থেকে কড়া দামে কিনে নিতেন!

আমাদের ডিজিটাল সন্তানেরা স্মার্টফোনের বদলে অল্প বয়সে আমের কার্বোহাইড্রেটের মতো বড্ড অসময়ে পেঁকে গেলেও আমি হলফ করে বলতে পারি এমন রুচিহীন ভাষা আমাদের সোনামণিদের মুখে কখনোই আসতে পারে না। ভদ্রতার আড়ালে ওদের এমন অসভ্যতা কে শিখাচ্ছে খুঁজে বের করা অতীব জরুরি।

আমার সন্দেহ একটি কুচক্রী মহল কোমলমতি বাচ্চাদের দিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা করছেন। যে প্ল্যাকার্ড নিয়ে ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলো রাস্তায় দাঁড়িয়েছে তারা চোখের জ্যোতিহীন আলোতে ওরা দেখতেই পায়নি প্ল্যাকার্ডে কী লেখা। ওদের হাতে এসব নোংরা নির্লজ্জ প্ল্যাকার্ড কে ধরিয়ে দিলো? তাদের খুঁজে বের করা নীতিবান অভিভাবকের দায়িত্ব বলে আমি মনে করি। পুলিশ তাদের অবশ্যই সাহায্য করবে।

আমরা তো আমাদের সন্তানদের এমন শিক্ষা দেইনি যে জাতির সামনে বাবা মায়ের সন্মান ধূলোয় মিশিয়ে দিয়ে মাথা হেঁট করে দিবে !

পুলিশের যদি আন্দোলন করার ক্ষমতা থাকতো তাহলে সবার আগে নিজের জীবনের অস্তিত্ব রক্ষা করতেই নিরাপদ সড়কের আন্দোলন করতো। তার বিস্তর কারণ। প্রতিদিন প্রতিক্ষণ মানুষের চলার পথকে সুগম করতে গিয়ে কতো পুলিশ নীরবে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে পরপারে চলে গেছেন তার সব খবর কি পত্রিকার পাতায় আসে? কে রাখে ঐসব মানবিক পুলিশের খোঁজ, যে কিনা অসহায় পথচারীকে পথ পার করে দিয়েই সোজা চলে গেছেন না ফেরার দেশে। শুনে হয়তো অবাক হবেন। দেড় লক্ষ পুলিশের মধ্যে কম করে হলেও প্রায় ৩০ হাজার পুলিশ অর্ধ পঙ্গু। সড়ক দুর্ঘনায় আহত হয়ে পায়ে কিংবা হাতে লোহার রড লাগিয়ে তারা বেঁচে আছে। প্রতিদিন মানুষের জন্য শ্রম বিলিয়ে দিয়ে কোনোক্রমে প্রাণ বাঁচিয়ে ছেলে মেয়েদের অন্নের জোগান দিচ্ছেন। আর যারা পরপারে চলে গেছেন তারা তাদের পরিবারের সারাজীবনের অবলম্বন করে গেছেন কান্না। অনেকে আবার পুলিশকে আজীবনের জন্য ছুটি দিয়ে সংবিধান থেকে মুছে ফেলতে আগ্রহী। অতি উৎসাহী কেউ কেউ আবার পুলিশের বিলুপ্তিই চাচ্ছেন। কিন্তু কেন?

পুলিশ কি কোনোদিন হত্যা ক্যু করে দখল করতে চেয়েছে সিংহাসন? নাকি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করতে চেয়েছিল?

স্বাধীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাংলাদেশ পুলিশের অবদান অনস্বীকার্য। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে পুলিশের অকুতোভয় যোদ্ধারাই সেদিন সবার আগে দেশের তরে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করে মসনদ আরোহণের অভিলাস অন্তত পুলিশ বাহিনীর কোনো স্তরের অফিসারেরই নেই। একথা চির সত্য, অকাট্য সত্য।

আধুনিক পুলিশের চিন্তা চেতনা মানবিকতা বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। শান্তির দূত হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশ সারা বিশ্বে বিশেষ সুনাম অর্জন করেছে। না জেনে, না বুঝেই অনেকে পুলিশকে অশিক্ষিত বলে কটাক্ষ করেন। অসম্মানের অপচেষ্টা করেন। কী নেই বাংলাদেশ পুলিশে?

ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার, ডক্টরেট ডিগ্রিধারী সবই আছে। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রথম পছন্দ অর্জন করে উর্দি গায়ে জড়িয়ে পুলিশ অফিসার হতে নয়, তারপরও বলবেন, পুলিশ অশিক্ষিত?

আন্দোলনের ইস্যু ছিল সড়ক দুর্ঘটনা, তারপর নিরাপদ সড়কের প্রত্যাশা। প্রতিপক্ষ ছিল ঘাতক বাস চালক ও তাদের মালিক সমিতি, আর মন্ত্রী মহোদয়ের চির সবুজ পেপসোডেন্ট হাসি। পুলিশের দায়িত্ব ছিল দুর্ঘটনা সংগঠনকারী নর ঘাতকে ধরে আদালতের কাঠগড়ায় হাজির করা। পুলিশ কি ব্যর্থ হয়েছে?

মোটেই না! বরং আসামি মাটির নীচে লুকাবার আগেই নর ঘাতকদের গ্রেফতার করছে পুলিশ। ছাত্র সমাজ তাদের সহপাঠীদের বিয়োগ ব্যথায় শরীক হলো। রাত না পোহাতেই পরিরহনের মালিক শ্রমিকের পরিবর্তে পুলিশ ছাত্র সমাজের প্রতিপক্ষ বনে গেল।

এ কেমন কথা! পুলিশের দোষটা কোথায়? সিনেমার কাহিনীর মত দুধের বাচ্চারা রাতারাতি বনে গেল পুলিশ অফিসার। প্রথমেই ছোঁ মেরে তারা ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব হাতে তুলে নিলো। সারা জীবনে পুলিশ যা করতে পারেনি ওরা তাই করে দেখালো। মন্ত্রী মিনিস্টার, জজ ব্যারিস্টার এমনকি সেনাবাহিনী পর্যন্ত কেউই ওদের হাত থেকে রেহাই পেলো না! সবাইকে ওরা বুঝিয়ে দিলো কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়! কিন্তু নতুন জাতি গঠনে নতুন কিছু দীক্ষা নেওয়ার আগেই শুরু হলো নৈরাজ্য! ওরা কবে আবার স্কুল-কলেজে ফিরে গিয়ে লেখাপড়ায় মনোযোগী হবে কে জানে!

কার কুটচালে একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন নৈরাজ্যে পরিণত হলো? তার ব্যাখা তো পুলিশের কাছেও নেই। এক বুক আশা নিয়ে ধৈর্য্যের অগ্নিপরীক্ষা দিতে বসেছিল পুলিশ। দুই টাকার ঘুষের অপবাদ নিয়ে আগামী প্রজন্মের কাছ মুখ লুকাতে চেয়েছিল। অথচ গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, কয়লা, কর, ভূমির মত শত শত অফিসের কেরানিই ফাইল আটকিয়ে যেখানে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তোলা লাখ টাকা থুতু দিয়ে গুণে নেন, সেখানে পুলিশ ভিক্ষুকের মত হাত উঁচিয়ে দুই টাকা নেওয়ার লজ্জা ঢাকতেই অনুশোচনার অগ্নিদাহে পুড়ে মরতে বসেছিলেন। বেলা শেষে জানা গেল, আন্দোলনকারী জনৈক ছাত্র কোনো এক স্মার্ট সুন্দরী ম্যাডামের গাড়ি আটকিয়ে নগদ এক হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বুঝা গেল, পাপের রাজ্যে মাসুম বাচ্চাও নিরাপদ নয়। সেখানে নরকে বসে নরকের কীটরা কতটা ঘুষমুক্ত, ঝুঁকিমুক্ত থাকবে?

বিনা কারণে অনুজ সহকর্মীকে আধামরা অবস্থায় দেখতে পেয়ে বিস্মিত হয়েছি। তার ব্যবহৃত সরকারী মোটর সাইকেলটির আগুনে পোড়া। ধোঁয়ার গন্ধে মনটা জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। এখনো মন পুড়ছে অগ্নিদাহের অগ্নিশিখায়। যতদিন পুলিশের পোশাক গায়ে জড়িয়ে রাষ্ট্রীয় কর্তব্য মনে করে সম্মানিত নাগরিকদের পাশে দাঁড়াবো, অতি সাধারণ নিরীহ মানুষের বিপদে অকাতরে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করবো ততদিনই এ ব্যাথা, এ অসন্মান, এ অপমান হওয়ার কষ্ট যেন ভুলে যাই।
 
নিষ্কণ্টক-মসৃন করে পুলিশ। তবু তারা মানুষ নয়, শুধুই পুলিশ। পুলিশের আবার আবেগ কী! তার মনের কষ্টের মূল্যই বা কী! আমি পুলিশ বলেই স্বজনহারা, বন্ধুহারা। আমার আগামীর পথের ঠিকানাও অজানা, জানি না আমার বাড়ি কই...?

লেখক : পুলিশ কর্মকর্তা, গাজীপুর জেলা

বিডি-প্রতিদিন/০৫ আগস্ট, ২০১৮/মাহবুব

সর্বশেষ খবর