সরকারি চাকুরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা সংস্কারের দাবিতে সারাদেশে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সামনে রেখে যে কুরুক্ষেত্র ঘটলো তা আমাদের কারোরই কাম্য নয়। এই তাণ্ডবকে একমাত্র একাত্তরের নৃশংসতার সাথেই তুলনা করা যায়।
বর্তমান চলমান কোটা বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা আসলেই বিস্তারিত জানেনা ৷ সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে সরকার সকল প্রকার কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে। এই পরিপত্রে সংক্ষুব্ধ হয়ে ২০২২ সালে মুক্তিযুদ্ধের সন্তানদের পক্ষ থেকে জারিকৃত পরিপত্রের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করে। মহামান্য হাইকোর্টের রায়ে সরকার কর্তৃক জারিকৃত পরিপত্র বাতিল করে দেয়। সরকার হাইকোর্টের রায়ের বিরূদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় স্থগিত করে এই বিষয়ে নিষ্পত্তির জন্য শুনানির দিন ধার্য করে। কিন্তু এরই মাঝে স্বাধীনতা বিরোধীরা কোটা সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে, গুজব ছড়িয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের নামে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সরকারের বিরুদ্ধে উসকিয়ে দিয়ে এক বিভীষিকাময় নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
শিক্ষার্থীরা যে অরাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা করেছিল, প্রাথমিকভাবে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের হাতে এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকলেও পরবর্তীতে সুযোগ সন্ধানীরা খুবই দ্রুত সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে এই আন্দোলনে স্বাধীনতা বিরোধী স্লোগান দিয়ে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিলো। যা পরবর্তীতে সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। সুযোগসন্ধানীরা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সামনে রেখে, টানা তিনদিন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়া এলাকায় যে হামলা, ভাঙচুর, নিপীড়ন, নির্যাতন, ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, সেই সম্পর্কে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ওয়ারী জোনের জনৈক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আমি ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের নাশকতা ও বর্বরতা দেখি নাই, কিন্তু আমি শনির আখড়ায় পাকিস্তানিদের প্রেতাত্মাদের ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছি।’
পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ, গত শনিবার ২০ জুলাই ঢাকা-নারায়নগঞ্জ লিংক রোডের সাইনবোর্ড এলাকায় হামলাকারীদের নির্যাতনের শিকার সোনালী নামে কর্তব্যরত এক নারী সাংবাদিকের ভাষ্যমতে, ‘তোরা সাংবাদিক-এই কথা বলেই হাজারো আন্দোলনকারী হামলা চালায়। গ্যাস লাইটার দিয়ে চেহারায় আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। টেনে হিঁচড়ে গায়ের পোশাক ছিঁড়ে ফেলে। পরে যৌন নির্যাতনের চেষ্টা চালায়।’
ঐ নারী সাংবাদিকের দাবি, বিএনপির নেতারা এই হামলার নেতৃত্বে ছিলেন। কর্মজীবনে বেশিরভাগ সময় তিনি বিএনপির নিউজ কাভার করায়, তিনি তাদের চিনতে পেরেছেন। এই নারী সাংবাদিকের ভাষ্যমতে কোটা বিরোধী আন্দোলনের নামে যে নাশকতা, হত্যাযজ্ঞ, নারী নির্যাতন হয়েছে, তা থেকে ৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের ধ্বংসযজ্ঞ ও নারী নির্যাতনের চিত্র ফুটে উঠেছে।
এই কয়দিনে সুযোগ সন্ধানীদের সৃষ্ট নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে প্রায় শতাধিক প্রাণহানি ঘটেছে, যা আমাদের কাম্য নয়। কিন্তু এটাও সত্য যে এছাড়া কোনও উপায় ছিল না। সারাদেশে অসংখ্য সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়েছে। যানবাহনে আগুন দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিভিশনে আগুন দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের আবেগের জায়গা, মেট্রোরেলকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। আমি সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি, কোমলমতি ছাত্র যারা কিছুই বোঝেনা তাদেরকে মিথ্যা বুঝিয়ে রাজপথে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্যমতে, রাজধানীর শনিরআখড়া এলাকায় সবচেয়ে নৃশংসতম ও দুঃখজনক সংঘাত হয়েছে। কর্তব্যরত এক পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করে ফুটওভারের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সেই স্পটে স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ে, ১০-১২ বৎসরের, এক আন্দোলনকারীকে ‘কেনো ইটা মারছো?’ জিজ্ঞাসা করা হলো, সে বললো, "আমি মাদ্রাসায় পড়ি, শেখ হাসিনা আমাদের মাদ্রাসায় পড়া বন্ধ করতে চায়’। অথচ ঐ কোমলমতি ছেলেটি জানেই না যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঞ্জেগানা নামাজী, তিনি অত্যন্ত পরহেজগার ব্যক্তি। তিনি নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করেন এবং তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করেন। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবনের কথা বিবেচনা করে, তিনিই কওমী মাদ্রাসার ডিগ্রিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলন যেসকল ছাত্রছাত্রী সম্পৃক্ত হয়ে স্লোগান দিয়েছে, "তুমি কে? আমি কে?-রাজাকার! রাজাকার!" ওদের বয়স ১৮-২০ বছর৷ স্বাধীনতাযুদ্ধের অনেক পরে ওদের জন্ম। স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলনকারী বাঙালি ছাত্রছাত্রীরা স্লোগান দিয়েছিলো, "তুমি কে, আমি কে?- বাঙালি! বাঙালি!! স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বাঙালি ছাত্রছাত্রীরাই স্লোগান দিয়েছে,‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!!’
ওরা নিশ্চয়ই জানেনা বাংলাদেশের ইতিহাসে কাদেরকে, কি কারণে রাজাকার বলা হয়? ঐ সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা জানেনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘রাজাকার’ কারা ছিলো? মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে রাজাকারদের ভূমিকা কত ঘৃণ্য ছিলো? ওরা জানেনা "রাজাকার" শব্দটি প্রতীকী হিসাবে ব্যবহার করে স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য এক শ্রেণীর ঘৃণ্য মানুষদের গালমন্দ করা হয়। পলাশীর যুদ্ধে সেনাপ্রধান মীরজাফর, নবাব সিরাজৌদ্দৌলার সাথে বেঈমানী করার কারণে বাঙালিরা পরাজিত হয়েছিলো, ফলে "মীরজাফর" শব্দটি ‘বেঈমান বা বিশ্বাসঘাতক’র সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, ঠিক তেমনিভাবে ‘রাজাকার’ শব্দটিও ‘নারী নির্যাতনকারী ও স্বাধীনতা বিরোধী‘ শব্দের সমার্থক শব্দ।
যে ছাত্রীরা মধ্যরাতে নিজেদের ‘রাজাকার’ পরিচয় দিয়ে গগনবিদারী স্লোগান দিল, ওরা জানেনা, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে এই রাজাকাররাই আমাদের যুবতী মা-বোনদের ধরে নিয়ে পাকিস্তানি হায়নাদের হাতে তুলে দিত।
কোটা আন্দোলন আসলেই কিসের আন্দোলন? এইটা কি মৌলিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন? এইটা কি গণমানুষের আন্দোলন? তাহলে এইটা কিসের আন্দোলন? এই আন্দোলনে প্রাণ দিতে হবে কেন? পুলিশ মারতে হবে কেন? সাংবাদিক মারতে হবে কেন? রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস করতে হবে কেন? মানুষের চলমান জীবন অচল করবে কেন? এই আন্দোলনের নামে নাশকতার সৃষ্টি করবে কেন? এই আন্দোলনের নামে কারাগার ভেঙে জঙ্গি ছিনতাই হবে কেন? এই আন্দোলনের নামে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট করবে কেন? কে জবাব দেবে?
এই আন্দোলন শুধু সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে আইন বা বিধি পরিবর্তনের আন্দোলন, যা সরকারও চায় এবং সরকার পরিপত্র জারি করেছে। অথচ এই আন্দোলনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ভুল বুঝিয়ে এক শ্রেনীর জনবিচ্ছিন্ন সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী সরকার পতনের আন্দোলন জোরদার করেছে। এই আন্দোলনের রূপকার কারা? যাঁদের নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে- যাঁরা এই আন্দোলনের সমন্বয়কারী হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের আদি বৃত্তান্ত নিলে তাহলে দেখা যাবে, তাঁরা আসলে কারা? মূল নেতৃত্ব যাঁরা দিয়েছে তারা কিন্তু সবাই সাধারণ শিক্ষার্থী নয়, তবে হ্যাঁ তাদের সাথে সাধারণ শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের আসল পরিচয় জানেনা বা জানতো না। তাদের আন্দোলন হলো কোটা বিরোধী আন্দোলন, সেই আন্দোলনকে সামনে রাখে তারা কিন্তু করেছে সরকার বিরোধী আন্দোলন। তাদের প্রতিপক্ষ হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাদের প্রতিপক্ষ হলো মুক্তিযোদ্ধা, তাদের প্রতিপক্ষ হলো পুলিশ, তাদের প্রতিপক্ষ হলো সাংবাদিক, তাদের প্রতিপক্ষ হলো স্বাধীনতার স্বপক্ষের সবাই, তাদের টার্গেট হলো সরকারের উন্নয়নের কাজগুলোর ধ্বংস করা, তাদের টার্গেট হলো সরকারকে কৌশলে উৎখাত করা, তাদের টার্গেট হলো দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে অতল করা। তাদের টার্গেট হলো এয়ারপোর্ট দখল করে দেশকে সারা বিশ্বের সাথে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া, গণভবন দখল করে শ্রীলঙ্কার আদলে ক্ষমতা দখল করা।
মাননীয় আদালতের রায়ের মাধ্যমে তাদের দাবি সম্পূর্ণভাবে পূরণ হয়েছে। কিন্তু তারা এখন কোটা আন্দোলনের দাবির পাশাপাশি আরো কিছু দাবি উপস্থাপন করেছে। তাঁরা তাহলে এই আন্দোলন কিসের জন্য এবং কার জন্য কিসের স্বার্থে করেছে, তা তারা প্রকাশ না করলেও, আমরা সাধারণ মানুষ বুঝি এবং জানি তাদের আসল রহস্য কি? তাদের আন্দোলন কোটার আন্দোলন নয়, তাদের আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দেশের উন্নয়ন বাঁধা সৃষ্টি করে সরকারকে উৎখাত করা, অন্য দিকে আরও একটি ১৫ আগস্ট বা ২১ শে আগস্ট রচনা করা। সেজন্যই বসিলায় ২০ হাজারেরও বেশি বহিরাগত সমবেত হয়েছিল, মোহাম্মদপুর হয়ে গণভবনে হামলা চালাতে চেয়েছিল।
তাই আজকে সময় এসেছে, সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে রক্ষার জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করা।
লেখক : সংসদ সদস্য।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ