শুক্রবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

এসো দুর্জয় প্রাণের আনন্দে নববর্ষে

জাফর ওয়াজেদ

এসো দুর্জয় প্রাণের আনন্দে নববর্ষে

পয়লা বৈশাখ বাংলাদেশের এমনই উৎসব—যা ধর্ম, সমাজ, বয়স ও বৃত্তির সীমা পেরিয়ে সর্বত্র একাকার। নববর্ষের আনন্দ চিত্তে নতুনের জাগরণ ঘটায়। উৎসবের মধ্যে মানুষ নিজেকে খুঁজে পায় বৃহত্তরের গণ্ডিতে। রবীন্দ্রনাথ যেমনটা বলেছেন, ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী— কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ; সেদিন সে সব মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন যে সব মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’ পয়লা বৈশাখ নতুন আঙ্গিকে জীবন গড়ার শপথের দিন। এদিন রাষ্ট্রীয় কর পরিশোধের অঙ্গীকার গ্রহণের দিন ছিল একদা। দেনা-পাওনা হালনাগাদ করার দিন। ব্যবসায়ীদের হালখাতা খোলার দিন। পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির প্রেরণার দিন। একদা ফসলি কর পরিশোধের সঙ্গে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাবোধ জাগানোর দিন ছিল। বাঙালি জীবনে দীর্ঘকাল পয়লা বৈশাখের অনুষঙ্গ হচ্ছে ‘হালখাতা’। উদ্দেশ্য হচ্ছে ফসলি কর পরিশোধের আনন্দ প্রকাশ করা এবং ব্যবসায়ের হিসাব ও খাজনা ‘রাজকীয়’ খাতায় হালনাগাদ রাখা। এ উপলক্ষে রাজা-জমিদারকে প্রজারা তাদের সৃজনশীল পণ্য ও সূচিকর্ম উপহার দিত। রাজা-জমিদাররাও প্রজাদের কর রেয়াত ও ইনাম দিতেন।

মানুষের নৈপুণ্য প্রদর্শন ও সাংবাৎসরিক প্রয়োজনীয় অথবা শৌখিন পণ্যের বেচাকেনার জন্য বৈশাখীমেলা লোকবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য। মানুষ এই উৎসবের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে মুঘল আমল থেকেই। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মানুষের উৎসব কবে? মানুষ যেদিন আপনার মনুষ্যত্বের শক্তি বিশেষভাবে স্মরণ করে, বিশেষভাবে উপলব্ধি করে।’ সেই দিন থেকে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি জাতি নতুন বর্ষ পালন করে আসছে নিজ নিজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সমুন্নত রেখে। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে একটি নতুন সৌর সনের উদ্ভাবন করা হয়। ফসলি সন হিসেবে এই বাংলা সন বাঙালির জীবনে নিয়ে আসে প্রাণের স্পন্দন আজও। আর ‘জগতের যেখানে অব্যাহত শক্তির প্রচুর প্রকাশ, সেখানেই যেন মূর্তিমান উৎসব’ (রবীন্দ্রনাথ)। এই উৎসব নিয়ে আসে সবার প্রাণে-মনে চির নতুনের আবাহন। মধ্যযুগের বাংলায় দরিদ্র মানুষের জীবনে বৈশাখ আনন্দবার্তা নিয়ে আসত এমন নয়, প্রচণ্ড গরম আর অভাবের মাঝে বেঁচে থাকা গ্রামবাংলার মানুষ তবু খুঁজত প্রাণে প্রাণে যোগ।

রাজকর পরিশোধের আওতায় এই নিরন্ন, অভাবি বাঙালি না থাকলেও বৈশাখীমেলায় তার উপস্থিতি দেখা যেত। বৈশাখের নবপ্রভাতেই বাঙালি আজও তাই কায়মনে প্রার্থনা করে, যা কিছু গ্লানিময়, ক্লেদাক্ত, জীর্ণ বিশীর্ণ, দীর্ণ, পুরনো তা বৈশাখের রুদ্রদহনে পুড়ে যেন হয় ছাই, গ্রীষ্মের তাপস নিঃশ্বাস বায়ে পুরনো বছরের সব নিষ্ফল সঞ্চয় যেন দূর-দিগন্তে মিলায়। খরতাপে প্রকৃতি অগ্নিস্নানে হয় মত্ত। বাঙালি তাই রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে বৈশাখকে আবাহন করে গেয়ে ওঠে, ‘মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা।’ সব অপ্রাপ্তির বেদনাকে ধুয়ে মুছে; আকাশ-বাতাস ও প্রকৃতিকে নতুনভাবে রাঙিয়ে তোলে। বৈশাখের প্রথম দিনে যে উৎসবের ঘনঘটা, তা আসলে কৃষিজীবী বাঙালির যুগ-যুগান্ত ধরে বয়ে আসা জীবনচর্যার অন্যরকম অনুষঙ্গ হিসেবে স্পন্দিত হয়। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন, ‘আজ আলোক জ্বলিয়াছে, সংগীত ধ্বনিতেছে, দ্বার খুলিয়াছে— আজ মনুষ্যত্বের গৌরব আমাদিগকে স্পর্শ করিয়াছে— আজ আমরা কেহ একাকী নহি— আজ আমরা সকলে মিলিয়া এক— আজ অতীত সহস্র বৎসরের অমৃতবাণী আমাদের কর্ণে ধ্বনিত হইতেছে— আজ অনাগত সহস্র বৎসর আমাদের কণ্ঠস্বরকে বহন করিবার জন্য সম্মুখে প্রতীক্ষা করিয়া আছে।’

পয়লা বৈশাখ সর্বস্তরের বাঙালি জনসাধারণের জন্যই শুভ নববর্ষের প্রথম দিবস। জমিতে বীজ বপনের দিবস হিসেবে বাঙালির জাতীয় উৎসবের দিন। মেলা, খেলাধুলা, নৌকা বাইচ, গান-বাজনা এবং ভালো খাওয়া-দাওয়ার দিন। সর্বজন পালিত জাতীয় দিবসটি ইরানি নববর্ষ নওরোজের সূচনা দিবসের সঙ্গে তুল্য। বৈশাখ মাসেই গ্রামবাংলায় মেলার আয়োজন চলে বহুকাল হতে। ‘আমাদের দেশ প্রধানত পল্লীবাসী। এই পল্লী মাঝে মাঝে যখন আপনার নাড়ির মধ্যে বাহিরের বৃহৎ জগতের রক্ত চলাচল অনুভব করিবার জন্য উত্সুক হইয়া ওঠে; তখন মেলাই তাহার প্রধান উপায়। এই মেলাই আমাদের দেশে বাহিরকে ঘরের মধ্যে আহ্বান। এই উৎসবে পল্লী আপনার সমস্ত সঙ্কীর্ণতা বিস্মৃত হয়— তাহার হৃদয় খুলিয়া দান করিবার ও গ্রহণ করিবার এই প্রধান উপলক্ষ’ (রবীন্দ্রনাথ)। পাকিস্তান যুগে পয়লা বৈশাখকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ‘হিন্দুর বর্ষারম্ভ দিবস’ রূপে আখ্যায়িত করে তার আনন্দ-উৎসব থেকে দূরে রাখার অভিযান চালিয়েছিল। বাঙালি যাতে বাঙালি না থাকে সেজন্য তার সংস্কৃতির মেলবন্ধনকে নিশ্চিহ্ন করার নানা প্রয়াস চলতে থাকে। পাকিস্তানকালে বাঙালি আর বাঙালি থাকল না বটে, কিন্তু বাংলাদেশ মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান বৌদ্ধ এবং নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর আবাসভূমি রয়েই গেল। রয়ে গেল বৈশাখ মাসও। হালখাতাও চলায়। ‘বাঙালি বলিয়া কোথাও কিছু নাই’ বলে পাকিস্তানি জান্তারা যতবার গলা হাঁকিয়েছে, বাঙালি তত বেশি নিজের বাঙালিত্ব রক্ষার জন্য প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়েছে। যদিও নগরজীবনে বৈশাখ সেভাবে পালন করা হতো না। কিন্তু বাঙালির রাজনৈতিক আন্দোলনের পালে হাওয়া লাগাতে বৈশাখ রণরঙ্গিনী মূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছিল। চেতনায় বাঙালিয়ানা ক্রমশ স্বরূপ ধারণ করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু বাঙালির উৎসব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে রক্ষা করে তার স্বাধীন বিকাশের সংগ্রামে এগিয়ে এসেছিলেন। বুঝেছিলেন তিনি, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। তাই চেয়েছিলেন মাটি ও মানুষকে কেন্দ্র করে গণমানুষের সুপ্ত শক্তি ও স্বপ্ন এবং আশা-আকাঙ্ক্ষাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠবে বাংলার নিজস্ব সাহিত্য সংস্কৃতি।

বঙ্গবন্ধু বাংলা ও বাঙালি অন্তঃপ্রাণ ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের পর বঙ্গবন্ধুসহ প্রগতিশীল নেতারা বাংলা নববর্ষে সরকারি ছুটি দাবি করেন। তাদের দাবির মুখে সরকার ছুটি ঘোষণা করে। পাকিস্তানি জান্তা সরকারও তা বাতিল করার দুঃসাহস দেখায়নি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে তার সংস্কৃতির প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করতে বাধ্য করে। পাকিস্তানিদের নানা বাধা-বিপত্তির মধ্যেও সংস্কৃতিকর্মীরা ঐতিহ্যকে সমুন্নত করার জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে। ছায়ানটের হাত ধরে নগরজীবনে পয়লা বৈশাখ আসে আনন্দলোকে— মঙ্গলালোকের গান গেয়ে। ছায়ানট রমনার অশ্বত্থতলে ভোরের বেলা আয়োজন করে অনুষ্ঠানমালার। ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো/তাপস নিঃশ্বাস বায়ে/মুমূর্ষেরে দাও উড়ায়ে।’ সমবেতভাবে শিল্পীদের উদাত্ত কণ্ঠে ধ্বনিত এ গান মানুষের মনে আশা জাগাত, প্রেরণা সৃষ্টি করত। সে সুরের অনুরণন ছাপিয়ে যায় গোটা ঢাকা শহর হয়ে সারা দেশে। নববর্ষের আগমনকে চিত্তে একটি নতুন উপলব্ধির শিহরণরূপে অনুভব করতে থাকে সংগ্রামী বাংলার বাঙালি পাকিস্তান যুগের শেষদিকে, একাত্তরের আগে। বাঙালি বুঝতে পারে পাকিস্তান যুগে রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণ থেকে, যখন রবীন্দ্রসংগীত প্রচারও করা হয়েছিল নিষিদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষেরও আগে উল্লেখ করেছিলেন, ‘আজ আমাদের কিসের উৎসব? শক্তির উৎসব। মানুষের মধ্যে কী আশ্চর্য শক্তি আশ্চর্যরূপে প্রকাশ পাইতেছে। আপনার সমস্ত ক্ষুদ্র আয়োজন অতিক্রম করিয়া মানুষ কোন্ ঊর্ধ্বে গিয়া দাঁড়াইয়াছে। ...জ্ঞানে প্রেমে কর্মে মানুষ যে অপরিমেয় শক্তিকে প্রকাশ করিয়াছে, আজ আমরা সেই শক্তির গৌরব স্মরণ করিয়া উৎসব করিব। আজ আমরা আপনাকে; ব্যক্তিবিশেষ নহে, কিন্তু মানুষ বলিয়া জানিয়া ধন্য হইব।’ বৈশাখে বাঙালি সেই শক্তির ভিতর দিয়ে নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করে আসছে। ১৯৭১ সালে তথা ১৩৭৮ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখে এসেছিল যুদ্ধক্ষেত্রে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তখন বাঙালি নিধনে মত্ত। শহর-গঞ্জ-গ্রামে হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘৃণ্যতায় লিপ্ত। যার বিরুদ্ধে বাঙালি সশস্ত্র অবস্থান নিয়েছিল। তারপর স্বাধীন বাংলাদেশে নববর্ষ পালন হয় মুক্ত পরিবেশেই। কিন্তু ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর সামরিক জান্তা শাসকরা বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে খড়্গ হাতে নেমে পড়ে। পাকিস্তানি বিজাতীয় সংস্কৃতির পুনঃপ্রবর্তনের অপচেষ্টা চালায়। কিন্তু বাঙালি প্রতিরোধের শক্তিতে তখনো বলীয়ান। নব্বই দশকে ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোটের সহযোগী সংগঠন জাসাস রমনা অশ্বত্থতলা দখলের জন্য নোংরা আচরণ করে। ছায়ানটের অনুষ্ঠানস্থল তারা দখলের চেষ্টা চালায়। কিন্তু বাঙালি জনগণের হৃদয়ে ঠাঁই না পাওয়ায় পিছু হঠতে বাধ্য হয়।

জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নতুন বছরকে আপন সংস্কৃতির অনুশীলনে বরণ করে নেওয়ার উৎসবকে স্তব্ধ করে দিতে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা হামলাও চালানো হয়। টিএসসিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মেয়েদের প্রতি অশালীন আচরণের ঘটনা উৎসবকে ম্লান করে দেওয়ার অপচেষ্টা হলেও তা সম্ভব হয়নি। মৌলবাদী, সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদীরা বাঙালির সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিতে নববর্ষ পালনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তাদের এই হীন কর্মকাণ্ড নিশ্চিহ্ন করার পথ খুঁজে না পেয়ে তাই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানকে সংক্ষিপ্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবার। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা দেওয়ার নানা আয়োজনও বিধি-নিষেধের নামে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। পাকিস্তানি জান্তা এবং বাংলাদেশি জান্তা শাসকরা শত চেষ্টা করেও বর্ষবরণ উদযাপনকে সঙ্কুচিত করতে পারেনি। নাশকতার অজুহাত দেখিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা বাঙালির সর্বজনীন উৎসবকে পঙ্গু করারই নামান্তর। ১৪২৪ বঙ্গাব্দকে বরণ করার জন্য বাঙালি যখন প্রস্তুত, তখন এসব বিধি-নিষেধ বাঙালির সংস্কৃতির বিপরীতে জঙ্গি, মৌলবাদীদের কথিত পরিকল্পনাকে বৈধতা দেওয়ার নামান্তর বলা যায়। নিরাপত্তা দিতে না পারার অসফলতার কারণে এই বিধি-নিষেধ মনে হতে পারে। কিন্তু উৎসবে নেমে আসা বাঙালিকে গৃহবন্দী করার মাধ্যমে তার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও নতুনের প্রতি আবাহনকে স্তিমিত করার লক্ষ্যকেই কার্যকর করবে। রাজপথে নাগরিকদের ঢল মূলত জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে জাতীয় জাগরণই ঘটাবে। সংস্কৃতিকর্মীরা যেমনটা বলছেন, মৌলবাদীদের না আটকে তাদের আটকে দেওয়া হচ্ছে। কোনো ধর্মসভার ক্ষেত্রে সময়সীমা থাকে না, জাতীয় উৎসবের ক্ষেত্রে কেন এ সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে, তা প্রশ্নবোধক হয়ে থাকছে। নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতি চালু করার যে প্রচেষ্টা এবার চালানো হয়েছে, তা জাতিকে শতগুণে প্রতিরোধী করে তুলবে। জনমনে আতঙ্ক তৈরি করার, ভয়ভীতির সংস্কৃতিকে বিকশিত করার এ অপচেষ্টা স্বাধীন দেশে নতুন করে আঘাত হানার শামিল। ১৯০৪ সালে রবীন্দ্রনাথ তার ‘উৎসবের দিন’ প্রবন্ধে যা বলেছিলেন, আজকের বাংলাদেশে তার পুনরাবৃত্তি ঘটুক— এটা কারও কাম্য নয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষ্য দিয়ে স্পষ্ট করা যায় বিষয়টি। ‘হায়, এখন আমরা উৎসবকে প্রতিদিন সঙ্কীর্ণ করিয়া আনিতেছি। এতকালে যাহা বিনয়রসাপ্লুত মাদলের ব্যাপার ছিল, এখন তাহা ঐশ্বর্যমদোদ্ধত আড়ম্বরে পরিণত হইয়াছে। এখন আমাদের হৃদয় সঙ্কুচিত, আমাদের দ্বার রুদ্ধ। এখন কেবল বন্ধুবান্ধব এবং ধনীমানী ছাড়া মঙ্গলকর্মের দিনে আমাদের ঘরে আর কাহারো স্থান হয় না। আজ আমরা মানব সাধারণকে দূর করিয়া নিজেকে বিচ্ছিন্ন-ক্ষুদ্র করিয়া, ঈশ্বরের বাধাহীন পবিত্র প্রকাশ হইতে বঞ্চিত করিয়া বড়ো হইলাম বলিয়া কল্পনা করি। আমাদের দীপালোক উজ্জ্বলতর খাদ্য প্রচুরতর আয়োজন বিচিত্রতর হইয়াছে— কিন্তু মঙ্গলময় অন্তর্যামী দেখিতেছেন আমাদের শুষ্কতা, আমাদের দীনতা, আমাদের নির্লজ্জ কৃপণতা।’ অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করা হচ্ছে একদিকে, অপরদিকে প্রদান করা হয়েছে উৎসব ভাতা। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বৈশাখী ভাতায় বিকাল পাঁচটার পর রেস্তোরাঁয় গিয়ে তা ব্যয় করবেন— এমনটা ভাবাও সঙ্গত নয় যদিও। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও বৈশাখী ভাতা পেয়ে উৎসবে অংশ নেবেন— এমনটা হওয়াই ছিল বাঙালি সংস্কৃতির জন্য মাইলফলক। কিন্তু কেন এই হীনতা, দীনতা, সঙ্কীর্ণতা আর সংস্কৃতিবিমুখতা, সে সব খুঁজে বের করা নিশ্চয়ই দুঃসাধ্য নয়। জঙ্গিবাদ, মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার আহ্বান নিয়ে আসা পয়লা বৈশাখে মানুষ ঘর ছেড়ে রাজপথে নেমে আসুক, উৎসবে হোক মাতোয়ারা। গেয়ে উঠুক— ‘এসো হে বৈশাখ।’

 

লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর