বৃহস্পতিবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

সাতক্ষীরার মাটির তৈরি টালি এখন ইউরোপের বাজারে

সাতক্ষীরার মাটির তৈরি টালি এখন ইউরোপের বাজারে

কংক্রিট এবং টাইলসকে পেছনে ফেলে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার মুরারীকাটি গ্রামের মাটির তৈরি টালি এখন বিশ্ব বাজারে জায়গা করে নিয়েছে। পোড়া মাটির বিভিন্ন ডিজাইনের টালি এখন সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে রপ্তানি হচ্ছে ইতালি, জার্মানি, জাপান, দুবাই, ফ্রান্সসহ বিশ্ব বাজারের বিভিন্ন দেশে। বিশেষ আকৃতির ছাঁচে ফেলে হাত দিয়ে তৈরি কাদা মাটির এই টাইস ও টালি ইউরোপবাসীদের শুধু নজর কাড়েনি, ঘুরিয়েছে দেশের অর্থনীতির চাকাকেও। এই টালি রফতানি করে বছরে আয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। ফলে বদলে গেছে সাতক্ষীরার কুমার সম্প্রদায়ের জীবনও। এখানকার প্রায় ৯০ শতাংশ পরিবার এখন স্বনির্ভর ও স্বাবলম্বী। কিন্তু সরকারী পৃষ্টপোষকতার অভাবে এ শিল্পের বিকাশ যথাযথভাবে ঘটছে না।

সরেজমিনে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার মুরারীকাটি গ্রামে গিয়ে জানা গেছে, পাকিস্তান আমল হতে এখানকার কুমাররা ঘরের ছাউনিতে ব্যবহার উপযোগী কাদা মাটি দিয়ে টালি তৈরি করত। আর তাদের তৈরি টালি ব্যবহার হতো নিম্ন আয় ও মধ্যেবিত্তদের ঘরের ছাউনি হিসেবে। কিন্তু কালের আবর্তনে আজ সেই মাটির তৈরি বিভিন্ন আকৃতির টালি, সৌন্দর্যবর্ধন করতে ব্যবহারিত হচ্ছে বিদেশিদের বড় বড় অট্টালিকার ছাদে, দেওয়াল-মেঝে তৈরি ও ঘর সাজানোর কাজে।

মুরারীকাটি গ্রামের রফতানিজাত টালি উৎপাদনের প্রতিষ্ঠাতা গোস্ট পদ পাল জানান, ২০০০ সালে ইতালিয়ান আমদানিকারক ব্যবসায়ী রাফাইলী আলদো প্রথম কলারোয়া উপজেলার মুরারীকাটি গ্রামে পদার্পন করেন। এখানকার এটেল দোআঁশ মিষ্টি মাটি দিয়ে তৈরিকৃত টালি পছন্দ করেন। আর সে বছরই তিনি পরীক্ষা স্বরূপ কনটেইনারের মাধ্যমে খুলনার মংলা নদী বন্দর দিয়ে জাহাজে করে প্রথম টালি রফতানি শুরু করেন ইতালিতে। এরপর সেখানে বড় বড় বিল্ডিং বাড়ির ঘরের মেঝে ও দেওয়ালের শোভাবর্ধনসহ বিভিন্ন নির্মাণ কাজে ব্যাপক চাহিদা পায় এখানকার আগুনে পোড়া মাটির তৈরি টালি। এরপর পুরোদমে রফতানি হতে থাকে ২০০৪ সাল থেকে।

খুলনার জে কে ইন্টারন্যাশনাল, আরনো এক্সপোর্ট ইমপোর্টসহ দেশের বড় বড় আমদানি-রফতানিকারক প্রতিষ্টান বিদেশে পাঠাতে থাকে তাদের পছন্দমত তৈরি বিভিন্ন আকৃতির টালি ও মাটির তৈরি টাইলস। এখন এই টালি ইতালি ছাড়াও আমেরিকা, স্পেন, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে। উপার্জিত হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা। ফলে দুঃখ-দুর্দশায় থাকা কুমারদের জীবনযাত্রার মানও বদলে গেছে। এখন কুমার সম্প্রদায় এখন সচ্ছল ।

গোস্ট পদ পাল জানান, কয়েক বছর আগেও তার সংসার চলতো দারিদ্রতার মধ্যে। কিন্তু রফতানিজাত এই টালি তৈরি করে এখানকার মানুষের ভগ্যবদলে গেছে। সাতক্ষীরার প্রাকৃতিক পণ্যের এক নম্বর অর্থকরী খাত হিসাবে টালি ইউপের বাজার দখল করায় কলারোয়ার মুরারিকাটি, মির্জাপুর ও শ্রীপতিপুর গ্রামে ৪০টি টালি তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ নারী ও পুরুষ শ্রমিক নিয়মিত কাজ করে থাকে। বর্ষা মৌসুম ছাড়া বছরে ৭ থেকে ৮ মাস এখানে টালি তৈরির কাজ হয়। এদের একেক জনের দৈনিক মজুরী ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। টালি উৎপাদনকে ঘিরে এলাকার অনেক অসচ্ছল ও বেকার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।

এখানকার রফতানিজাত টালি উৎপাদনের প্রতিষ্ঠাতা গোস্ট পদ পাল আরও জানান, এই টালির ব্যাবসা করে তিনি এক দশকের ব্যবধানে কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তার দেখে এখানকার অনেকে এখন এই টালি তৈরি করে নিজেদেও ভাগ্যবদলে নিয়েছেন। এ গ্রামের আরও টালি কাখনার মালিক আবুল হোসেন জানান,কলারোয়া পৌরসভার অন্তর্গত মুরারীকাটি গ্রামের মানুষ বসবাস করতো নানা কষ্টের মধ্যে। বেকার সমস্যা ছিলো এ গ্রামের মানুষের প্রধান অন্তরায়। কিন্ত রফতানিজাত টালি কারখানার কারণে এ গ্রামের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘাটয়েছে। এই ব্যবসা করে তিনি  বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা আয় করছেন। এ গ্রামের টালি শিল্প এখন এ অঞ্চলের ৯০ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান করে দিয়েছে।

নারী শ্রমিক আলেয়া খাতুন এবং শ্রমিক পলাশ হোসেন জানান, এলাকায় কৃষি কাজ ছাড়া তেমন কোনো কাজ মিলতো না এ গ্রামে। টালি কারখানা হওয়ার পর থেকে তারা টালি তৈরির কাজ করে দৈনিক আয় করছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। তাই নিজ গ্রামে এসব টালি কারখানা হওয়ায় বেকারত্ব ঘুচেছে তাদের।

সাতক্ষীরা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি নাছিম ফরিুক খান মিঠু জানান, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এ শিল্পের বিকাশ যথাযথ ভাবে ঘটছে না। ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে টালি কারখানা মালিকদের বিভিন্ন জটিলতার শিকার হতে হয়। বিনা সুদে সরকার লোন দিয়ে এই শিল্প বিকাশে কারখানা মালিকদের সরকার সহযোগিতা দিলে সাতক্ষীরার উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় টালি শিল্পটি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
 

 

বিডি-প্রতিদিন/ ২৯ জানুয়ারি, ২০১৫/ রশিদা
 

সর্বশেষ খবর