৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ১১:০৮

'মুসলিম আমেরিকানদের নিয়ে রাজনীতি চলবে না'

নিউইয়র্ক থেকে এনআরবি নিউজ:

'মুসলিম আমেরিকানদের নিয়ে রাজনীতি চলবে না'

আল রহমান মসজিদে বক্তব্য রাখছেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। ছবি: এনআরবি নিউজ

রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে আগ্রহী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেন, ‘মুসলিম আমেরিকানদের নিয়ে রাজনীতির জায়গা নয় আমেরিকা। এমনটি যারা করতে চান তারা ক্ষমার অযোগ্য কর্মে লিপ্ত রয়েছেন বলে ভাবতে হবে’।

মুসলিম-আমেরিকানদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের পরিপ্রেক্ষিতে ওবামা দুটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। প্রথমটি হচ্ছে, ‘ধর্মীয় বিশ্বাসে ভাঙন ধরানোর জন্যে চলমান প্রয়াসের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অন্তত একটি মৌলিক বিষয়ে একমত হওয়া দরকার যে, আমরা সকলেই সৃষ্টিকর্তার সন্তান। আমরা সকলে একইভাবে জন্মেছি। সকলেই সমমর্যাদার অধিকারী। এ কারণে আমাদেরকে বাহ্যিক ব্যবধান ভুলে যেতে হবে। খ্রিস্টান, জুইশ, মুসলমান আমরা সকলেই নিজ নিজ বিশ্বাসে বলিয়ান, আমরা আব্রাহামের উত্তরসূরি। তাই ধর্ম ভিন্ন হলেও আমাদের জীবন-ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে মানবতার মধ্যে। পবিত্র কোরআন শিখিয়েছে ‘মানবিকতা’।  আমরাই মানুষে মানুষে ব্যবধানের সৃষ্টি করেছি। তাই এখন আমাদের সকলের কর্তব্য হবে এমনভাবে ধর্মবিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো যার মধ্য দিয়ে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি আরও জোরদার হয়’। 

ওবামার দ্বিতীয় প্রস্তাবটি হচ্ছে, ‘আমেরিকান হিসেবে আমাদেরকে মৌলিক মূল্যবোধে জাগ্রত থাকতে হবে, যেখানে থাকবে সকল ধর্ম বিশ্বাসের অবাধ স্বাধীনতার কথা। আমি ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, জেফারসনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছি যে, জাতিকে আরও শক্তিশালি করার স্বার্থেই ধর্ম-কর্ম করার অবাধ অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। যদি সকলে নিজ নিজ ধর্ম অবাধে পালন করতে পারেন, তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের অবস্থান আরও সুসংহত হবে’। 

গতকাল বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি সংলগ্ন মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যে বাল্টিমোর ইসলামিক সেন্টারে সমবেত মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতাকালে প্রেসিডেন্ট ওবামা এ মন্তব্য করেন। স্থানীয় সময় বেলা ১.০৪ টায় শুরু এ ভাষণ শেষ হয় ১.৫২ মিনিটে। 

প্রেসিডেন্ট হিসেবে এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মসজিদে এসে মুসলমানদের মধ্যে স্বস্তিদায়ক বক্তব্য রাখলেন ওবামা। আইএসআইএস-এর সন্ত্রাসী তৎপরতার পাশাপাশি গত ডিসেম্বরে ক্যালিফোর্নিয়ার সান বার্নার্দিনো সিটিতে এক মুসলিম দম্পতি কর্তৃক নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১৪ জনকে হত্যা এবং বেশ কয়েকজনকে গুরুতরভাবে আহত করার পরিপ্রেক্ষিতে সারা আমেরিকায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ভীতির সঞ্চার ঘটেছে। বেশকিছু স্থানে মুসলমানদের ব্যবসা এবং মসজিদে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। অন্তত ৩টি মসজিদে অগ্নি সংযোগের ঘটনাও রয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ওবামা বাল্টিমোর ইসলামিক সোসাইটি পরিচালিত ‘আল রহমান মসজিদ-এ এলেন এবং দীর্ঘ ৪৮ মিনিট বক্তব্য প্রদানের আগে মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের সাথে উদ্ভুূত পরিস্থিতির আলোকে মতবিনিময় করেন। হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে এ আলোচনায় ওবামা সকলকে অভয় দিয়েছেন যে, ‘যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত সকল মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে আমাদের সংবিধান। সংবিধান প্রদত্ত অধিকার প্রতিটি নাগরিক অবাধে ভোগ করবেন, এটিও পরম সত্য। এর মধ্যে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব অথবা সংশয়ের অবকাশ নেই।’ 

গতকাল বুধবার দুপুরে জোহরের নামাজের পর শতশত মুসল্লী এবং ইসলামিক সেন্টার পরিচালিত আল রহমান স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রেসিডেন্ট ওবামাকে মসজিদ প্রাঙ্গনে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। এ সময় বাল্টিমোর ইসলামিক সোসাইটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ জামিল ওবামাকে মুসলিম-আমেরিকানদের সামগ্রিক পরিস্থিতি অবহিত করেন। তিনি তাকে জানান যে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে ভালো সংবাদে প্রতিটি মুসলমান যেন উল্লাস প্রকাশ করেন, ঠিক তেমনি মন্দ সংবাদেও ব্যথিত হন। অর্থাৎ এই দেশটিকে সকলেই নিজের বলে মনে করেন। 

ওবামা তার বক্তব্যের শুরুতেই স্থানীয় কংগ্রেসম্যান (ডেমক্র্যাট) জন পিটার স্পাইরোজ সারবেনস এবং দুই মুসলমান কংগ্রেসম্যান কিথ এলিন (মিনোসাটা) এবং ইন্ডিয়ানার কংগ্রেসম্যান আন্দ্রে কারসনকে বিশেষভাবে পরিচয় করিয়ে দেন সমবেত সকলের সঙ্গে। 

ওবামা তার বক্তব্যে আমেরিকার সামগ্রিক উন্নয়ন ও কল্যাণে মুসলিম আমেরিকানদের অবদানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেকার সম্প্রীতির বন্ধন আরও জোরদার হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। এ সময় তিনি ইসলামিক স্টেট (আইসিস) নামে উগ্র-মতবাদে বিশ্বাসীদের সন্ত্রাসের নিয়ন্ত্রণে সারাবিশ্বের মুসলমানদের আন্তরিক সহায়তা কামনা করেন। 

বাল্টিমোর ইসলামিক সেন্টারের বহুমুখী কর্মকাণ্ডের আলোকে ওবামা বলেন, ‘খ্রিস্টান এবং জুইশদের সঙ্গে এই মসজিদ পরিচালনায় নিয়োজিতরা ‘আন্তঃধর্মীয় সংলাপের মাধ্যমে ধর্মীয় সম্প্রীতির বন্ধন সংহত করেছেন, এখানকার স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমের সুবিধা পাচ্ছেন সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষেরা। এখানকার মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন মানবসেবার ক্ষেত্রকে সকল বর্ণ আর ধর্মের মানুষের মধ্যে প্রসারিত করেছেন। নাগরিকের ন্যায় বিচার নিশ্চিতে তারা কাজ করছেন সকল আমেরিকানের জন্যে। এলাকার উন্নয়নেও তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে দেন-দরবার করছেন। ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত মুসলমানেরা যাচ্ছেন প্রার্থীদের সভা-সমাবেশে। আর এভাবেই খ্রিস্টান, মুসলমান, জুইশ, হিন্দু, বৌদ্ধ সকলেই যে এক পরিবারের সদস্য তার বর্ণাঢ্য বহিঃপ্রকাশ ঘটছে’ ।

বিপুল করতালির মধ্যে হাস্যোজ্জ্বল ওবামা বলেন, ‘প্রথমত আমি দুটি শব্দ বলতে চাই যে, মুসলিম আমেরিকানরা কখনোই অতিরিক্ত কিছু শুনতে অভ্যস্ত নন। ধন্যবাদ আপনাদের। আপনারা নিজের কম্যুনিটির জন্যে কাজ করছেন। ধন্যবাদ জানাচ্ছি নিকট প্রতিবেশীদের ভাগ্য উন্নয়নে এবং জাতিগতভাবে একটি আমেরিকান পরিবার হিসেবে আমাদেরকে প্রকৃত অর্থেই সহায়তা প্রদানের জন্যে’।

মসজিদে আগমণের কারণ ব্যাখ্যাকালে ওবামা বলেন, ‘সকল আমেরিকানের মতো আপনারাও সন্ত্রাসী হামলার হুমকিতে ভীত। মুসলিম-আমেরিকান হিসেবে এর বাইরেও আপনারা উদ্বিগ্ন। কারণ গোটা মুসলিম কম্যুনিটিকেই কখনো কখনো টার্গেট করা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী চলমান সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্যে দায়ী হিসেবে। গুটিকতক মুসলমানের অপকর্মের জন্যে গোটা মুসলিম সম্প্রদায়কে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর একটি প্রয়াস বিদ্যমান রয়েছে’ ।

ওবামা বলেন, ‘তুলনামূলকভাবে আমেরিকায় মুসলমানের সংখ্যা কম। মাত্র কয়েক মিলিয়ন মুসলমান বাস করছেন এদেশে। এজন্য অধিকাংশ আমেরিকানই মুসলমানদের সম্পর্কে তেমন ধারণা রাখেন না। তখোনই মুসলমানদের ব্যাপারে অনেক আমেরিকানের আগ্রহ বাড়ে, যখন মিডিয়ায় কোন সন্ত্রাসী হামলার সংবাদ আসে। সে সংবাদ দেখে অথবা শুনে অনেক আমেরিকানের ধারণা হয় যে, মুসলমানরাই সন্ত্রাস করছে, নির্বিচারে মানুষ হত্যায় মদদ দিচ্ছে ইসলাম ধর্ম। অনেক সময় টিভি অথবা চলচ্চিত্রেও মুসলমানদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে যা আদৌ সত্য নয়’।

ওবামা আরও বলেন, ‘আমেরিকায় মুসলমানদের নিষিদ্ধ করার মত ভয়ংকর বক্তব্য প্রদানের পর সারা আমেরিকায় মুসলমানদের ব্যাপারে বিদ্বেষ বেড়েছে। এই মসজিদেও গত বছর দু’দফা আক্রমণ হয়েছে। মুসলমান শিশুদের হুমকি দেয়া হচ্ছে। সারা আমেরিকায় অনেকেই হিজাব পরেন। তারাও টার্গেট হচ্ছেন’।

‘আমরা দেখেছি মিথ্যাচার এবং মসজিদে আগুন দেয়ার মত হিংসাত্মক ঘটনা। কিন্তু এটি তা নয়, যা আমরা, আমরা একটি পরিবারের সদস্য।  এমন অবস্থায় আমাদের এই পরিবারের একটি অংশ যদি মনে করে যে তারা সেকেন্ড ক্লাস সদস্যে অধিষ্ঠিত হচ্ছেন বা পরিবারের অপর সদস্য কর্তৃক আক্রান্ত হচ্ছেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের চেতনা ও মূল্যবোধ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়' বলেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। 

 

বিডি-প্রতিদিন/ ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/ রশিদা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর