২৪ জুন, ২০১৮ ১৫:০২

২৯ জুন দেশে ফিরছেন তিহার জেলে বন্দি সেই বাদল ফারাজি

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

২৯ জুন দেশে ফিরছেন তিহার জেলে বন্দি সেই বাদল ফারাজি

দীর্ঘ ১০ বছরের বেশি সময় পর আগামী ২৯ জুন নিজের দেশে ফিরছেন দিল্লির তিহার জেলে যাবজ্জীবন বন্দি দশা কাটানো বাংলাদেশি নাগরিক বাদল ফারাজি। বন্দি বিনিময় চুক্তি অনুযায়ী ওই দিনই বাদল ফরাজিকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হবে। ডাকাতি ও খুনের ঘটনায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এই বাংলাদেশি অপরাধীর বয়স ও প্রোফাইল (কারাগারে থাকাকালীন সময়ে তার সংযত ও ভাল ব্যবহার) খতিয়ে দেখেই তাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়টিতে অনুমোদন দেয় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেক্ষেত্রে দুই দেশের চুক্তি অনুযায়ী এই প্রথম বারের মতো কোন দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিকে বাংলাদেশের হাতে হস্তান্তর করা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে গিয়ে কারাগারেই কাটাতে হবে বাদলকে, কারণ দেশে ফিরে গেলেও তার সাজার মেয়াদ বদলের জন্য আবেদনের কোন সুযোগ পাবেন না।

বাদলকে হস্তান্তরের বিষয়ে ইতিমধ্যেই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও চিঠি দিয়ে দিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশনকে জানানো হয়েছে। চলতি মাসের গোড়াতেই চিঠি দিয়ে বলা হয়,বন্দি বিনিময় চুক্তির অধীনে ফারাজিকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়ার বিষয়টিতে মন্ত্রণালয়ের তরফে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে বাদল ফারাজিকে বাংলাদেশে ফেরত নিতে দ্রুত প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, বাংলাদেশ সরকারের পুলিশ কর্মকর্তারা ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে কারাগার থেকে ফারাজিকে নিয়ে যেতে হবে।

এ ব্যাপারে রবিবার দিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশনের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ২৭ জুন বাংলাদেশ থেকে দুইটি পুলিশ এসকর্ট টিম দিল্লিতে এসে পৌঁছাবে।২৯ জুন বাদলকে নিয়ে এসকর্ট টিম দিল্লি বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যেও রওনা হবে। এই ধরনের একটি মানবিক ক্ষেত্রে আমাদের দুই দেশের সরকারের পারস্পরিক সহযোগিতায় আমরা খুবই আনন্দিত।

উল্লেখ্য তাজমহল দেখতে এসে দশ বছর ধরে তিহার জেলে বন্দি রয়েছেন বাংলাদেশের মংলার বাদল ফারাজি। ২০০৮ সালের ১৩ জুলাই পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তো ১৫ বছরের কিশোর বাদল। বন্ধুদের কাছে শুনে তাজমহল দেখতে লুকিয়ে ভারতে রওনা দেয় সে। কিন্তু বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের পেট্রাপোল আন্তর্জাতিক সীমান্তে প্রবেশের পরই হত্যা মামলায় আসামি হিসাবে তাকে আটক করে বিএসএফ। ২০০৮ সালে মে মাসে দিল্লির ওমর কলোনিতে বৃদ্ধা খুনের সাথে জড়িত থাকার অভিযাগ ওঠে বাদল সিং নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। কিন্তু শুধু নামের মিল থাকার কারণেই বাংলাদেশি বাদলকে ওই খুনের মামলায় আটক করা হয়।

২০১৫ সালের ৭ আগস্ট বাদলকে দোষী সাব্যস্ত করে দিল্লির সাকেট আদালত, বাদলের যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে দিল্লি হাইকোর্টও নিম্ন আদালতের সেই রায় বহাল রাখে। পরে তার স্থান হয় দিল্লির তিহার কারাগারে। যদিও গত এক বছর ধরে তিহার জেল থেকে দিল্লির মান্ডোলি কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয় বাদলকে। কিন্তু বিনা দোষে এই সাজা কোনভাবেই মেনে নেয়নি বাদল। দিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশনের সহায়তায় হাইকোর্টের সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন বাদল। কিন্তু শীর্ষ আদালতও বাদলের আর্জি খারিজ করে দেয়। ফলে গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারেই কাটাতে হচ্ছে বাদল (২৮)-কে।

কারাগারে থাকাকালীন গত এক দশক ধরে নিজেকে অনেকটাই বদলে ফেলেছেন বাদল। কারাগার থেকে পড়াশোনা করেই স্নাতক হন বাদল। কারাগার চত্বর থেকেই ইন্দিরা গান্ধী ওপেন ইউনির্ভাসিটি থেকে প্রতিটি পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে কৃতকার্য হন তিনি। একটা সময় যে ভাষা সমস্যার কারণে তাকে এত বড় শাস্তি পেতে হয়েছিল বাদলকে, আজ তিনিই ইংরেজি বা হিন্দিতে অনর্গল কথা বলছেন। ইংরেজি ভাষা শিার সার্টিফিকেট কোর্সও করেছেন বাদল।

দিল্লির কারাগার থেকে বাদলকে মুক্তি করতে গত কয়েকমাস ধরেই ভারত জুড়ে শান্তিপূর্ণ র‌্যালি, জমায়েত, মানববন্ধনে সামিল হয় বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। যার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন রাহুল কাপুর। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সোশ্যাল ওয়ার্কে মার্স্টাস করা রাহুল সামাজিক কাজের জন্য ২০১৬ সাল থেকে তিহার জেলে যাতায়াত করছেন। কারাগারের বন্দিদের পুনর্বাসন, তাদের কাউন্সেলিং-এর কাজ করতে করতেই বাংলাদেশি নাগরিক বাদল ফারাজি’র সাথে পরিচয় হয় রাহুলের। বাদলের মুখ থেকে সবকিছু শুনে নতুন লড়াই শুরু হয় রাহুলের।

বাদলের ন্যায় বিচার সুনিশ্চিত করতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দেশ ভুলে সম্মিলিতভাবে অনলাইন পিটিশনে স্বাক্ষর করার আর্জি জানান রাহুল। এতে ভাল সাড়াও মেলে। ইতিমধ্যেই ‘জাস্টিস ফর বাদল’-শীর্ষক ওই পিটিশনে বাদলের মুক্তি চেয়ে চার হাজার জনের মতো মানুষ স্বাক্ষর করে ফেলেছেন। এর পাশাপাশি বাদলের মুক্তির বিষয়ে তিনি যোগাযোগ করেন দিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশনের সাথে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-কেও চিঠি লিখে বাদলের মুক্তির বিষয়ে অগ্রগতি আনতে উদ্যোগী হন রাহুল। বাদলের পাশে দাঁড়াতে গত কয়েক মাস ধরেই ফেসবুকেও লাগাতার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন রাহুল। সম্প্রতি দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন রাহুল। এরপরই গত মে মাসে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে একটি চিঠি এসে পৌঁছায় রাহুল কাপুরের কাছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ-মিয়ানমার বিভাগের যুগ্ম সচিব শ্রীপ্রিয়া রঙ্গনাথনের স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বাদলের হস্তান্তরের বিষয়ে দুই দেশের উদ্যোগের বিষয়টি জানানো হয়।

সমাজকর্মী রাহুল কাপুর জানান, বাদল যদি দেশে ফিরে যান, তবেই আমার দীর্ঘদিনের লড়াই সার্থক হবে। 

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর