৩০ নভেম্বর, ২০১৫ ১৯:৪৮

ধূসর চিত্রাবলী

সুরঞ্জনা মায়া

ধূসর চিত্রাবলী

ঢাকায় আমাদের বাড়িটা ছিল তেজগাঁয়ে, মনিপুরি পাড়ায় (নাকি মনিপুর?) সেখানে আব্বা কবে, কখন বাড়িটি করেছিলেন তা মনে নেই। বাড়িটি ছিল আমার এক নানার (মায়ের একমাত্র মামা) বাড়ির সামনে। শুনেছি আমার নানা (মায়ের বাবা) বিয়ের সময় পিতৃ-মাতৃহীন এই শ্যালকটিকে শ্বশুরবাড়ি থেকে নিয়ে এসে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন।

তো মায়ের সেই মামা ভাগ্নীকে বিয়ের উপহার হিসেবে ওই জায়গাটি দিয়েছিলেন। সেখানেই আব্বা টিনের ঘর তুলেছিলেন। উদবাস্তু জীবনে মাথা গোঁজার একটি ঠাঁই করতে পেরে নিশ্চিন্তের শ্বাস ফেলেছিলেন। বিধাতা তখন মুচকি হেসেছিলেন কিনা জানি না। সে সব কথা পরে বলবো।

আমাদের বাসাটি ছিলো ছোট্ট, ছিমছাম। পিছনে কলা গাছের সারি। তখনো পড়ালেখার বালাই নেই। মুখে মুখে ছড়া কবিতা আওড়ানো ছাড়া সারাদিন শুধু খেলা আর খেলা।

যে সময়টার কথা বলছি সেটা ১৯৬৪ সাল। চাঁদ নানার বাড়িতে সমবয়সী কয়েকজন খালা ছিলেন, তাদের সঙ্গে, না হলে আমরা দু'ভাইবোনই ঘুরে বেড়াতাম, খেলতাম। নানার বাগানে একটি আমগাছ ঝড়ে পড়ে গিয়েছিলো। সেটার ঝাকড়া ডালে দাঁড়িয়ে পা দিয়ে নাড়িয়ে আমরা ছড়া কাটতাম, " ঝিক্কির ঝিক্কির ময়মনসিং, ঢাকা যাইতে কতদিন, একমাস ৩০ দিন"। একমাস বলার পর আবার তিরিশ দিন বলা কেন তা মাথায় আসার বয়স তখনো হয়নি।

সেসময়ের একটি ঘটনা এখনো মনে আছে। ছুটির দিনে আমরা সিনেমা দেখে ফিরছি। হেঁটে বাসার সামনে এসেই আমি আগে দৌড় দিয়ে এগিয়ে গিয়েছি। হঠাৎ আমার সামনে এক দেয়াল খাড়া হয়ে দাড়ালো। হতভম্ব আমি কিছু বুঝে উঠবার আগেই দেখি সেই দেয়াল দুটো শিং বাগিয়ে আমার পেটের সামনে। কি আর করা আত্মরক্ষার্থে ওই দেয়ালের গলা ধরে পা দুটো উপরে দিয়ে গলা পেঁচিয়ে ঝুলতে থাকলাম। আম্মা তো ভয়ে চিৎকার, চেঁচামেচি শুরু করলেন। আমি ঝুলতে ঝুলতে চিৎকার করে বললাম-- " আম্মা আমি এখানে"। শেষে আব্বা এসে আমায় উদ্ধার করলেন। আর আম্মা কান্না ভুলে আমার পিঠে কিল-থাপ্পড় সহযোগে বকুনি। "চোখের মাথা খেয়েছো? চোখের সামনে জলজ্যান্ত ষাঁড় বসে রয়েছে তা দেখতে পাওনি"? 

আরে! অন্ধকারে ষাঁড় না বাঘ বসে আছে আমি তা দেখবো কেমন করে? মায়েরা কেন এতো নিষ্ঠুর হয়! একটু আগেই আমার শোকে কাঁদছিলেন, আর এখন অক্ষত আমাকে পেয়ে মেরে ক্ষত-বিক্ষত করতে চাইছেন! তখনি বুঝে গেলাম, জীবন বড় কষ্টের! 

সুখের দিন নাকি খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়! আমারও তাই হলো। ভাইয়া ও আমাকে বলা হতো, "সানাই আর পোওওও"। বলাই বাহুল্য সানাই আমি। আর পোও টা ভাইয়া। তখন অবশ্য ওকে আমি দাদা ডাকতাম। 

আম্মা বলতেন আমি নাকি উনার শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট ছেলেটিকে নষ্ট করছি। আমি যা করবো, বা বলবো বাধ্য অনুগতের মত সে তাই পালন করতো। সেই আমাদের জোড় ভেঙ্গে দেয়ার ষড়যন্ত্র যে চলছিলো তা মোটেই আমরা টের পাইনি। আম্মাকে দেখতাম প্রায়ই নিরবে চোখের পানি ফেলতে। আমার মনে কখনো প্রশ্ন জাগেনি, এ চোখের পানি কেন! বাচ্চারা বোধহয় নিষ্ঠুর হয়। হঠাৎ একদিন সকালে দেখি দাদী আমাদের বাসায়। দাদীকে দেখে তো আমরা খুশীতে অস্থির! আমের আচার, তিলের খাজা, আমসত্ব এসব নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আর আম্মার কান্নাও বেড়ে গেল। একদিন রাতে শুনি দাদী ভাইয়াকে নিয়ে যেতে এসেছেন। আমিও জেদ ধরলাম, আমিও যাবো। যাবো, যাবো, যাবোই! দাদী আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, " ঠিক আছে, তুমিও যাবে। এখন ঘুমাও। নাহলে সকাল সকাল উঠবে কি করে"? আমার মন কেন যেন সে সান্ত্বনায় ভিজলো না। মনে হলো, আমি ঘুমালেই উনি ভাইয়াকে নিয়ে চলে যাবেন। প্রতিজ্ঞা করলাম, আমি ঘুমাবো না। সারা রাত জেগে পাহারা দিবো। জোর করে চোখ টেনে চেয়ে রইলাম। হঠাৎ আম্মার কান্নার শব্দে উঠে দেখি, চিড়িয়া ফুড়ুৎ। আব্বাও অফিসে চলে গিয়েছেন। বড় মামা চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে তখন আমাদের বাসায় ছিলেন। উনি এগিয়ে এসে আমায় বললেন, " চল তোকে নাস্তা বানিয়ে দেই"। মুহূর্তে সারা বাড়ি চক্কর দিয়ে আমি চিল-চিৎকারে কান্না শুরু করলাম। এক নাগাড়ে ঘন্টাখানেক কেঁদে ভোম হয়ে বসে রইলাম। আমার বিশাষ করতে কষ্ট হচ্ছিল যে ভাইয়াটা আমার সাথে এমন বেঈমানি করতে পারলো! হায়! তখন বুঝিনি, ছোটদের মনোজগতের খবর সে আমলে ক'জন বড়রা রাখতেন? ছোটদেরও যে মন বলে কিছু আছে, ইচ্ছে, অনিচ্ছে আছে সেটা তারা চিন্তাও করতেন না। তাইতো একটি পাঁচ বছরের শিশুকে মায়ের অনিচ্ছায় তার বুক থেকে ছিঁড়ে নিয়ে দূরে, বহু দূরে চলে যেতে পেরেছেন। শুরু হলো আমার একলা পথ চলা!!!

লেখক: ব্লগার

ই-মেইল: [email protected]

 


বিডি-প্রতিদিন/ ৩০ নভেম্বর, ২০১৫/ রশিদা

সর্বশেষ খবর