শিরোনাম
২ জানুয়ারি, ২০১৬ ১৩:২৫

নয়নাভিরাম প্রকৃতির মাঝে

মুহাম্মাদ আবদুল আলীম

নয়নাভিরাম প্রকৃতির মাঝে

প্রকৃতির সাথে পরিচয় ও সেতুবন্ধন তৈরির অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ভ্রমণ। ভ্রমণ পরিচয় ঘটায় নতুন জীবন, নতুন সংস্কৃতি, নতুন সাহিত্য এবং নতুন নতুন দর্শনের সাথে। সৃষ্টির কত অজানা রহস্য যে উন্মেচিত হয় এই ভ্রমণের সেতু বেয়ে তা বলার অপেক্ষা রখে না। প্রকৃতির বিচিত্রময় রূপ বৈচিত্রের সাধ পেতে হলে ভ্রমণের বিকল্প নেই। তাই যুগে যুগে অজানাকে জানার এবং নতুন নতুন রহস্য উন্মোচন করার নেশায় মানুষ ছুটে বেড়ায় এক দেশ থেকে আরেক দেশে, এক প্রান্তর থেকে আরেক প্রান্তরে। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য লাভের আশায় আমিও ব্যাকুল হয়ে উঠি মাঝে মধ্যে। কিন্তু চাহিদা ও সাধ্যের পরিমাণ সমান নয়। চাহিদার চেয়ে সাধ্যের ব্যাপ্তিটা খুবই অপ্রতুল। আমার ক্ষেত্রে ঠিক তেমনটি, সাধ আছে কিন্তু সাধ্য নেই। কিন্তু দয়াময় আল্লাহ যদি তার বান্দাকে সফর করানোর ইচ্ছে করেন তাহলে সাধ্যের কি প্রয়োজন।

বহুদিন ধরে শুনে আসছি কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন নাকি প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্যের ভাণ্ডার। সেখানে দেখার মতো অনেক কিছু আছে। তাই দলবেঁধে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। সময় তার আপন গতিতে চলছে, ঘড়ির কাটা ১২টা অতিক্রম করে সামনে অগ্রসর হচ্ছিলো, ঠিক এমনই সময় আমাদের গাড়িটিও নড়ে উঠলো, খুশিতে আমার মনটাও নেচে উঠলো। ধীরে ধীরে তার গতি বাড়লো এবং এক সময় বেশ জোরেই চলতে লাগলো। আমার জীবনের প্রথম কক্সবাজার ভ্রমণ শুরু হলো। এই আনন্দের আসলেই কোন তুলনা নেই। জানালার পাশে দু'চোখ ভরে দেখলাম শুধু সবুজ আর সবুজ। কি সুন্দর!

সবুজের দৃশ্য দেখতে দেখতে আমার চোখ জুড়িয়ে গেলো। চলতে চলতে একটা গ্রামের পাশ দিয়ে যখন গাড়িটা অতিক্রম করলো তখন দেখি ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা খালি গায়ে হাঁটু পানিতে নেমে মাছ শিকার করছে। যাদের গ্রামের বাড়ি নেই, তারা হয়তো হাঁটু পানিতে নেমে মাছ ধরার আনন্দ কোন দিন বুঝবে না। বর্ষার সময় বড়শি দিয়ে পুঁটি, কৈ আর টেংরা মাছ ধরার আনন্দ বুঝবে না। ইস! কত্তো আনন্দ ওদের! ওদের মতো যদি আমিও হাঁটু পানিতে নেমে মাছ ধরতে পারতাম! পথে কয়েকটি নদী পড়লো। এক সময় গাড়ি এসে পৌঁছল ফেনী শহরে। দূর থেকে দেখলাম সবুজ পাহাড়। মনটা আনন্দে দুলে উঠলো। প্রকৃতি যেন এখানে অন্য এক রূপে নিজেকে মেলে ধরছে। যত দূর চোখ যায় সবুজ মাঠ, তারই সাথে দিগন্ত রেখায় পাহাড়ের ছায়া। কোথাও বা খুব কাছে পাহাড়ের প্রায় কোল ঘেঁষে ছুটে চলছে বাস। এক সময় যখন বাসটা ক্লান্ত শ্লথ গতিতে কক্সবাজার এসে প্রবেশ করলো তখন আমার মন জীবনের প্রথম কক্সবাজার ভ্রমণের তৃপ্তিতে টইটম্বুর।
গাড়ি থেকে নেমে প্রথমে আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করলাম। খাওয়া-দাওয়া সেরে রাতে লম্বা এক ঘুম দিলাম। মধ্য রাতে হঠাৎ একবার জেগে উঠলাম। নিরব নিস্তব্ধ কক্সবাজার। চতুর্দিকে কোন সাড়া শব্দ নেই। নেই কোন হৈ চৈ... এরই মাঝে খঁ...খঁ...করে নাক ডাকার বিকট আওয়াজ শুনতে পেলাম। বেশ ভয় লাগলো। সৈকতে যাওয়ার শিহরণে ঘুমে-অঘুমে কেটে গেল রাত। দুপুর সাড়ে এগারোটায় রওনা হলাম সমুদ্র সৈকতের দিকে। পথের দু'পাশে বড় বড় গাছের সারি। সমুদ্রের তীর ঘেঁষে রাস্তা। একটু পরই সাগর পাড়ে এসে গেলাম। জীবনে কখনো নদী দেখা হয়নি যার ভালো করে, সে যদি হঠাৎ এসে দাঁড়ায় সাগর পাড়ে, মনের অবস্থা তার কেমন হতে পারে তা বোধহয় বুঝতে কারও অসুবিধা হবে না। সমুদ্রের বিশালতা দেখে আমি অভিভূত হয়ে পড়লাম।

তখন সাগরে জোয়ার শুরু হয়েছে। কী ভীষণ গর্জন! একজন বললেন, সাগরে যখন ঝড় ওঠে তখন একেকটা ঢেউ পাহাড় সমান উঁচু হয়। আমি সাগর দেখে মুগ্ধ হলাম। আমার ভয় ভয় করছিলো, তবুও সাগরে নামলাম। হেঁটে হেঁটে অনেক দূর চলে গেলাম, তবুও হাঁটু পানির বেশি হলো না। সাগরে নেমে সবাই মিলে সাঁতার কাটলাম। ঢেউ যখন আসে তখন পায়ের নিচের বালু সরে যায়। মনে হয় এই বুঝি ডুবে যাবো। এক কোষ পানি হাতে নিয়ে কুলি করার জন্য মুখে দিলাম, মনে হলো যেন এক মুঠ লবণ মুখে দিলাম।

সমুদ্রের পানির উপরের অংশে ৩২শতাংশ থেকে ৩৪.৫ শতাংশ পর্যন্ত লবনাক্ততা উঠা নামা করে। উপকূলীয় অঞ্চলে এর ব্যাপ্তি ১০শতাংশ থেকে ২৫শতাংশ পর্যন্ত। এই সমুদ্রের পানি থেকেই উৎপাদন করা হয় লবণ। সূর্যের তাপের সাহায্যে সমুদ্রের পানিকে বাস্পীয়করণের মাধ্যমে লবণ উৎপাদন করা হয়। দেশে মোট ১২হাজার থেকে ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে ৭লাখ মেট্রিক টনেরও অধিক লবণ প্রায় ৩৫ হাজার লবণ চাষীর মাধ্যম্যে উৎপাদিত হয়। এছাড়া কুতুবদিয়া ও মহেষ খালী দ্বীপে সৌর পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন করা হয়।

জোয়ারে সাগরের পানি বাড়তে লাগলো। ভাটার সময় সাগরের পানি দূরে সরে যায়, তখন সাগরে ঢেউ থাকে না। কিছুক্ষণ ঢেউয়ের সাথে খেলা করে আমরা পাড়ে উঠে এলাম এবং বাতাসে কাপড় শুকালাম। সাগর পাড়ে শুধু বালু আর বালু। রোদে ঝিকমিক করছে। নানা রঙ্গের সুন্দর সুন্দর শামুক-ঝিনুক কুড়ালাম। ঢেউয়ের সাথে যখন শামুক আসে তখন তাড়াতাড়ি শামুক কুড়াতে হয়। না হলে আরেকটি ঢেউ এসে শামুকগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যায়। মজার কথা হলো, আমরা শামুক কুড়াতে গেলেই পানি ছুটে আসে তখন দৌড়ে চলে আসি। স্বপ্ন আর সম্ভাবনার জলরাশি বঙ্গোপসাগর। বাংলাদেশের সমৃদ্ধি আর অগ্রগতির প্রধান নিয়ামক শক্তি এটি। সাগরকে ঘিরে যে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে তা যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি তাহলে বদলে যেতে পারে বাংলাদেশের চেহরা।

সমুদ্র আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমরা এখনও সেই ডাকে সাড়া দিতে পারিনি। বঙ্গোপসাগরের মাঝে লুকিয়ে থাকা সম্পদের খোঁজ খবরও আমরা করতে পারিনি। বাংলাদেশের আয়তনের চেয়ে সমুদ্রসীমা অনেক বড়। যা আমাদের অনেকের কাছে অজানা। সমুদ্র সীমার আয়তন প্রায় এক লক্ষ ৪৬হাজার বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে সমুদ্র উপকূল ৭১০কিলোমিটার। এর মধ্যে ৩২০কিলোমিটার বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিশেষ সীমানার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের খনিজ সম্পদ, গ্যাস, ম্যানগ্রোভ বন, মৎস সম্পদ, শৈবাল, লবণসহ অনেক কিছু। দেশের সীমানায় এইসব সম্পদের মাঝে রয়েছে ৪৯০ প্রজাতির মাছ, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, চার প্রজাতির লবস্টার, ১৫ প্রজাতিরও অধিক কাঁকড়া, ১৩ প্রজাতির প্রবাল এবং আরো রয়েছে কস্তুরা শামুক-ঝিনুকসহ প্রভৃতি সম্পদের ভান্ডার। বঙ্গোপসাগরের ৪৯০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছের মধ্যে ৭০ এরও অধিক মাছ বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে চিংড়ি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। এছাড়াও বঙ্গোপসাগরে বহুধরণের খনিজ সম্পদ রয়েছে। যেগুলো অনবিক বোমা তৈরি, রঙিন টেলিভিশন উৎপাদনসহ বহুবিধ উন্নতমানের শিল্প ও আধুনিক শিল্পে অতিমূল্যবান কাচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।


লেখক: মুহাম্মাদ আবদুল আলীম, চেয়ারম্যান: ম্যাক্সগ্রিণ বাংলাদেশ
ই-মেইল: [email protected]

বিডি-প্রতিদিন/০২ জানুয়ারি ২০১৬/ এস আহমেদ

সর্বশেষ খবর