২ জানুয়ারি, ২০১৬ ১৪:০৫

আমাদের সিনেমা, আমাদের বিনোদন

সাজ্জাদ কাদির

আমাদের সিনেমা, আমাদের বিনোদন

ছেলে বেলা বলতে যেটি বোঝায় আমার জীবনে সেই সময়টি ছিল ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৫ সন পর্যন্ত সময়কাল। মফস্বল শহরে আমাদের তখনকার বিনোদন বলতে ছিল সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা, রেডিওতে সিনেমার গান শোনা, ক্যাসেটে ব্যান্ডের গান শোনা, আর টেলিভিশন বলতে ছিল একমাত্র বিটিভির সাপ্তাহিক ও ধারাবাহিক নাটক দেখা। ছেলে বেলার এই সমস্ত বিনোদনের মধ্যে একটি অন্যতম প্রধান বিনোদন ছিল সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা। আমার আজকের বিষয় সিনেমা।

তখন শুধুমাত্র রেডিওতে সিনেমার ট্রেলার প্রচার হত। ট্রেলারে নায়ক-নায়িকার নাম, পরিচালকের নাম, গান ইত্যাদি শুনে বুঝে ফেলতাম কোন সিনেমাটি ভাল হবে। ট্রেলার শুনতাম আর ওই ভাল সিনেমাটি দেখায় উদ্বুদ্ধ হতাম। সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার সিনেমা হলগুলোতে নতুন সিনেমা মুক্তি পেত।কোন কোন সিনেমা বেশি জনপ্রিয় হলে ২/৩ সপ্তাহও চলত। আমাদের থানা শহরটিতে দু'টি সিনেমা হল ছিল। পরবর্তীতে আরও একটি গড়ে ওঠে। বর্তমানে অবশ্য প্রথম দু'টি পুরোপুরি বন্ধ তৃতীয়টি কোনরকমে চলমান, যেটি যে কোন সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে!

আমরা শুক্রবার সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসতাম আর কান খাড়া করে থাকতাম কখন সিনেমা হলের মাইক বের হবে। সিনেমা হলের মাইকিং শুনে জানতে পারতাম রেডিওর ট্রেলার শোনা অমুক সিনেমাটি অমুক হলে লাগিয়েছে। সেদিন পড়া সিকেয় উঠত। মতলব করতাম কখন সিনেমার পোস্টার দেখতে যাব। সেইসঙ্গে চলত সারা সপ্তাহের জমানো টিফিনের টাকার হিসাব। যে টাকা জমেছে সেটি দিয়ে ওইদিনই মেটিনি(দুপুরের)শোতে সিনেমাটি দেখা যাবে কিনা। তারপর যে কোনভাবেই কয়েকজন বন্ধু মিলে সিনেমাটি দেখে ফেলতাম। এভাবে চলত প্রতি মাসেই ২/১টি সিনেমা দেখা। সিনেমাগুলি একদিকে যেমন বিনোদন দিত, অন্যদিকে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির শিক্ষা দিত। ওই সময় ছেলেবেলার বিনোদনের একটি অন্যতম মাধ্যম ছিল আমাদের গৌরবের সিনেমা। অন্যদিকে '৯৫ পরবর্তী সময় থেকেই প্রত্যেকের ছেলেবেলার বিনোদনের রঙ পাল্টাতে শুরু করে। এর পিছনে অবশ্য হাজারও কারণ আছে।

শুধু তাই নয় পুরো পরিবারের মা-বাবা, ভাই-বোন, চাচা-চাচি, মামা-মামী, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই একসঙ্গে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতেন। ভাল সিনেমা হলে আশপাশের গ্রাম-গঞ্জ থেকে বাস রিজার্ভ করে নিয়ে এসেও মানুষ স্বপরিবারে সিনেমা দেখতে আসতেন। ভাল সিনেমা একজন দশজনের কাছে প্রচার করতেন। ফলে দেখা যেত যে, ভাল গল্পের, ভাল নির্মাণের সিনেমাগুলো যতই দিন যেত দর্শক সমাগম ততই বাড়ত। প্রতিটি সিনেমা হলে সাইকেলের একটি করে গ্যারেজ থাকত যেখানে দূরদূরান্ত থেকে আসা সিনেমা দর্শকরা সাইকেল রেখে সিনেমা দেখতেন। প্রতিটি থানা শহরে ২/৩টি সিনেমা হল ছিল। বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরগুলিতে ৫/৬টি সিনেমা হল ছিল। এই সিনেমা হলগুলোকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছিল। '৯০-'৯২ সন পর্যন্ত প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সিনেমা হল তৈরি হয়েছে। যার প্রেক্ষিতে একটি সময় দেশে সিনেমা হল সংখ্যা হাজার দেড়েক ছুঁতে যাচিছল। এখন নাকি সেই সংখ্যাটি কমতে কমতে তিনশ'র কোঠায় নেমে এসেছে। সংখ্যাটি কী আরও কমবে? যদি সত্যিই কমে তাহলে আমাদের সিনেমা বলতে যেটি অবশিষ্ট আছে সেটি কোথায় প্রদর্শন হবে সে প্রশ্ন এদেশের সিনেমা সংশ্লিষ্ট সবাইকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে- এই অবস্থা কেন হল?এর পেছনে বহুমূখী কারণ আছে। প্রথম কারণটিই হল-'৯০ দশকের শুরুর দিকে এদেশের সিনেমা ব্যবসায় কিছু অসাধু মানুষের আগমন ঘটে। যাদের সিনেমার সঙ্গে, এমনকি কোন প্রকার শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে আত্নার যোগাযোগ ছিল না। তারা শুধুই ব্যবসার জন্য, মুনাফার জন্য এই জগতে প্রবেশ করে। এই মানুষগুলি প্রথম পদক্ষেপেই আমাদের সিনেমায় অশ্লীলতার আমদানি ঘটায়। যে মুহূর্তে এদেশের সিনেমায় অশ্লীলতা প্রবেশ করে ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই দর্শকের নিকট দেশের শত শত সিনেমা হলগুলি পারিবারিক, সামাজিক বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দুর বাইরে চলে যায়। পরিবারের মা-বাবা, ভাই-বোন, চাচা-চাচি, মামা-মামী, পাড়া-প্রতিবেশীর সেই বিনোদনের জায়গা পরিণত হয় বখাটেদের আখড়ায়। যার কারণে সিনেমা হলগুলো দর্শক হারানো শুরু করে। দর্শক না থাকায় সিনেমা হলগুলোর ব্যবসায় ব্যাপক ধস নামে। ব্যবসা না থাকায় ২০০০ সনের দিক থেকে সিনেমা হলগুলো বন্ধ হতে থাকে।

অন্যদিকে নতুন আগত অশ্লীল সিনেমা প্রকৃত সিনেমা সংশ্লিষ্ট মানুষগুলোকে কোনঠাসা করে ফেলতে থাকে। এই অসাধু মানুষগুলোর দৌরাত্মে ভাল পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা, কলা-কুশলীরা জিম্মি হয়ে পড়ে। তাদের অনেকেই এ জগৎ থেকে দূরে সরে যান। আর সেই সুযোগে এদেশের গৌরবের সিনেমা পুরোপুরি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়।

১৯৯৭ সনের দিকে এদেশে স্যাটেলাইট টেলিভিশন সংস্কৃতি চালু হয়। ওই সময়েই আমরা ধীরে ধীরে ইন্টারনেট দুনিয়ায় প্রবেশ করতে থাকি। ঘরে ঘরে আকাশ সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে। আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে আমাদের সিনেমার জায়গায় স্থান নেয় বিদেশি সিনেমা, বিদেশি অনুষ্ঠান। আমাদের বিনোদন হয়ে যায় একটি 'খিঁচুড়ি টাইপ' বিনোদন। যার প্রতিফলন ঘটে রাষ্ট্রে, সমাজে।

কথায় আছে যে, খাদের কিনারেও নাকি এক ফোটা আলো থাকে। আমাদের সিনেমার ক্ষেত্রেও সেটি প্রযোজ্য। ওই সময়ের প্রতিকূল পরিবেশেও অল্প ক'জন ভাল সিনেমা পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা, কলা-কুশলী এই অঙ্গনে নিভু নিভু করে কাজ করতে থাকেন। যারা মাঝেমাঝেই ভাল সিনেমা উপহার দিতে থাকেন। যা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। এই অপ্রতুল সিনেমা দিয়ে আর ব্যবসা হয় না। অন্যদিকে ততদিনে সিনেমা হলের পরিবেশ পুরোপুরিই নষ্ট হয়ে গেছে এবং অনেকগুলি বন্ধ হয়ে গেছে। যার কারণে ভাল সিনেমা মাঝে মাঝে আসলেও দর্শক আর হলে ফেরেনি।

বর্তমানে আশার কথা হল সিনেমা সংশ্লিষ্ট ওই ভাল শ্রেণিটির হাত ধরেই বর্তমানে অনেক মেধাবী, সৃজনশীল তরুণ-তরুণী পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা, অভিনেত্রী, কলা-কুশলী হতে আসছেন। অনেকে সিনেমার উপর বিদেশে পড়ালেখা করেও আসছেন। আবার অন্যদিকে অনেকে সিনেমার কিছু না জেনেও আসছেন। এই না জেনে আসা মানুষগুলি এক সময় আমাদের চরমভাবে ডুবিয়েছিল। ভবিষ্যতে যাতে এই শ্রেণিটি আর ডুবাতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সিনেমা শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে যারা আসছেন তাঁদের জন্য সরকারি-বেসরকারি সকল মহল থেকে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। তাঁরা যেন কাজ করতে এসে কোনভাবেই হতাশ হয়ে ফিরে না যান সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এজন্য সবার আগে যেটি প্রয়োজন সেটি হচ্ছে সিনেমা নির্মানের জায়গাটি পরিচ্ছন্ন করা। বিশ্ব সিনেমা নির্মাণ প্রক্রিয়ার আদলে আমাদের সিনেমা নির্মাণ জগতে সাধ্যমতো সবধরনের সুযোগসুবিধা যোগ করতে হবে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে সিনেমা প্রদর্শনের জায়গা তৈরি করা। যেভাবে মহামারির মত সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সেই জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন নতুন সিনেমা হল গড়ে তুলতে হবে। এর ফলে একদিকে ভাল সিনেমা নির্মাণ হবে, অন্যদিকে ভাল পরিবেশে সিনেমাটি প্রদর্শণ হবে। দেশের মানুষ নিজস্ব সিনেমার মাধ্যমে আবারও হারানো সেই সুস্থ্য বিনোদন উপভোগ করবে।
লেখাটি শুরু করেছিলাম ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ দিয়ে। আজকে এই সময়ে এসেও প্রত্যাশা করব আমরা যেমন ছেলেবেলায় সিনেমা থেকে শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারতাম, তেমনি এখনকার প্রজন্মও সিনেমা থেকে শিক্ষা নেবে। আজকের বিচিত্র ঘরানার বিনোদনের পাশাপাশি প্রতিটি পরিবার আমাদের সিনেমা দেখতে আসুক। সেই লক্ষে আমরা ভাল ভাল সিনেমা তৈরি করব এবং প্রদর্শনের জায়গা তৈরি করব- এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক: টেলিভিশন উপস্থাপক, অনুষ্ঠান নির্মাতা ও স্ক্রীপ্ট লেখক।
ই-মেইল: [email protected]

বিডি-প্রতিদিন/০২ জানুয়ারি ২০১৬/ এস আহমেদ

সর্বশেষ খবর