৫ মার্চ, ২০১৬ ১৬:২৯

স্মৃতির মুখচ্ছবিতে এডন্টনের আনন্দমেলা

দেলোয়ার জাহিদ, কানাডা

স্মৃতির মুখচ্ছবিতে এডন্টনের  আনন্দমেলা

সারা বিশ্ব থেকে পঁচাশিটিরও বেশি সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বকারী অবিশ্বাস্য এক জনসমাগমের মেলা বলে খ্যাত এডমন্টনের "সারভাস হেরিটেজ ফেস্টিভাল" হয়ে গেল গত জুলাইয়ের শেষে। কানাডার স্পন্দনশীল বহুবিচিত্র ঐতিহ্যের কেন্দ্রে, উত্তর সাসকাচোয়ান নদীর সীমানায় প্রতিবছরই অনুষ্ঠিত হয় উত্তর আমেরিকার উল্লেখযোগ্য এ বড় মেলা যা হেরিটেজ ফেস্টিভ্যাল বলে খ্যাত।

গতবছর মেলার ৪০তম বার্ষিকী উদযাপিত হলো যাতে প্রায় ৬০টি প্যাভিলিয়ন অংশ নিয়েছিলো। বিশ্বের নানা সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বকারী এ অবিশ্বাস্য উদযাপনের অংশ হয়েছিলো বাংলাদেশ. সুস্বাদু রন্ধনসম্পর্কীয় খাদ্যের নমুনা, সৃষ্টিশীল সাংস্কৃতিক পারফরমেন্স, শিল্প, আর্টওয়ার্ক এবং পোশাকের দোকান অথবা তাদের সাংস্কৃতিক শিকড় ও কানাডায় তাদের অধুনাতন সম্প্রদায় সম্পর্কে একটু জানতে আগ্রহী মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতার এক অপূর্ব সুযোগ।

বহুবিচিত্র এ মেলা উদযাপনে বাংলাদেশকে গর্বিতভাবে উপস্থাপনের সুখ ও আনন্দ আজও মনকে আপ্লুত করে। বাংলাদেশ যে আন্তর্জাতিক মঞ্চেও স্থান করে নিতে পারে এবং স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো তাদের দূরদর্শিতায় মতবিরোধ ভুলে অনন্য সব উদহারণ সৃষ্টি করতে পারে- তা দেখিয়েছে "হেরিটেজ ফেস্টিভাল"।
 
প্রবাসে বাংলাদেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে প্রতিবারের মত এবারও আলবার্টায় বৈশাখী মেলা তথা ‘বাংলাদেশ ফেস্টিভ্যাল’-এর আয়োজন করছে বাংলাদেশ হেরিটেজ এন্ড এথনিক সোসাইটি অব আলবার্টা, বাংলাদেশ-কানাডা এসোসিয়েশন অব এডমন্টন, বাংলাদেশ হেরিটেজ মিউজিয়াম এবং বাংলাদেশ  প্রেসক্লাব অব সেন্টার  আলবার্টা (BPCA) ও অন্যান্য সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন। 

বাংলাদেশ ফেস্টিভ্যাল বা বৈশাখী মেলার আয়োজনে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে সংগঠনগুলোর ব্যাপক নিজস্ব প্রস্তুতি ও আয়োজন। বর্ণাঢ্য এসব আয়োজনে থাকছে দেশ ও প্রবাসের স্বনামধন্য শিল্পীদের ও স্থানীয় শিল্পীদের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা, থাকছে স্টল, রকমারী ও বাহারি সব দেশজ পণ্যের সমাহার। 

প্রাদেশিক সরকারের প্রতিনিধিসহ বাঙালি কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এ সব ফেস্টিভ্যাল বা মেলায় অংশগ্রহণ করবেন, অংশগ্রহণ করবেন পরিবার পরিজন নিয়ে প্রবাসী পেশাজীবী সম্প্রদায় ও কানাডার উৎসাহী মানুষ। বাংলাদেশ ফেস্টিভ্যালকে জনপ্রিয় ও সফল করে তুলতে সকল প্রবাসী বাঙ্গালীদেরই সহযোগিতা প্রয়োজন। 

দু’হাজার দুই সালের নভেম্বরের কথা। স্পেনের ভিগো থেকে মাদ্রিদ হয়ে টরন্টো। চারিদিকে স্নো পড়ে যোগাযোগ  বিপর্যস্ত প্রায়। নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে রয়েছি বাইরে। স্মৃতিতে ভাসছে ইউরোপের ৭টি বছর, স্বদেশের ব্যস্ততম জীবন, আর দেশত্যাগী হৃদয়ের শেকড় উপরানো যন্ত্রণা। ভাসছে নেদারল্যান্ডস, ব্রাসেলস, জার্মান ও স্পেনের ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতি। বিশেষত স্পেনের বড় বড় মেলা ঘুরে দেখার স্মৃতি।

ইউরোপের এক স্বপ্নপূরীর নাম নেদারল্যান্ডস। দুবাই, ওয়ার্স হয়ে আমস্টারডাম বিমানবন্দরে এসে নামলাম ’৯৫ সালের মাঝামাঝি। সে ছিলো এক বিচিত্র অনুভুতি। ট্রেন চেপে এলাম ব্রাসেলসে। স্বদেশ ছেড়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ যেন হৃদয়কে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে। এদিক ওদিক ঘুরে  বেড়ালাম দু’দিন। বেশ ভালই লেগেছে ব্রাসেলস। তারপর জার্মানি...।

ইউরোপে মাইগ্রশানের তিক্ত স্মৃতির বেদনা নিয়ে পাড়ি জমালাম কানাডায়। পরিবার, পরিজন রয়ে গেলো স্পেনের গালিসিয়ায়। এ জীবনে নির্জনতা, একাকীত্ব  নতুন কিছু নয়। মনে পড়ে জার্মানের দক্ষিন পশ্চিম সীমান্তের ছোট্ট শহর-ফ্রাইবুর্গের কথা। শহরের পশ্চিমে বয়ে গেছে ড্রাইসেম নদী, কিনারায় ব্ল্যাক ফরেস্ট। এক হাজার ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ রেইন নদী যা বয়ে গেছে জার্মান, ইটালী, অস্ট্রিয়া, লিসটেন স্টাইন, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ড পর্যন্ত। হৃদয়ে সাত শত নদ-নদীতে ঘেরা বাংলাদেশ। যেখানে রয়েছে ঘাত, প্রতিঘাত জীবন চলার পথে তবুও স্বপ্ন, ছুটে চলে জীবনের উল্টো রথে। এখনো স্মৃতিপটে ভেসে উঠে স্পেনের সে আনন্দমেলা গুলোর কথা। বরফের চাদরে মোড়ানো এডমন্টন শহরে অবিশ্বাস্য উচ্চতায় এরকম মেলা হতে পারে তা ভাবাও কষ্টকর।
  
বাংলাদেশ পেভিলিয়নে নজরকাড়া মানুষের ভীড় ছিল। খাবারের প্রতি আগ্রহ ছাড়াও পোশাক, জুয়েলারি, কারুকাজের প্রতি মানুষের আগ্রহ ছিল প্রচুর। যেমন এবছর বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন তথা একুশে ফেব্রুয়ারি প্রবাসী বাঙালির জীবনে এক স্মরণীয়  অধ্যায় হয়ে থাকবে। একুশে আমাদের গ্লানি আর আত্নপ্রবঞ্চণা বিমোচনের দিন, একুশে আমাদের স্বাতন্ত্র্যবোধকে জাগ্রত করার একটি দিন, সেদিন যাদের অসামান্য অবদানের জন্য আমরা আজ মাতৃভাষা (বাংলা)য় লিখছি, বলছি, প্রাণ খুলে হাসছি, আলোচনায় মাতছি, তাদেরকে সশ্রদ্ধ সালাম। একুশের  ভাষা আন্দোলনে, স্বাধীকার রক্ষার লড়াইয়ে, অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন এ সকল ভাষাসংগ্রামী। অনেক অনেক বিস্তৃত ছিলো তাদের কাজের পরিধি। আর এর প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে সফলতা তুলে আনতে বিশ্বব্যাপী প্রবাসী বাঙালিরা আজো উৎসাহি ও নিবেদিত প্রাণ।

একুশেতে এবারই প্রথম কানাডার এডমন্টন পাবলিক লাইব্ররিতে (অবর্টসফিল্ড) হয়েছে বাংলা বইমেলা, ও ১৯ ফেব্রুয়ারি  ইউনিভার্সিটি অব ম্যাকইউনে বহুসংস্কৃতির উপর একটি খোলা সঙ্গীতানুষ্ঠান হয়ে গেল।

বাংলাদেশ হেরিটেজ এবং এথনিক সোসাইটি অব আলবার্টা (BHESA) বাংলাদেশি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে কানাডার আলবার্টা প্রদেশে বেশ সফলতার সঙ্গে তুলে ধরেছে। বাংলাদেশি স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন অব আলবার্টা ইউনিভার্সিটি (BSAUA) বাংলাদেশি ছাত্রদের একটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নিবন্ধিত সংগঠন। এর কার্যক্রম ও বাংলাদেশি ছাত্রদের সমষ্টিক কল্যাণের জন্য। বাংলাদেশ কানাডা এসোসিয়েশন অব এডমন্টন ( BCAE ) বাংলাদেশি অভিবাসীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অলাভজনক কাজের দীর্ঘ ঐতির্হ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব কালগিরি (BCAOC) ১৯৬৪ সালে এর যাত্রা শুরু। কানাডায় মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে টেলিভিশনে (১৯৭১ সালে) স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বলিষ্ঠ ভুমিকা রাখে। স্বাধীনতাযুদ্ধকালীন ও পরবর্তী সময়ে এখানে মাইগ্রেট করতে বা দের অনেক সাহায্যে করেছে। এ এসোসিয়েশন ও প্রবাসে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে অনেক উজ্জ্বল করেছে। বাংলাদেশি কমিউনিটি অ্যাসোসিয়েশন অব সাস্কাচেওয়ান (বিকাশ)আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে স্বীয় প্রদেশে প্রশংসনীয় কাজ করেছে।

বাংলাদেশের সংস্কৃতি স্বদেশের গণ্ডি পেরিয়ে প্রবাসে ও তার স্থান দখল করে নিচ্ছে। কানাডার রাষ্ট্র, সরকার প্রধান ও মন্ত্রীদের শুভেচ্ছা বাণী নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে হেরিটেজ ম্যাগাজিন যা অনলাইনেও পড়া যায়। এছাড়া নিবন্ধিত, অনিবন্ধিত এমন সংগঠনের সংখ্যা প্রবাসে নিতান্ত কম নয়, তবে স্থানাভাবে তাদের সকলের কথা এখানে তুলে ধরা সম্ভব না হলেও তাদের দেশীয় ঐতিহ্য প্রবাসে তুলে ধরার প্রয়াসকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হয়। এবছর কোন সমন্বিত উদ্যোগর মধ্যমে বৈশাখী মেলাগুলো (বাংলাদেশ হেরিটেজ ফেস্টিভ্যাল নামে) সংগঠিত করতে এবং স্থানীয় সরকার, প্রশাসন ও মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি।

লেখক: বাংলাদেশ প্রেসক্লাব সেন্টার অব আলবার্টা ও বাংলাদেশ হেরিটেজ মিউজিয়াম-এর সভাপতি এবং বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, কানাডা ইউনিট কমান্ডের নির্বাহী সদস্য।

 

বিডি-প্রতিদিন/ ০৫ মার্চ, ২০১৬/ রশিদা

সর্বশেষ খবর