৮ মার্চ, ২০১৬ ১৫:৩৭

আর নারী দিবস পালন করতে চাই না

আফরোজা হীরা

আর নারী দিবস পালন করতে চাই না

আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সারা বিশ্ব নানা কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালন করছে দিনটি। আমরাও পিছিয়ে নেই, সবার সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও ব্যাপক 'ধুমধামের' সঙ্গে পালন করছে এই দিনটি। নারী দিবস পালন হচ্ছে, কিন্তু পুরুষ দিবস তো পালন হচ্ছে না! হ্যা, নারীরা বৈষম্যের শিকার তাই এ দিবস। পুরুষতান্তিক সমাজে পুরুষ দিবসের দরকার কি? কিন্তু আর কতকাল এভাবে নারী দিবস পালন করবো আমরা?

আজ নারী দিবসে মোবাইল আর ফেসবুকে বার্তা প্রেরণসহ বিভিন্ন উপহার সামগ্রী দিয়ে আমাদের দেশের পুরুষরা নারীদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। আসলে এই শুভেচ্ছার পিছনে আন্তরিক সম্মানবোধ কতটুকু আছে সেটা নিয়ে আমি বরাবরই সন্ধিহান। যাই হোক আসল কথায় আসি। যেখানে ফুল, কার্ড আর বার্তার বন্যা বয়ে যাচ্ছে, তার ঠিক পাশেই রয়েছে ভয়াবহ অন্ধকার দৃশ্য যা বছরের পর বছর আমরা দেখেও দেখছি না।

শিপ্রা, সন্ধ্যা, কনিকা- এরা আযানের আগে উঠে রান্না শেষ করে ১০/১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মফস্বলে আসে দিনমজুরি করতে, সারাদিন গাঁধার মত রাজমিস্ত্রীর সহকারি হিসেবে কাজ করে। এরা আট বা দশ ঘন্টার হিসাব জানে না। জানে না এদের ন্যায্য মজুরি কত! যেখানে একজন পুরুষ এদের চেয়ে কম কাজ করে দিনে (মিস্ত্রী ৫০০ টাকা, সহকারি ৩৫০ টাকা) বেশি টাকা পাচ্ছেন, সেখানে এসব নারীরা মাত্র ২৩০ টাকায় কাজ করছেন। তাদের বাধ্য করা হচ্ছে এভাবে কাজ করতে, কেউ প্রতিবাদ করতে এলে তাকে বাদ দিয়ে অন্য লোক নিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। পেটের দায়ে তখন মুখ বুজে এসব মেনে নিয়েই কাজ করছে এইসব নারীরা।

আবার কাজের ফাঁকে কোথাও এক দন্ড দাঁড়ালে কুকুরের মত আচরণ করা হচ্ছে তাদের সাথে। কখনো গায়ে হাত তুলতেও কার্পণ্য করা হচ্ছে না। অথচ একই জায়াগায় অনেক পুরুষ শ্রমিক বসে দিব্যি বিড়ি টানছেন। তাদেরকে কিছু বলছে না কেউ। এটা নারী দিবসে স্বচক্ষে দেখে এলাম আজ সকালে। স্থান বন্দরনগরী মংলা। অনেক সম্ভাবনার ডানা মেলছে এ সমুদ্রবন্দরটি। পদ্মা সেতুকে সামনে রেখে নতুন রূপে সাজছে মংলা। কিন্তু এখনো শিক্ষায় ও বৈষম্যহীন কর্মক্ষেত্র তৈরিতে অনেক পিছিয়ে এ বন্দরনগরী।

শিপ্রার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, তার স্বামী আর একটা বিয়ে করেছে। তাদের কোনো ভরন-পোষন দেয় না। সে একাই রাস্তায় কাজ করে ছেলেকে খুলনায় হোস্টেলে রেখে পলিটেকনিক্যালে পড়ায়। মেয়েটা ক্লাস এইটে পড়ে। তার বক্তব্য- খাই, না খাই, ছেলে মেয়ে দু'টোকে মানুষ করতে হবে। শিপ্রার এ বক্তব্য চিন্তাশক্তির ইতিবাচক দিক নির্দেশ করে। বদলাচ্ছে মানুষের ভাবনার জগত। কিন্তু শ্রমবৈষম্য বদলাচ্ছে কোথায়? একজন শ্রমিক মা যখন হাড়ভাঙা খাটুনি দিয়ে নিজের দুই সন্তানকে মানুষ করার জন্য প্রাণপনে লড়ছেন, তখন তাকে আমরা ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করছি!

 

পল্লবীর স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলে তাকে খেতে দেয় না। পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সে এসে রাস্তায় দিনমজুরের কাজ করে বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করছেন এ নারী। তাকেও ঠকানো হচ্ছে। নারী উন্নয়নে বর্তমান সরকার অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। ঝরে পড়ার হার কমেছে। কিন্তু দূর হয়নি শ্রম বৈষম্য। অধিকাংশ খাতেই নারী শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে নেওয়া হয়নি কোন উদ্যোগ। এখানে একদিকে মোমবাতি জ্বালিয়ে, সেজেগুজে র‌্যালি করে, নানা কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে নারী দিবস পালন হচ্ছে, অন্যদিকে একজন বৃদ্ধা মা সারাদিন হাঁড়ভাঙা খাটুনির পর অর্ধেক মজুরি নিয়ে বাড়ি ফিরছে! এই লজ্জ্বা কার?

আজ যাদেরকে সচেতন করতে নারী দিবস পালন করা হচ্ছে, তারা আসলেই কি এ দিবস থেকে কোন বার্তা পাচ্ছে? আসলেই কি এই দিবসে নারীর মর্যাদা কিছুটা বেড়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতা খুললে চোখে পড়ে। পাতায় পাতায় ভেসে ওঠে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ আর খুনের ছবি। নারী দিবসের একদিন আগে মিরপুরে এক নারী গৃহশ্রমিককে ভবন থেকে ফেলে হত্যার অভিযোগ উঠলো। পুলিশ প্রথমে মামলাই নিতে চায়নি। পরে এলাকাবাসীর বিক্ষোভের মুখে মামলা নিতে বাধ্য হয়। যে দেশে একজন নারী গৃহশ্রমিকের অস্বাভাবিক মৃত্যুতে পুলিশ মামলাই নিতে চায় না, সেখানে নারীরা কতটা নিরাপদ? আজ নারী দিবসেও হয়ত দেশের বিভিন্ন স্থানে নারী নির্যাতনের খবর আগামীকালের পত্রিকা খুললে চোখে পড়বে। আর কতকাল সমাজকে সচেতন করতে আমরা নারী দিবস পালন করব? সেই দিনটি কবে আসবে যেদিন সমঅধিকারের জানান দিতে দেশে দেশে নারী দিবস পালন করার দরকার পড়বে না?

লেখক: একজন মা, নারী উদ্যেক্তা ও উপন্যাসিক
ইমেইল: [email protected]

বিডি-প্রতিদিন/০৮ মার্চ ২০১৬/ এস আহমেদ

সর্বশেষ খবর