৭ মে, ২০১৬ ১৪:২৮

রাষ্ট্রের ওপর জনগণের মালিকানা বাস্তবে কতটুকু?

ড. কালাম আজাদ

রাষ্ট্রের ওপর জনগণের মালিকানা বাস্তবে কতটুকু?

প্রতীকী ছবি

রাষ্ট্র কখন কীভাবে প্রথম গঠিত হয়েছিল তার কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বেশ কিছু মতবাদ রয়েছে। সেগুলোর একটি হলে সামাজিক চুক্তি মতবাদ। এ মতবাদের তিনজন প্রবক্তা হবস, লক এবং রুশো। তিনটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাদের মতবাদ ব্যাখ্যা করেছেন। তবে একটি বিষয়ে তারা একমত। সেটা হল জনগণ নিজেদের প্রয়োজনে চুক্তি করে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন। তাই রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। কিন্তু রাষ্ট্রের ওপর জনগণের এ মালিকানা কীভাবে বোঝা যায় বা পরিমাপ করা যায়? প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের ওপর জনগণের মালিকানা স্পষ্টতই দৃশ্যমান হয়। প্রাচীন গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্সের নাগরিকরা নিজেরা তাদের রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং বিচারসংক্রান্ত সব কাজ সম্পন্ন করত। স্বভাবতই এ নগর রাষ্ট্রের ওপর নাগরিকদের মালিকানা ছিল শতভাগ। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রসমূহের সাইজ এবং নাগরিকের সংখ্যা অনেকগুণ বেশি হওয়ায় নাগরিকরা নিজেরা রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম সম্পন্ন করতে পারেন না। এ জন্য এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ওপর জনগণের মালিকানা আছে কিনা বা কতটুকু আছে তার পরিমাপক হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়াসহ বেশকিছু রাষ্ট্র আছে যেখানে জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করে। একাধিক দল অবাধে নির্বাচনে অংশ নেয়, নির্বাচনের ফলাফলও সব পক্ষ মেনে নেয়। এসব রাষ্ট্রের ওপর জনগণের মালিকানা প্রাচীন এথেন্সের মতো শতভাগ না। কারণ প্রাচীন এথেন্সে রাজনৈতিক দল ছিল না, নাগরিকরা সরাসরি রাষ্ট্র পরিচালনা করত। কিন্তু আধুনিক এসব প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত দলগুলো রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রে কম-বেশি নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করে। তবে এভাবে শাসক দলগুলো এসব রাষ্ট্রের ওপর জনগণের মালিকানা কিছুটা করায়ত্ত করলেও বেশিরভাগ মালিকানা জগণেরই থাকে। কিন্তু অনেক রাজনৈতিক ব্যবস্থা রয়েছে যেখানে নির্বাচন হয় না। যেমন রাজতন্ত্র এবং সামরিকতন্ত্র। এসব ব্যবস্থা জনগণের ইচ্ছায় পরিচালিত না হয়ে শাসকের ইচ্ছায় পরিচালিত হয়। জনগণের পরিবর্তে এসব রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক বনে যান শাসকরা নিজেরাই। আবার অনেক রাষ্ট্র আছে যেখানে নির্বাচন ঠিকই হয় কিন্তু তা হয় একটি মাত্র দলের বিভিন্ন প্রার্থীর মধ্যে। নির্বাচনে  দলটির আদর্শ  ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারী কেউ প্রার্থী হতে পারে না। এ ধরনের রাষ্ট্রের উদাহরণ এক সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বর্তমানের চীন। বাস্তবে এসব রাষ্ট্রের মালিক সব সময়ই ওই দলটি, জনগণ নয়। আবার এমন অনেক রাষ্ট্র আছে যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের অনুকরণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, একাধিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং ভিন্নমত পোষণেও দৃশ্যত পুরোপুরি বাধা নেই কিন্তু দলগুলো নিয়মবহির্ভূত পথে ক্ষমতায় আসার প্রাণপণ চষ্টো চালায়। আর শাসক দল যেন ক্ষমতা ছাড়তেই চায় না। গণতন্ত্রের রেটিংয়ে এসব দেশ ফ্রিডম হাউস, পলিটি ইত্যাদি বিশ্ববিখ্যাত ডাটাবেজে নিচের দিকে অবস্থান করে। এগুলো এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন অ্যামেরিকার তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশ। এসব রাষ্ট্রের ওপর জনগণের মালিকানার অধিকাংশই এমনকি প্রায় শতভাগই দখল করে নেয় শাসক দল। 

আমাদের দেশের সংবিধান অনুসারে জনগণই রাষ্ট্রের মালিক। সংবিধানের প্রথম ভাগের ৭(১) ধারায় জনগণকে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার মালিক বলে ঘোষণা করা হয়েছে। নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান রয়েছে। দেশে অনেক রাজনৈতিক দলও রয়েছে। কিন্তু এতকিছুর পরও জনগণ কি আসলেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মালিক? ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক এমপি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের টিকিটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিল। ওই বিনা প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতার একমাত্র কারণ ছিল, একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি পূরণ না হওয়ায় অন্য একটি প্রভাবশালী দল বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা। ওই নির্বাচনের রায়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর উপজেলা নির্বাচন, সিটি নির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন এবং সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সম্পন্ন হলো। এসব নির্বাচনেরই ফলাফল প্রশ্নবদ্ধি হয়েছে। ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন থেকে শুরু করে ভোটকেন্দ্র দখল, দলীয় লোকদের দ্বারা ব্যালট পেপারে সিল মেরে ব্যালটবাক্স ভর্তি করা এবং শাসক দলের মার্কার প্রকাশ্য মনোনয়নবাণিজ্যে নির্বাচন শব্দটির অর্থই বদলে গেছে। ফলত সর্বত্র জয়জয়কার হয়েছে শাসক দলের। প্রিয় পাঠক! এবার বলুন, বাংলাদেশ সংবিধানের প্রথম ভাগের ৭(১) ধারায় লিখিতি 'প্রজাতনে্ত্রর সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ' কথাটি বাস্তবে কতটুকু সত্য?      

লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী গবেষক এবং দ্য ডেইলি স্টারের সাবেক সাব-এডিটর। 

ই-মেইল : [email protected]   


বিডি-প্রতিদিন/ ০৭ মে, ২০১৬/ আফরোজ

সর্বশেষ খবর