২৩ জুলাই, ২০১৬ ১৭:৩৯
পাঠকের গল্প

বেওয়ারিশ

সামিউল বাসির

বেওয়ারিশ

ছবি: ইন্টারনেট

গাড়িটা অনেকক্ষণ ধরেই জ্যামে আটকে আছে। ড্রাইভিং সিটে বসা ইফতেখারের দিকে তাকালেন রহমান সাহেব। গাড়ির এসি আজ দুইদিন হলো নষ্ট হয়ে আছে। ইফতিটা একদম গরম সহ্য করতে পারে না ছোটবেলা থেকে। "গরমে কি বেশি কষ্ট হচ্ছে খোকা।"

বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়লো ইফতেখার। এবারের গরমটা একদম ভ্যাপসা গরম। এসিটাও নষ্ট হবার সময় পেলো না। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রহমান সাহেব। ছেলেটার কষ্ট তার নিজেরও সহ্য হচ্ছে না।

জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে। ব্যস্ত নগরীর রাজপথ দিয়ে আস্তে করে গাড়ি এগোচ্ছে। পাশের ফুটপাত দিয়ে বাবার হাত ধরে স্কুল ইউনিফরম পরা বাচ্চাগুলি আগাচ্ছে ছোট ছোট পায়ে। চোখ বন্ধ করলেন রহমান সাহেব। স্কুল ইউনিফরম পড়া ইফতি তার হাত ধরে এগোচ্ছে। সাথে রাজ্যের শিশুসুলভ কথাবার্তা।

- বাবা, কাক পাখি পোষ মানে না ক্যানো?

- বাবা, স্কুলের বিড়ালটা আমার সাথে গল্প করে জানো?

- বাবা, আমার বার্থডেতে এত্তবড় একটা প্লেন কিনে দিবা।

হঠাত ব্রেক কষায় চোখ খুললেন রহমান সাহেব। ছোটবেলার ইফতিকে প্লেন কিনে দিতে না পারলেও নিজের ট্রিটমেন্ট এর জন্য জমানো টাকা থেকে বাইক কিনে দিয়েছিলেন এইচএসসির ভালো রেজাল্টের পর। ছেলেটা খুব খুশি হয়েছিলো সেদিন।

- তোর ব্যবসা ক্যামন চলছে খোকা?

- এই তো বাবা, সামনের সপ্তাহে একটা অর্ডার আসতে পারে। ওটা নিয়ে টেনশনে আছি।

- টেনশন করিস না, পেয়ে যাবি ওটা। আমি সবসময় বলি সবাইকে, খোকার ব্যবসার মাথা অনেক ভালো।

মৃদু হাসলো ইফতেখার। এটা বাবা সত্যি বলেছে। ওর ব্যবসার মাথা আর ভাগ্য, দুটোই ভালো। প্রভিডেন্ট ফান্ড এর পুরো টাকা ভেঙে রহমান সাহেব যখন তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন ব্যবসার পুজির জন্য, সবাই হায় হায় করে উঠেছিলো। ইফতেখার আজ একজন সফল ব্যবসায়ী।

- বাবা, তোমার কিছু লাগলে কল করে জানিয়ে দিয়ো। আমি পাঠিয়ে দিবো।

হেসে মাথা নাড়লেন রহমান সাহেব। ইফতিটা তার অনেক খেয়াল রাখে।

- বাবা, এখানে তোমার সমবয়সী অনেককেই পাবে। বিলিভ মি, তোমার সময় অনেক ভালো কাটবে। এদের ফ্যাসিলিটি ও ভালো অনেক।

- তুই আর বউমা যেটা ভালো বুঝিস।

দূরে ওল্ড হোমের গেট দেখা যাচ্ছিলো। গাছপালা ঘেরা ছায়াময় শান্ত পরিবেশের এই বৃদ্ধাশ্রমে দেশের মোটামুটি আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল মানুষদের বাবা মায়েরা থাকেন। একটা বয়সের পর বাড়ির ভেতরে এরা সবাই বোঝা হিসেবেই গণ্য হচ্ছিলেন। এই বৃদ্ধাশ্রমের ফ্যাসিলিটি ভালো। নামকরা একটা ট্রাস্ট এই বৃদ্ধাশ্রম চালায়। এই ট্রাস্ট এর অধীনে ওল্ড হোম বাদেও স্কুল, এতিমখানা, হাসপাতালসহ অনেক কিছুই আছে।

ইফতেখার যখন নামিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছিলো, রহমান সাহেব অনেকক্ষণ ধরে গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ছোটোবেলায় যখন খোকাকে স্কুলে নামিয়ে দিতেন, খোকা স্কুলের গেটের ভেতর থেকে তাকিয়ে থাকতো কান্না কান্না চোখে। খোকার যখন ৫ বছর বয়স, সালেহা চিরজীবন এর জন্য তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। এরপর থেকে খোকা তাকে ছাড়া ঘুমাতেও পারতো না।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেতরের দিকে আগালেন রহমান সাহেব। জীবনের বাকি সময়টার ঠিকানা আপাতত এটাই।

দুপুরবেলা অফিসে কাজ করছিলো ইফতেখার। এসময় রুমকির কল, দিয়ে আসছো বাবাকে?

- হুম, দিয়ে আসছি।

- থ্যাংকস এ লট, জীবনে প্রথম আমার কোনো কথা রাখলা।

- ইটস ওকে। ফাহিম স্কুল থেকে আসছে?

- হুম, মাত্র আসছে।

পাশ থেকে ফাহিম এর গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো। বাবা আমার জন্য পিজ্জা আনবা। আনমনে হাসলো ইফতেখার। ছেলেটা পিজ্জা খেতে ভীষণ ভালোবাসে।

রুমকির গলা শুনা গেলো এবার, বাবাকে ঠিক মতো বুঝিয়েছো? দেখা গেলো ছুঁতানাতা পেলেই তোমাকে বা ফাহিমকে দেখার নাম করে বাসায় চলে আসছে।

- রুমকি, বাদ দাওনা প্লিজ।

- নাহ, বাদ দিবো না। আগে মেক শিওর করো, উনি যাতে ইহজন্মে বাসার দিকে না আসে।

- ওকে।

বিকালে অফিস থেকে বের হয়ে বাবার ওল্ডহোমের দিকে গাড়ি ঘুরালো ইফতেখার। রুমকি অনেক জেদি মেয়ে। কথা না শুনলে বিপদ।

বাবার সামনে যেতে আজ ক্যানো জানি লজ্জা করছিলো অনেক। দূর থেকে দেখলো, বাবা তার বয়সী একজনের সাথে গল্প করছেন। গল্প করা, কথা বলার ধরনে মনে হলো, বহুদিনের পরিচিত। পুরোনো দিনের স্মৃতির ঝাপি খুলে বসেছেন দুইজন।

একটু পরে ভদ্রলোক চলে যাবার পর ইফতেখার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

- বাবা।

- খোকা আসছিস? ভালো হলো। বস এখানে। তোকে দেখতে ইচ্ছে করছিলো অনেক।

ইতস্ততভাবে কথাটা তুলেই ফেললো ইফতেখার। বাবা, রুমকি বলছিলো....

কথা শেষ করতে দিলেন না রহমান সাহেব। আমি বুঝেছি খোকা, বউমাকে টেনশন করতে মানা করিস। আমি যাবো না কখনোই।

- বাবা, প্লিজ আমাকে ভুল বুঝো না।

- বাদ দে। আমি কিছুই মনে করিনি। মাঝেমাঝে ফাহিমকে ফোনে ধরায়া দিস। দাদুভাইয়ের জন্য মনটা অস্থির হয়ে থাকে।

ফেরার সময় রহমান সাহেবের সাথে যেই ভদ্রলোক গল্প করছিলেন, তার সাথে গেটে দেখা। ইফতেখার এগিয়ে গেলো।

- কিছু মনে করবেন না। একটু আগে একজনের সাথে গল্প করছিলেন। উনি কি আপনার পরিচিত?

- কে, রহমান সাহেব?

- জ্বি।

- ওনাকে তো বহু বছর ধরেই চিনি। আমাদের ট্রাস্ট এর আন্ডারে এতিমখানাও আছে একটা। বহু বছর আগে আমাদের এতিমখানা থেকে উনি একটা ছেলেকে দত্তক নিয়েছিলেন। ফুটফুটে সুন্দর একটা ছেলে। জন্মের পর কারা জানি ওকে ডাস্টবিনের পাশে ফেলে গিয়েছিলো। রহমান সাহেবের সন্তান হচ্ছিলো না। তখন আমাদের কাছে এসেছিলেন। ছেলেটাকে নিজের সন্তান হিসেবেই আমাদের এতিমখানা থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন।

ইফতেখারের পায়ের নিচের মাটি কাপছিলো। সারাটা শরীর অবশ হয়ে আসছিলো। মাথার ভেতরটা ফাকা হয়ে গেছে।

- রহমান সাহেবের বিষয়ে জিজ্ঞেস করছো, তোমাকে তো বাবা চিনতে পারলাম না। তুমি কি ওনার পরিচিত?

কোনো উত্তর না দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো ইফতেখার। পুরোটা শরীরে অবশ একটা অনুভুতি ভর করেছে।
নাহ, এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয়ার সাহস বা শক্তি নাই ইফতেখারের। টলতে টলতে অবসন্ন ভাবে গাড়ির দিকে আগাতে থাকলো। হাতে ধরে থাকা মোবাইলে রুমকি কলের পর কল দিয়ে যাচ্ছে একটানা।


সামি, ১৯/০৬/২০১৬

 

(একটি বিদেশি ঘটনার গল্পাকারে ভাবানুবাদ)

 

বিডি-প্রতিদিন/ ২৩ জুলাই, ২০১৬/ আফরোজ

 

সর্বশেষ খবর