২৬ নভেম্বর, ২০১৬ ১২:৫৯

প্রাচীন বাংলার স্থাপত্যশৈলী

একরাম উদ্দীন সুমন

প্রাচীন বাংলার স্থাপত্যশৈলী

আজকের আধুনিক বাংলাদেশে প্রযুক্তির সংমিশ্রনে তৈরি হয়েছে বহুতল ভবন। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কাজে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের ভবন তৈরি হয়েছে এদেশে। নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা, বিদেশী অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা ও উন্নতবিশ্বের সাথে সমতা রাখার জন্যা আধুনিক স্থাপত্য শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু আজকের আধুনিক স্থাপত্য শিল্পের বিকাশের পিছনে রয়েছে আমাদের আদি পুরুষদের পরিশ্রম যা এই সভ্য সমাজেও প্রশংসার দাবি রাখে। 

বতর্মান স্থাপত্য নির্মাণে পাথর, বালু, ইট, রড, সিমেন্ট, থাই, পিলাস্টিক, শিশাসহ আধুনিক উপকরণ ব্যবহার হলেও প্রাচীন মানুষের বসতি নির্মাণে কি ধরনের উপকরণ ব্যবহৃত হতো তা অনেকের অজানা। আর আমাদের দেশের প্রকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য সেই উপকরণ কতটুকু কার্যকর ছিল সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশের জলবায়ু, অতিবৃষ্টি, বছর ঘুরতেই প্লাবনের আঘাত ও নদী ভাঙনের ফলে হারিয়ে গেছে আমাদের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন স্থাপত্য।

পাঁচ শতক বা তার আগের সময়ে কি ধরনের স্থাপত্য ছিল এই দেশে তার কোন বাস্তব স্বাক্ষ্য আমাদের কাছে নেই। কারণ হিসাবে বলা যায় ঐ সময়ে স্থাপত্য উপকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হতো এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমানে পাওয়া উপকরণ যার মধ্যে বাঁশ, ছন ও নলখাগড়া অন্যতম। যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে টিতে থাকতে পারিনি। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাদের ঘর-বাড়ি তৈরিতে এই সাধারণ উপকরণ ব্যবহার করলেও সীমিতভাবে ধর্মীয় স্থাপত্যে ইট, বালু, চুন ও রংসহ বিভিন্ন উন্নত উপকরণ ব্যবহৃত হতো। 

পর্যটক ফা-হিয়েন ও হিউয়েন সাঙ এই উন্নত ধর্মীয় স্থাপত্যের বর্ণনা দিয়েছেন। তাদের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, এগুলো খুব জাঁকালো ভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল। কোথাও এই স্থাপত্যের চূড়া মেঘছুঁয়ে যেত ও এর শীর্ষদেশকে স্বর্ণকলস দ্বারা শোভিত করা হতো। প্রাচীন বাংলাদেশে স্থাপত্য হিসাবে স্তূপ, বিহার, মন্দির ও রাজা-বাদশাহদের প্রাসাদ ও সংরক্ষিত দূর্গ প্রাচীর বেশি তৈরি হতো, যেগুলো এখনও নিদর্শন হিসাবে রয়েছে। 

প্রাচীন বাংলার ধর্মীয় স্থাপত্যের মধ্যে স্তূপ হলো সর্বপ্রাচীন। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মপালনকারি মানুষ স্তূপ তৈরি করেছিল। স্তূপ হলো ধর্মীয় গুরুর স্মৃতি, ব্যবহৃত মালামাল, স্মৃতিময় ঘটনা ও স্থানকে কেন্দ্র করে তৈরি ধর্মীয় স্থাপনা। এই দুই ধর্মে স্তূপ স্থাপত্য তৈরি করতে দেখা যায়। তিন ধরনের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে স্তূপ তৈরি করা হতো। প্রথমত গৌতম বৌদ্ধ ও তার শীষ্যদের দেহাবশেষ ওপর যে স্তূপ তৈরি করা হতো তাকে শরীর স্তূপ বলা হতো। দ্বিতীয়ত্ব গীেতম বৌদ্ধের ব্যবহৃত দ্রবাদি সংরক্ষণ করে যে স্তূপ তৈরি করা হতো তাকে পরিভোগিত স্তূপ বলা হয়। 

সর্বশেষ পর্য়ায়ে বৌদ্ধ ধর্মের কোন ঘটনা ও স্থানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য উদ্দেশিক বা নির্দেশিক স্তূপ তৈরি করা হতো। স্তূপগুলো গোলকার আকৃতির হতো এবং এর উপর গম্বুজ তৈরি করা হতো। ধর্মীয় কাজ সম্পন্ন করার জন্য চারপাশে প্রদক্ষিণ পথ ছিল এবং গম্বুজের উপর চতুস্কোণ দণ্ড ও দণ্ডের উপর একটি চাকা যুক্ত ছিলো। বাংলাদেশের নরসিংদী জেলার আশ্রাফপুরে, পাহাড়পুরে, ও মহাস্থানগড়ে স্তূপ তৈরি করা হয়েছিলো, যার বর্ণনা পাওয়া যায় হিউয়েন সাঙয়ের লেখনিতে। এগুলো স্থানীয়  জনগণ তৈরি করেছিলেন। যদিও ধারনা করা হয় এই স্তূপ ছাড়াও আরও অনেক স্তূপ সম্রাট অশোক নির্মাণ করেছিলেন।

বিহার হলো বৌদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানে ভিক্ষুরা বসবাস করতেন। আবাসিক ব্যবস্থা ছিল অধ্যায়নরত ছাত্রদের জন্য।  বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিহার হলো সোমপুর বা পাহাড়পুর বিহার। এটি ৯০০ বর্গফুট এলাকাব্যাপি ছিল যা চতুষ্কোনাকার। এখানে ১৮০টি কক্ষের চিহৃ রয়েছে। বিহার অঙ্গনের কেন্দ্রভূমিতে রয়েছে সুউচ্চ মন্দির। কেন্দ্রীয় মন্দিরের উচ্চতার সাথে মিলরেখে বিহারটির উচ্চতা তৈরি করা হয়েছিল। আবাসিক কক্ষ, কেন্দ্রীয় মন্দির ছাড়াও বিহারের মধ্যে রয়েছে ছোট ছোট স্তূপ, মন্দির, রান্নাঘর, কুয়া, খাবারঘরসহ প্রয়োজনীয় আবাসন। 

সাভারের হরিস চন্ড রাজার ঢিবি তে খননের ফলে এখানে বিহার স্থাপত্যের নির্দশন পাওয়া গেছে। অধ্যাপক এ কে এম শাহনেওয়াজ বলেন, রাজাসন বিহার নামে সাভারে একটি বিহার ছিল যেখানে অতীষ দিপঙ্কার ছেলেবেলায় লেখাপড়া করেছিলেন বলে জানা যায়। যদিও খননের ফলে আরও বেশি তথ্য পাওয়া সম্ভব। এছাড়াও কুমিল্লাতে শালবন বিহার, অনন্দ বিহার, ইটাখোলামুড়া বিহার, চাড়পত্রমুড়া বিহারের অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়। বাংলাদেশের একমাত্র চাড়পত্রমুড়া বিহারকে হিন্দু বিহার হিসাবে ধরা হয়।

প্রাচীন স্থাপত্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে মন্দির স্থাপত্য। গঠনশৈলী দেখে বাংলাদেশের মন্দির স্থাপত্যকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, চালা মন্দির, যার বৈশিষ্ট্য গ্রামবংলার একচালা ও দোচালা ঘরের মতো। দোচালা মন্দিরে পিছনে ইটের নতুন কক্ষ সংযুক্ত করে তৈরি করেছিল নতুন জোড় বাংলা মন্দির স্থাপত্য। দ্বিতীয়ত, রত্নমন্দিরে  বিভিন্ন কাঠামোগত কৌশলের মিশ্রণ রয়েছে। সর্বশেষ প্রাচীনতম মন্দিরগুলো শিখর মন্দির হিসাবে পরিচিত। বর্তমানে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষনায় দিনাজপুরে গুপ্ত যুগের বৈগ্রাম মন্দির আবিস্কৃত হয়েছে এছাড়াও মহাস্থানগড়, বৈরাগীর ভিটা ও গোবিন্দ ভিটাতে কয়েকটি মন্দির স্থাপত্যের নিদর্শন পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিক গবেষনায় ওয়ারী বটেশ্বরে একটি পদ্ম মন্দির আবিস্কৃত হয়েছে। যার কেন্দ্রীয় ভাগে একটি পদ্ম আকৃতির স্থাপত্য রয়েছে। তাই এই মন্দিরকে পদ্ম মন্দির বলা হয়।

প্রাচীন স্থাপত্যের মধ্যে বগুড়ার পরশুরামের প্রাসাদও রয়েছে, ভবনটির একদিকে ২০০ ফুট অন্যদিকে ১০০ ফুট প্রসস্থ দেয়াল ছিল। বর্তমান সময়ে প্রত্নতাত্তিক খননে দেওয়ালটি উন্মোচিত হয়েছে। এছাড়াও উয়ারী-বটেশ্বরে উল্টো পিড়ামিডের আকৃতির একটি স্থাপত্য পাওয়া গেছে যার সম্পর্কে এখনো বিস্তারিত কোন তথ্য জানা যায়নি। স্থাপত্য শৈলির একটি বিশেষ দিক ছিল মহাস্থানগড়ের নগর দেয়াল যা জমি থেকে ৪.৫৭ মিটার উঁচু ছিল। যা আজও বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বাহক হিসাবে পরিচিত। সাম্প্রতিক সময়ে এই স্থাপত্য শৈলির কাঠামো সার্কের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃিতি পেয়েছে। বিশ্বের কাছে পরিচিত পেল প্রাচীন বাংলার স্থাপত্যশৈলী। আর এভাবে প্রাচীন যুগে দক্ষতার সাথে স্থাপত্য তৈরি করে বাংলাকে স্বতন্ত্র ঐতিহ্যের আসনে বসিয়েছেন। 

লেখক: পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।


বিডি প্রতিদিন/২৬ নভেম্বর ২০১৬/হিমেল

সর্বশেষ খবর