২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ১৩:৪৪

বইমেলার ইতিবৃত্ত : গুরুত্ব ও প্রভাব

আবু ওয়াহেদ

বইমেলার ইতিবৃত্ত : গুরুত্ব ও প্রভাব

একটি জাতির মেধা ও মননের আঁতুড়ঘর হলো তার বইয়ের জগৎ বা লাইব্রেরি। একই সাথে দেশের সকল মেধার সংগ্রহশালাও হল এই লাইব্রেরি। সময়ের প্রয়োজনে এই সংগ্রহশালাকে মেলার মধ্য দিয়ে প্রদর্শন ও প্রচার করা হয়ে থাকে। এতে এই বিশাল জ্ঞানের ভান্ডার চলে আসে সকলের হাতের নাগালে। এর মাধ্যমে আবালবৃদ্ধবনিতা এই বিশাল জ্ঞান-সমুদের সাথে পরিচিত হওয়ার একটি বড় সুযোগ পায়। 

যে জাতির বই-পুস্তক সংখ্যা যত বেশি তার মেধাগত সমৃদ্ধিও তত বেশি। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি হলো- টহরঃবফ খরনৎধৎু ড়ভ ঈড়হমৎবংং. ওয়াশিংটন ডি.সি.-তে অবস্থিত এই লাইব্রেরিতে কী পরিমাণ বই আছে তা অনুমান করার জন্য তার একটি তথ্যই যথেষ্ঠ। তা হলো- এর একটি সেলফের দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৪০ মাইল, যাতে বই ধারণক্ষমতা প্রায় ৯০ মিলিয়ন বা ৯ কোটি। আর এ জন্যই বুঝি যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান বিশ্বের প্রধান পরাশক্তি। মুসলিম ইতিহাস দেখলেও বোঝা যায় যখন তারা পৃথিবী শাসন করেছিলো তখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরিটি ছিলো মুসলিমদের। জ্ঞানকেন্দ্র ছিল বাগদাদ, কর্ডোভা প্রভৃতি জায়গা। কালক্রমে এসব লাইব্রেরির বইগুলো খ্রিষ্টানরা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন এবং সভ্যতার চড়াই-উৎরাইতে বিলুপ্ত হয় মুসলমানদের জ্ঞান ভান্ডার আর তাদের বীরত্বপূর্ণ রাজত্বের অধ্যায়। তাই যতক্ষণ বই থাকে সে জাতিও ততক্ষণ টিকে থাকে।

বিশ্বের প্রথম বইমেলাটিও হয়েছিলো ১৮০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। আর বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলাটি হয় জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে। এছাড়াও মিশরের কায়রো, ইরানের তেহরান, রাশিয়ার মস্কো, ব্রিটেনের লন্ডন, ভারতের কোলকাতাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৃহৎ পরিসরে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশে বইমেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : 
বাংলাদেশে বইমেলার বীজ বপন করা হয় ১৯৬৫ সালে। এটি শুরু হয় খুব ছোট্ট পরিসরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে কোলকাতা থেকে মাত্র ৩২ টি বই এনে বাংলা একাডেমির দেয়াল ঘেঁষে পসরা সাজান সরদার জয়েনউদ্দিন। কলেবর বাড়তে বাড়তে ১৯৮৩ সালে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে “অমর একুশে গ্রন্থমেলা” হিসেবে স্বীকৃত হয়। এই বইমেলা পুরো ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী পালিত হতে থাকে শুধু বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। ২০১৪ সালে এর আরো বিস্তৃতি ঘটে এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত করা হয়। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই একুশে বইমেলায় নামে সাহিত্যপ্রেমী মানুষের ঢল।

বইমেলার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব: 
জতিগতভাবে আমরা আরাম ও প্রমোদপ্রিয়। জ্ঞানান্বেষনের উদ্দেশ্যে লাইব্রেরিতে গিয়ে বইপড়া ও বই সংগ্রহ করার ইচ্ছা ও সুযোগ অনেকেরই হয় না। মেলা উপলক্ষে প্রমোদ ও বইকেনা দু’টোই একসাথে হয়ে যায়। মেলায় যেসব দূর্লভ বই হাতের নাগালে পাওয়া যায় অন্য অনেক সময়েই তা খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। 
মানুষকে বইমুখী করে তোলার জন্য বইমেলার রয়েছে এক অনবদ্য অবদান। সকল বয়সের মানুষের জন্য এখানে থাকে উপযুক্ত বইয়ের পর্যাপ্ত কালেকশন। শিশুরা পরিচিত হতে পারে নতুন নতুন বইয়ের সাথে। বয়সীরাও খুঁজে পান তাদের মনের খোরাকসমৃদ্ধ বইটি। 

লেখক-লেখিকাগণ মেলায় অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের সাথে দেখা-সাক্ষাতে একজন পাঠক পান পাঠের নতুন প্রেরণা। লেখকের অটোগ্রাফসমেত বই কিনে পাঠক তার পাঠের ও বই কেনার চাহিদকে বহুগুণ বাড়িয়ে নিতে পারেন। এছাড়াও পাঠকের সারা বছরের পাঠাভ্যাসকে একটু ঝালিয়ে নিতে বইমেলার রয়েছে এক আশ্চর্য ভূমিকা। লেখক-পাঠকের এ মহা মিলন-মেলার উষ্ণতায় চঞ্চল হয়ে ওঠে নবপ্রেরণায় উদ্দীপ্ত একজন পাঠকের মন-প্রাণ।

জাতীয় মেধায় বইমেলার প্রভাব : 
কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে সারাবছর পাঠ্যপুস্তকের মধ্যেই বুঁদ হয়ে থাকতে হয়। ভালো রেজাল্ট করার বেপরোয়া গতিতে তারা পাঠ্যপুস্তকের গন্ডির বাইরে বিচরণ করার ফুসরত পায় না। ক্লাসের বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা আয়ত্ব করে কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানের জন্য বাইরের কোনো বইয়ে অনেকেই হাত দেয় না। অথচ একজন প্রকৃত শিক্ষিত ও জ্ঞানী মানুষ হওয়ার জন্য অনেক অনেক বেশি বই পড়া আবশ্যক। সাহিত্য বোঝার সক্ষমতা না থাকলে মানুষের জীবনে রসবোধ থাকে না। জীবন হয়ে ওঠে যান্ত্রিক। একজন কাঠমিস্ত্রী দিনের পর দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ফার্নিচার তৈরী করার পর তাতে রং-বার্নিশ করতে না পারলে যেমন তা সুন্দর হয় না এবং তার মনে কোনো সুখ থাকে না, তেমনি একজন শিক্ষার্থী সারা শিক্ষাজীবন অনেক পরিশ্রম করে ক্যারিয়ারের জন্য পড়াশোনা করে যদি সাহিত্য না বোঝে তাহলে তারও বাস্তব জীবন আনন্দময় হয় না। সুখের সন্ধানে ছুটলেও সে খুঁজে পায়না সেই আত্মার সুখের অচিন পাখিকে।

বইমেলায় সাহিত্যের সকল ভান্ডার একেবারে হাতের নাগালে পাওয়া যায়। এতে করে শিক্ষার্থীরা ক্লাসের পড়ার বাইরে অন্য বই সম্পর্কে চিন্তা করার সুযোগ পায়। তাদের চিন্তায় জ্ঞানের নতুন তৃষ্ণার জন্ম হয়। ক্রমে তারা মেতে উঠতে পারে জ্ঞান-সমুদ্রের সীমাহীন জ্ঞানাহরণে। ফলে একটি জ্ঞানী, সুশিক্ষিত ও মেধাসম্পন্ন জাতি তৈরী হওয়ার পথ সুগম হয়। তাই জাতীয় মেধা ও মনন গঠনের মাইলফলক এই বইমেলার সমৃদ্ধি ও অংশগ্রহণের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি কাম্য। 

লেখক তৈরি ও লেখার মানে প্রভাব : 
একজন লেখক হলেন মেধার পরিবেশক। পাঠকই ক্রমান্বয়ে লেখক হয়ে ওঠেন। পাঠের মাধ্যমে লেখার আভ্যন্তরীন প্রয়োজনীয় বিষয়ের অভাবকে তিনি আবিষ্কার করেন। ফলে তিনিও তার নিজ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা শুরু করেন। আর এভাবেই জন্ম নেয় নতুন লেখক। বইমেলায় তাই নতুন লেখক ও নতুন চিন্তার দ্বার উন্মুক্ত হওয়ার অবারিত সুযোগ থাকে। এছড়াও লেখকগণ একে অন্যের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পান। একেজন আরেকজনের সাথে ভাবের আদান প্রদান করতে পারেন। ফলে খুঁজে পান নিজের লেখার দুর্বল জায়গাগুলো। দৃষ্টি পড়ে লেখার মানের উন্নয়নের দিকে। আর তাই এই মেলা ও মেশার কারণে সাহিত্যভান্ডারের মানও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।

বিশ্বায়নের এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মানুষের পাঠাভ্যাস বৃদ্ধিতে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র ইতিবাচক প্রভাব ও অবদান অনেক বেশি। বইমেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে মেধার উন্নয়ন ও বিকাশের চর্চা করে একটি মেধাবী জাতি গঠনের এই প্রক্রিয়াকে আরোও উন্নত ও ডিজিটাল করার মধ্য দিয়ে একটি সভ্য, সুশীল ও ন্যায়রায়ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা হোক এটাই আমাদের একান্ত কামনা।

লেখক: প্রাক্তন শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।


বিডি প্রতিদিন/২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/হিমেল

সর্বশেষ খবর