শিরোনাম
২৪ জুন, ২০১৭ ১১:২০

বানান রীতির পরিবর্তন ও একটি বিতর্ক

মাসুদ হাসান

বানান রীতির পরিবর্তন ও একটি বিতর্ক

বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত স্বরধনির সংখ্যা সাতটি এবং ব্যঞ্জনধ্বনির সংখ্যা ত্রিশটি, মোট সাইত্রিশটি। কিন্তু বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত স্বরবর্ণ এগারোটি এবং ব্যঞ্জন বর্ণ উনচল্লিশটি, মোট পঞ্চাশটি। বাংলা ভাষার ধ্বনির সাথে বর্ণের এই পার্থক্য ঐতিহাসিকভাবেই বিরাজ করছে। যেকোন মৌখিক ভাষাকে লেখ্যরুপ দেওয়ার জন্যই কেবল বর্ণমালার প্রয়োজন হয়। এজন্য সবচেয়ে সরল নিয়মটি হচ্ছে ভাষায় ব্যবহৃত মৌলিক ধ্বনিগুলোর প্রতিবর্ণ তৈরি করা। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে বাংলা ভাষায় যে বর্ণমালা ব্যবহার করা হয় তা এই নিয়মে প্রবর্তিত হয়নি। মূলত সংস্কৃত ভাষার জন্য ব্যবহৃত বর্ণগুলোকেই অল্প বিস্তর পরিবর্তন করে বাংলা ভাষায় ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সংস্কৃত ভাষায় ব্যবহৃত ধ্বনির সঙ্গে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত ধ্বনির বিস্তর পার্থক্য বিদ্যমান। ফলে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত ধ্বনির সঙ্গে বাংলা বর্ণমালারও পার্থক্য তৈরি হয়ে আছে। বাংলা বর্নমালায় ব্যবহৃত অনেক বর্ণই বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের অংশ নয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন যায়গা থেকে এই পার্থক্য নিরসনের চেষ্টা বিভিন্নভাবে করা হয়েছে। ফলে ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় বাংলা ভাষার লেখ্যরুপেরও বদল ঘটেছে বিস্তর।

প্রথম বাঙ্গালি হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ের রচিত গৌড়িয় ব্যকারণে মোট ১৬টি স্বরবর্ণ ও ৩৪টি ব্যঞ্জনবর্ণ অর্থাৎ মোট পঞ্চাশটি বর্ণ ছিল। তার বর্ণমালার তালিকায় ড় ঢ় ও য় বর্ণগুলো ছিল না। তিনি ক্ষ কে একটি স্বতন্ত্র বর্ণ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। রাজা রামমোহন রায়ের প্রবর্তিত বর্ণের সাথে পঞ্চানন কর্মকার কর্তৃক প্রথম খোদায়কৃত বর্ণের পার্থক্য বিদ্যমান। পরবর্তিতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বর্ণমালা সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং ১৮৫৫ সালে বর্ণপরিচয় নামক বইটি প্রকাশ করেন। ওই বইতে তিনি যে বর্নমালার তালিকা প্রণয়ন করেন সেখানে ১২টি স্বরবর্ণ ও ৪০টি ব্যঞ্জনবর্ণ ছিল। 

তিনি বর্নমালায় ড় ঢ় এবং য় বর্ণগুলো ব্যঞ্জনবর্ণ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। উল্লেখ্য বাংলা ভাষায় এই বর্ণগুলো শব্দের আদিতে উচ্চারিত হয় না। শব্দের মধ্যে কিংবা অন্তে এরা উচ্চারিত হয় ড ঢ এবং য এর রুপ হিসেবে। ফলে এগুলোকে স্বতন্ত্র বর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হত না। বিদ্যাসাগরই প্রথম এই বর্ণগুলোকে বর্ণ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর তার 'সহজ পাঠ' বইতে যে বর্ণ তালিকা প্রকাশ করেছিলেন সেখানে আবার তিনি এগুলো বাদ দিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর দীর্ঘ-ঋ এবং দীর্ঘ-৯ বর্ণ তালিকা থেকে একেবারে বাদ দেন এবং অদ্যবধি এই দুটি বর্ণ বর্জিত হয়ে আসছে যা এক সময় ব্যবহৃত হত। বিদ্যাসাগর ক্ষ-কেও বর্ণ তালিকা থেকে বাদ দেন। তিনি এটিকে যুক্ত বর্ণের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন এবং আমরা আজ অবধি সেভাবেই ব্যবহার করে আসছি। বিদ্যাসাগর প্রবর্তিত বর্ণমালার মধ্য থেকে পরবর্তিতে আরো দুটি বর্ণ বাদ পড়ে। একটি ৯ এবং অপরটি অন্তাস্থ-ব। ফলে স্বরবর্ণ সংখ্যা দাড়ায় ১১টিতে এবং ব্যঞ্জন বর্ণ হয় ৩৯টি, মোট পঞ্চাশটি। বর্তমানে এই পঞ্চাশটি বর্ণই বাংলা ভাষায় ব্যবহার করা হয়।

বর্তমানে বাংলা ভাষায় যে পঞ্চাশটি বর্ণ ব্যবহার করা হয় তার অনেকগুলোই বাংলা ভাষায় উচ্চারিত হয় না। সংস্কৃত ভাষাতে এদের ধ্বনিরুপ থাকলেও বাংলা ভাষাতে এদের ধ্বনিরুপ নেই। বৈদিক ভাষা থেকে রামায়ণ-মহাভারতের ভাষা হিসেবে লেখ্যরুপে খৃষ্টপূর্ব ষষ্ট থেকে তৃতীয় শতকে সংস্কৃত ভাষার উদ্ভব ঘটে। এটি মানুষের মুখের ভাষা না হওয়ার কারণে পরবর্তিতে আর বিবর্তিত হয়নি । বৈদিক ভাষার মৌখিক রুপের বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় প্রকৃত ভাষার উদ্ভব ঘটে। এই প্রকৃত ভাষার একটি উপভাষা গৌড়িয় প্রকৃতি থেকে গৌড়িয় অপভ্রংশ এবং এই গৌড়িয় অপভ্রংশ থেকে সংস্কৃত ভাষার জন্মেরও বারোশো থেকে ষোলোশো বছর পর বাংলা ভাষার আদিরুপের জন্ম হয়। ফলে এই দীর্ঘ সময়ে সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় ধ্বনিরুপে পার্থক্য তৈরি হবে তা খুবই স্বাভাবিক। 

কিন্তু সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার জন্য যখন বর্ণমালা গ্রহণ করা হয় তখন এই পার্থক্যকে বিবেচনা করা হয়নি। এর প্রধান কারণ মধ্যযুগে যেসকল পন্ডিতেরা বাংলা লিখেছেন তারা ভাষায় আভিজাত্য আনতে গিয়ে প্রচুর সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করেছেন। বড়ু চন্ডিদাস রচিত মধ্যযুগের প্রথম বই 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের' ৪৫ ভাগ শব্দই সংস্কৃত শব্দ। শাহ মুহাম্মদ সগীর রচিত 'ইউসুফ জুলেখার' ৭৫ ভাগ শব্দই সংস্কৃত শব্দ। লেখায় এই আভিজাত্য সৃষ্টি করতে গিয়ে তারা মৌখিক বাংলার সাথে লৈখিক বাংলার বিস্তর পার্থক্য তৈরি করেছেন। এখনও পর্যন্ত বাংলা ভাষায় সেই পার্থক্য রয়ে গিয়েছে। এই পার্থক্য নিরসণে প্রমথ চৌধুরি এগিয়ে আসেন এবং চলিত বাংলায় সাহিত্য রচনার দাবি উঠান। বর্তমানে চলিত বাংলায় সাহিত্য রচিত হলেও সাধু বাংলার ছাপ থেকেই গেছে।

সংস্কৃত ভাষা থেকে যে সকল ঋণ শব্দ বাংলা ভাষায় এসেছে তার অধিকাংশের উচ্চারণই বাংলা ভাষায় রক্ষিত হয়নি। বাংলা ভাষাভাষি জনগোষ্ঠি তাদের নিজস্ব ধ্বনিত্বত্তের আলোকে সেই সকল শব্দের উচ্চারণ বদলে ফেলেছে। এই সকল সংস্কৃত শব্দের উচ্চারণ বদলালেও উচ্চারণ অনুযায়ী তাদের বানান বদল করা হয়নি। 'ভবন' ও 'গগণ' শব্দদ্বয়ে ন-য়ের উচ্চারণে সংস্কৃতিতে পার্থক্য থাকলেও বাংলা উচ্চারণে কোন পার্থক্য নেয়। অনুরুপভাবে 'ষোল' ও 'শত' শব্দদ্বয়ে শ-য়ের উচ্চারণে এবং 'রং' ও 'সঙ' শব্দদ্বয়ে ' ং'- এর উচ্চারণে পার্থক্য বাংলা ভাষায় রক্ষিত হয়নি। বাংলা ভাষায় দীর্ঘ স্বরের কোন অস্তিত্ব নেই যেটি সংস্কৃত ভাষায় ছিল। তাই 'ঈশ্বর' ও 'ইন্দ্রিয়' শব্দদ্বয়ের উচ্চারণে বাংলায় দুইটি ই-এর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই যেটি সংস্কৃত ভাষায় ছিল। সংস্কৃত এই সকল শব্দগুলো বাংলা উচ্চারণ গ্রহণ করলেও লেখ্যরুপে এদের বানান অক্ষত রাখা হয়েছে। ফলে এই শব্দগুলোর বানান আলাদাভাবে শেখার প্রয়োজন হয় ( যেমনঃ ণ-ত্ব বিধান, ষ-ত্ব বিধান ইত্যাদি)। 

অনুরুপভাবে আরবি শব্দ 'ঈদ' কিংবা 'ইট'-এ আলাদা ই ব্যবহার করা হলেও তাদের উচ্চারণে কোন পার্থক্য নেই। এই অসংগতি দূর করার জন্য বাংলা বর্ণমালা সংস্কারের চেষ্টা বিভিন্ন সময়ে করা হয়েছে। ১৯৬৮ সালে বাংলা একাডেমি ড মুহাম্মদ শহিদুল্লাহের সভাপতিত্বে বানান সংস্কার কমিটি গঠণ করে। কমিটি অন্যান্য সুপারিশের সাথে বাংলা বর্ণমালা থেকে দীর্ঘস্বর (ঈ ও ঊ) বাদ দেওয়ারও সুপারিশ করেছিল। কিন্তু পরবর্তি বছরেই ড মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ মারা গেলে এবং বিদ্যমান রাজনৈতিক গোলযোগে এই সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি।

বর্নমালা সংস্কারে প্রধান প্রতিবন্ধকতা দুটিঃ 
১। আমাদের চোখ সংস্কার দেখে অভ্যস্ত নয়। ফলে তার দর্শনে দৃষ্টি কটুতার অনুভুতি যাগে। 
২। সংস্কারটিকে সার্বজনিন করা। বিভিন্ন গণমাধ্যম, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও পাঠ্যবই প্রনেতাদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা একটি দুরহ কাজ।
উপরোক্ত দুটি প্রধান সমস্যার কারণে বিভিন্ন সময়ে উত্থাপিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো প্রয়োজনীয় হলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তাই আজ বাংলা একাডেমি আরবি 'ঈদ' বানানে ঈ-এর পরিবর্তে 'ই' ব্যবহারের সুপারিশ করলে বিতর্কের জন্ম হচ্ছে। আরবি ভাষায় দীর্ঘস্বরের উচ্চারণ থাকলেও বাংলা ভাষায় তার অস্তিত্ব নেই। বাংলা ভাষায় শুধু হ্রস-ই এরই উচ্চারণ আছে। 

মৌখিক উচ্চারণে যদি অর্থ পার্থক্য তৈরি না করে তাহলে লেখ্যরুপে অর্থপার্থক্য তৈরি করবে কেন? তাছাড়া যেসকল বিদেশি শব্দ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয় সেগুলো বাংলার নিজস্ব উচ্চারণেই ব্যবহৃত হয়। এবং সেই অনুযায়ীই বানান প্রণিতও হয়। যেমন আরবি ভাষা থেকে আসা 'বিদায়' শব্দটির আরবি উচ্চারণ 'বিদায়াহ'। কিন্তু বাঙালীর মুখে এটি 'বিদায়' হিসেবেই উচ্চারিত হয় এবং বানানও সেই অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়েছে। তাহলে কেন 'ঈদ' শব্দটি 'ইদ' লেখায় আপত্তি থাকবে। বাঙালীর মুখেতো এই দুই বানানে উচ্চারণের পরিবর্তন ঘটছে না। আমরাতো সবাই হ্রস-ই উচ্চারণ করি, দীর্ঘ-ই তো উচ্চারণ করি না। তাহলে হ্রস-ই লেখতে অসুবিধা কোথায়। অনেকেই আবার এর সাথে ধর্মীয় আবেগ জড়িয়ে ফেলছেন যেটি অবান্তর। ভাষা ধর্মীয় অনুসঙ্গ নয়, এটি ভাব প্রকাশের মাধ্যম মাত্র। ইদ আমরা যেভাবেই লিখি না কেন তা বাঙ্গালীর মনে একই অর্থের উদ্রেক করে।

লেখক: মুক্ত গবেষক

বিডি প্রতিদিন/২৪ জুন ২০১৭/হিমেল

সর্বশেষ খবর