৬ আগস্ট, ২০১৭ ১৮:৩৭

বন্ধুত্বের এই যুগ সেই যুগ

মর্তুজা নুর

বন্ধুত্বের এই যুগ সেই যুগ

আজ বন্ধু দিবস। বিশ্বের অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশেও উদযাপন করা হচ্ছে দিনটি। দিন যতই যাচ্ছে বন্ধুর প্রকৃত সংজ্ঞা যেন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। বন্ধু শব্দের আভিধানিক অর্থ সঙ্গী, সাথী সুখ-দুঃখের ভাগিদার। বন্ধু বা বন্ধুত্ব বহু রকম হয়ে থাকে। তবে যুগ বদলানোর সাথে সাথে বদলে যাচ্ছে বন্ধু সংস্কৃতি। আগে বন্ধুত্বের বন্ধন ছিল সীমাহীন। এটি উপলব্ধি করতে পারে তারা, যারা প্রাথমিক বিদ্যালয় বা সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণির গণ্ডি পেরিয়েছিল। ক্লাস চলাকালে এক বন্ধু প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে শিক্ষকের ছুটি চাওয়ার আগে পাশের বন্ধুকে বলত, ‘আয় বাইরে যাই’। বিদ্যালয়ে পরীক্ষার সময় যখন কোনো প্রশ্নের উত্তর লেখতে না পারতো তখন এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে বলত, ‘বন্ধু কোনো প্রশ্নই আসেনি যেগুলো পারতাম, এখন সব দেখা’ অথবা এক বন্ধু তাড়াতাড়ি উত্তর লিখে পাশের বন্ধুকেও লিখে দিত।’ 

যেকোনো কারণে এক বন্ধু বিদ্যালয়ে না এলে আরেক বন্ধু সোজা বাড়ি চলে যেত বন্ধুর খোঁজ নিতে। সব চেয়ে বেদনাদায়ক বিষয় হলো। আগে বন্ধু কোথাও বেড়াতে গেলে পাশের বন্ধু নতুন শার্ট বা প্যান্ট অথবা জুতাটা ধার নিত দু'এক দিনের জন্য। এখন সেই সংস্কৃতি এ প্রজন্মের জন্য শুধুই স্বপ্ন। আধুনিক বন্ধুদের কাছে সেই সংস্কৃতি নিছকই ছোট লোকি। আগের বন্ধু কোনো কারণে কয়েক দিন বা মাসের জন্য কোথাও গেলে অথবা কর্মের তাগিদে কোথাও গেলে পাশের বন্ধুরা বিদায় দিতে কান্নায় ভেঙে পড়ত। আগে আগে নিজেদের ডাক ঠিকানাটা লিখে দিত যেন কর্মস্থলে গিয়ে তোলা ছবি এবং চিঠি পাঠাতে পারে--এসব এখন নিতান্তই স্বপ্ন।

আধুনিক যুগের বন্ধুত্ব মানে পশ্চিমাসংস্কৃতির। এ যুগে বন্ধুত্ব মানে পার্ক কিংবা আধুনিক হোটেল রেস্তোরাঁয় সময় কাটানো। নারী-পুরুষ খোলামনে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আড্ডা। কিংবা রাতের আঁধারে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে তখন গোপনে গল্প করার শিরোনামই বন্ধুত্ব।

আধুনিক যুগ প্রযুক্তির স্বর্ণযুগ বলা হয়। এ যুগে উন্নয়নের শতভাগ শুধু প্রযুক্তিতে। স্বল্পমূল্যে একটা মোবাইল কিনলে নিজের হাতে পৃথিবী রাখার মতো ব্যবস্থা হয়ে যায় বটে, শুধু সিম কোম্পানির কাছ থেকে স্বল্প টাকায় ইন্টারনেটের এমবি কিনতে হয়। সাথে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থাকলেই হয়। নতুন নতুন প্রযুক্তিগত দুনিয়া যেমন ইমু, ওয়াটসআপ, ভাইবারসহ আরো অনেক প্রযুক্তিসৃষ্ট দুনিয়া আছে। যে পৃথিবী শুধু বন্ধুদের জন্য। এখানে মা বলেন; বাবা বলেন; ভাই বলেন; বোন-দুলা ভাই আর শিক্ষক শিক্ষার্থী বলেন; সবাই বন্ধু। বন্ধু ছাড়া কোনো সম্বোধন নেই। বন্ধুদের মাঝেও নেই ছোট-বড়। প্রযুক্তির এ সুবিধা ভোগে মরিয়া আধুনিক প্রজন্মও।

প্রযুক্তির এই রম্য দুনিয়ায় বন্ধুত্বের চাহিদা মিটছে যেন শতভাগ। তবে প্রযুক্তিভিত্তিক বন্ধুর বন্ধন আর বাস্তবতার বন্ধনের সাথে মিল শুধু স্বপ্ন দেখার মতো। শৈশবের বন্ধুত্ব ছিল এক কাপ চা দুই ভাগ করে খাওয়া। অর্থস্বল্পতার কারণে একটা পুরি কিংবা পেঁয়াজু কিনে দু'ভাগ করে খাওয়া। আর আধুনিক প্রযুক্তিগত বন্ধুত্ব হলো একটা মেয়ে বন্ধুর সাথে দু'চারজন ছেলে বন্ধু আলাপ (Chating) করা। সেকালে বন্ধুত্ব ছিল হাতে চিঠি লেখা ‘বন্ধু তোকে ভালোবাসি’। একালের বন্ধুত্ব হলো প্রযুক্তির আরেক যন্ত্র চিত্রকলার (গ্রাফিক্স) সাহায্যে ছবি তৈরি করে অথবা অন্য কারো লেখা বা ছবি নকল করে মেসেঞ্জার কিংবা খুদে বার্তাভিত্তিক আদান প্রদান করা।

এখনকার যুগে মেয়ে বন্ধু সচরাচর মিলে। একটা বন্ধুর অনুরোধ (Request) পাঠানো আর নিশ্চিত (Confirm) করতে যে সময়। তার পরের গল্পটা জানেন যাদের ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট রয়েছে। প্রযুক্তিভিত্তিক এই বন্ধুত্বের বন্ধন টিকে যতক্ষণ ইন্টারনেট থাকে।

বন্ধুত্ব হচ্ছে দুই দেহের এক আত্মা। কিন্তু আজকাল মেয়ে বা ছেলেদের বহু বন্ধু থাকে যারা রঙিন মুহূর্ত কাটানো আর অপসংস্কৃতিমূলক কাজে সময় ব্যয় করে থাকে বন্ধুর ব্যানার ব্যবহার করে। প্রযুক্তির এ সুবিধা প্রজন্মের মেধাকে বিকশিত না করে নিতান্ত কলুষিতই করছে দিন দিন। যৌনতা আর ধ্বংসযজ্ঞতা ছাড়া আধুনিক বন্ধু-বান্ধব কিছুই দিতে পারছে কি? খোলামেলা সময় কাটানোর নাম কখনোই বন্ধুত্ব হতে পারে না। মা-বাবার অবাধ্য হয়ে পার্ক কিংবা সিনেমায় বা দোকানপাটে ঘোরাফেরার নাম বন্ধু সংস্কৃতি না বরং বন্ধু শব্দ ও বিশেষণকে কলুষিত করা। 

শুধু সুখ সময়ের সুজন নয়- কষ্ট, দুঃখ, যন্ত্রণা, অপরাধ, দুষ্টুমি এবং সকল গোপনীয় অনুভূতির নিরাপদ আশ্রয় বন্ধুত্ব। একজন বন্ধুর সামনে দাঁড়ালে প্রায়োজন পড়ে না আয়নার-সমালোচনা, রাগ, অনুনয়, বকাঝকা কিংবা অধিকার খাটিয়েই প্রকাশ করে জীবনপথের সঠিক প্রতিচ্ছবি।

কিন্তু ইন্টারনেটের এই সহজলভ্যতার যুগে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের দৌরাত্ম্যে এমন বন্ধুত্ব কি সম্ভব? ফেসবুকে একটি ফ্রি অ্যাকাউন্টের বিনিময়ে পাওয়া যায় ৫ হাজার বন্ধু। আসলেই কি তাদের বন্ধু বলা যায়? ছবি কিংবা স্ট্যাটাসে লাইক অথবা কমেন্টে ভাসিয়ে দিলেই তার নাম বন্ধুত্ব? সময় অসময়ে পিং পং চ্যাটিং কিংবা ইমো দিয়েই হয়ে যায় বন্ধুর সঙ্গে ভাব বিনিময়? অপরিচিত কিংবা স্বল্পপরিচিত তথাকথিত বন্ধুর কাছেই মেলে ধরা যায় নিজের একান্ত জগত? আজকাল পত্রিকা খুললে, অনলাইন নিউজ পোর্টালে ঢুকলে কিংবা টেলিভিশনে প্রায়ই পাওয়া যায় লুণ্ঠন কিংবা ধর্ষণের সংবাদ।

‘ফেসবুকে বন্ধুত্ব তারপর ধর্ষণ' শিরোনামটা এমনই থাকে সেসব খবরে আর নিউজফিড হিসেবে চলে আসে ফেসবুকেরই ওয়ালে। যুগের হাওয়া বদলে মানুষ না চিনে বন্ধুত্ব করা কি যথেষ্ট দোষের নয়? প্রতারণার অভিনব কৌশলে ‘ভার্চুয়াল’ বন্ধুর পাতা জালে আটকে যাচ্ছেন অনেকেই। চ্যাট হিস্ট্রি, খোলামেলা ছবি, উদ্দেশ্য প্রণোদিত বন্ধুত্ব কিংবা ব্ল্যাকমেইলিং- প্রতিনিয়ত শিকার হচ্ছেন অনেকেই। তবে কি বাস্তব জীবনে বন্ধুত্বের অভাব পূরণ করতেই ফেসবুক বেছে নিচ্ছেন সকলে?

সত্যিকারের বন্ধুর অভাব পূরণ করা সম্ভব নয়। ব্যস্ততার কারণে বর্তমানে বন্ধুদের সঙ্গে কম যোগযোগ স্বাভাবিক বিষয়- হয়তো তাই ভিন্ন পথ খুঁজতেই অনলাইন বন্ধুদের সঙ্গেই চলছে কথোপকথন। কিন্তু এই আলাপচারিতাই যদি হয় বিপদের পড়ার রাস্তা। কারণ উত্তম বন্ধুত্ব আকস্মিকভাবে গড়ে ওঠে না- কঠোর পরিশ্রম, একাগ্রতা, সততা ও আত্মত্যাগের ফল। একজন ভালো বন্ধু বাস করে মনের মধ্যে, চেতনার গহীনে। আর তাই বন্ধু প্রতিনিয়তই প্রভাব বিস্তার করে যাপিত জীবনে। বন্ধু নির্বাচনে ভুল হলে চরম মূল্য দিতে হতে পারে- আর তাই ফেসবুক কিংবা অনলাইন বন্ধু হতে সাবধান।

লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

বিডি-প্রতিদিন/০৬ আগস্ট, ২০১৭/মাহবুব
 

সর্বশেষ খবর