১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ১৮:০৪

'জবাইয়ের আগে গরুটারে একটু আস্তে ফালায়েন স্যার...'

শাকীর এহসানুল্লাহ

'জবাইয়ের আগে গরুটারে একটু আস্তে ফালায়েন স্যার...'

দামাদামি শেষে গরুর মালিক ১ লাখ ৬০ হাজার টাকায় গরু দিতে রাজি হলেন। রতন সাহেব এবার খুব খুশি। ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিয়ে গরু কিনেছেন। এলাকার সবচেয়ে বড় কোরবানিটা উনিই দিচ্ছেন। মনে মনে প্র্যাক্টিস করছেন বারবার, লোকে দাম জিজ্ঞেস করলে কোন স্টাইলে বলবে। হাসিটা কেমন করে দিলে গরুর দামের সাথে মিলবে। এসব ভাবতে ভাবতে গরু নিয়ে বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।

বাড়িতে ফোন করে বউকে বলে দিলেন, - ‌'হ্যালো শুনছো? গরু কেনা শেষ। সবাইকে বলে দিও, এবারে এলাকার সবচেয়ে বড় কোরবানিটা আমিই দিচ্ছি।' বউ আশপাশের বাসায় 'ভাবি-ভাবি' করে সেকি হুলুস্থুল কারবার। পরিবারের ছেলে মেয়েরা খবর পেয়ে বাড়ির গেইটে ভীড় করেছে। কখন গরু নিয়ে আসবে।

এদিকে গরুর হাটে ঘুরতে ঘুরতে রতন সাহেবের দামি জুতাটা নষ্ট হয়ে গেলো। কাদা-মাদা মেখে ভিজে-টিজে জুতার অবস্থা কাহিল। একপাশ ছিড়েও গেছে। রাত পোহালেই ঈদ। এলাকার সবচে বড় কোরবানিদাতার জুতার এই অবস্থা! বিষয়টা রতন সাহেব ভাবতেই পারছেন না। শেষ পর্যন্ত নতুন আরেকটা জুতাই কিনে নিলেন। এখন বেশ স্বস্তিতে হাঁটছেন তিনি। ইচ্ছে করেই গরুর সাথে পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন। আলাদা গেলে লোকে যদি আবার অন্য কাউকে মালিক ভেবে বসে! রাস্তায় কেউ দাম জিজ্ঞেস করলেও বলছেন। আবার না জিজ্ঞেস করলেও বলছেন। না বলে শান্তিই পাচ্ছেন না। এতগুলো টাকা খরচ করে কোরবানি দেয়া হচ্ছে, লোকে যদি না-ই জানলো। তবে আর লাভ কী!

গরু নিয়ে বাড়িতে আসতে আসতে প্রায় রাত হয়ে গেলো। ফলে আশপাশের তেমন কেউ গরু দেখতে এলো না। ফোন করে পরিচিত সবাইকে বলে রেখেছেন। সবাই সকালে আসবে গরু দেখতে। মোটামোটি সবাইকে দেখানোর পরেই গরুটা জবাই করবেন তিনি। ভাবছেন এবারের গরুটা বাড়ির সামনে জবাই না দিয়ে স্কুলের মাঠে সবার সাথে দিবেন। এতে গরুর দাম জানতে চাইবে অনেকে। চোখেও পড়বে ব্যপারটা। 

রতন সাহেবের অস্থির অস্থির লাগছে। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছেন। কখন সকাল হবে, প্রতিবেশীরা ভীড় করবে রতন সাহেবের গরু দেখার জন্য। সবাই গুনগুন করে বলবে, রতন সাহেবের গরুটাই এই এলাকার সবচেয়ে দামি। রতন সাহেব এসব কথা শুনেও না শুনার ভান করবেন। উল্টো সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলবেন, ‌'এবারে গরুর দাম তো বেশ কম যাচ্ছে...!' এসব ভাবতে ভাবতে রাত দুটা বেজে গেলো। রতন সাহেবের ঘুম আসলো না।

হঠাৎ শুনলেন, দরজায় ঠক ঠক শব্দ। অবাক হলেন না রতন সাহেব। গরুর দাম শুনে এই মধ্যরাতে কেউ আসতেই পারে। দরজাটা খুললেই তো বলবে, 'আহা রতন সাহেব, কি একখান গরু কিনলেন ভাই, কাঁপায়া দিলেন তো' মুচকি হাসতে হাসতে দরজা খুললেন রতন সাহেব। খুলেই অবাক হয়ে গেলেন। কারণ উনার প্রতিবেশী কেউ আসেনি। বরং অপরিচিত একটা গ্রাম্য মানুষ এসেছে। চোখে-মুখে ঘাম। একটু পর পর চোখ মুছছে লোকটা। গায়ে ময়লা কাপড়। হাঁটু পর্যন্ত কাদা লেগে আছে। পায়ে জুতা নেই। তবে হাতে এক জোড়া স্যান্ডেল, ভাঁজ করে ধরে রেখেছে। সাথে ১১/১২ বছরে ছোট একটা ছেলে। 

রতন সাহেব খুব বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
- কে আপনি?
- স্যার আমি আফনের গ্যারেজে রাখা গরুটার মালিক!
- মালিক মানে! আমি গত সন্ধ্যায় এত দাম দিয়ে কিনে নিয়ে এলাম, আর আপনি বলছেন 'গরুর মালিক!'
- না স্যার, আসলে আমি আগে এই গরুটার মালিক আছিলাম, মানে গত সন্ধ্যায় আমিই গরুটা আফনের কাছে বিক্রি করছি।
- ও আচ্ছা, তো এত রাতে কেনো আসছো? ভুল করে টাকা কম দিয়েছিলাম? নাকি জাল নোট পড়েছে?

গ্রাম্যলোকটা উত্তর না দিয়ে চুপ করে আছে। চোখ থেকে পানি পড়ছে অনবরত। রতন সাহেব কিছু বুঝতে পারছেন না। বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 
- আরে কী হয়েছে বলবা তো! কাপড়-চোপড় লাগবে? নাকি আরও টাকা চাও?
- না স্যার, আসলে গরুটারে একটু দেখতে আসছিলাম। আমার পোলাডায় সারা রাইত কিছু খায় নাই। বারবার গরুটারে দেখতে চাইতেছে। তাই এই রাইতে ৯ মাইল হাঁইট্যা আসছি স্যার। হাঁটতে হাঁটতে স্যান্ডেলটা ছিইড়া গেলো। যদি কিছু মনে না করেন, আমারে একটু সুযোগ দিলে গরুটারে একটু দেইখ্যা যাইতাম।

রতন সাহেব নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন। গ্যারেজ খুলে দিলেন। গ্রাম্য লোকটা ভেতরে ঢুকেই গরুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। ছোট ছেলেটাও কাঁদছে আর লোকটাকে জড়িয়ে ধরে বলছে, ‌'বাজান, ওই স্যাররে ট্যাকা ফেরত দিয়া দেও, আমি গরু নিয়া যামু! বাজান! ও বাজান! আমি গরু নিয়া যামু'

গ্রাম্যলোকটা তার ছেলেকে কোনো উত্তর দিতে পারছে না। শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। রতন সাহেব দূর থেকে চুপচাপ দেখে যাচ্ছেন সব। বেশ কিছুক্ষণ পরে দুজন বেরিয়ে এলো। চোখ মুছতে মুছতে বললো,
- স্যার, আফনেরে হুদাই কষ্ট দিলাম, মনে কিছু নিয়েন না।
- না না ঠিক আছে। তুমি কি রাতে খেয়েছো?
- জী স্যার, আল্লাহয় খাওয়াইছে।
- ও কি তোমার ছেলে?
- জী স্যার, আল্লাহর দোয়ায় একটা পোলাই। এইডারে পড়ালেখা করানোর জন্যই আদরের গরুটা বেইচ্যা দিলাম। গেলাম স্যার... দোয়া রাইখেন....
- একটু দাঁড়াও,

রতন সাহেব ঘর থেকে এক হাজার টাকার একটা নোট আনলেন। জোর করে ছোট ছেলেটার হাতে গুজে দিলেন নোটটা। বললেন, ঈদের দিন এসে বাসায় খেয়ে যেয়ো। বিদায় দিয়ে রতন সাহেব ভেতরে ঢুকতে গেলেন। লোকটা আবার চিৎকার করতে করতে দৌঁড়ে এলো,
- স্যার স্যার, আরেকটা কথা স্যার,
- হ্যা, বলো,
- জবাইয়ের আগে গরুটারে একটু আস্তে ফালায়েন স্যার... অনেক আদরের গরু তো.....

এতটুকু বলেই লোকটা আবার কেঁদে উঠলো। আবার কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রতন সাহেবকে সালাম দিয়ে রাস্তার দিকে হাঁটতে শুরু করলো গ্রাম্যলোকটা। রতন সাহেব অনেক দিন পরে অনুভব করলেন, নিজের চোখ দিয়ে টপটপ পানি পড়ছে। ভেজা চোখ নিয়ে আর ভেতরে ঢুকলেন না। গেইটের গ্রিলে ভর করে নিশ্চুপ তাকিয়ে আছেন, সত্যিকারের কোরবানি দেয়া খালি পায়ের অচেনা মানুষটার দিকে.....


বিডি প্রতিদিন/ ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭/ তাফসীর

সর্বশেষ খবর