১০ অক্টোবর, ২০১৭ ১০:৫৫

গণপিটুনি: একটি যৌথ হত্যার নাম

ফাহিমা আক্তার:

গণপিটুনি: একটি যৌথ হত্যার নাম

প্রতীকী ছবি

সকালে উঠেই পত্রিকায় সাগর নামের একটি কিশোর ছেলেকে ‘গণপিটুনি’-তে হত্যা করার সংবাদ পড়ার পরই ২০০৭ সালের এক সকালের কথা মনে পড়ে গেল। তারিখের কথা ঠিক মনে নেই। কিন্তু সে দিনটি ভুলিনি আজো। সেদিন সকালে রাস্তায় লোকজনের চিৎকার শুনে দৌড়ে জানালার কাছে চলে গেলাম কি হচ্ছে দেখতে। ২০-২৫ বছর বয়সী লুঙ্গি পরা একটা ছেলেকে ২০-৩০ জন বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটির পাশে থাকা লোকগুলো লাঠি, বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে ক্রমাগত ছেলেটিকে আঘাত করেই চলছে। উৎসাহী হয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? “চুরি করসে। হিরোইন টিরোইন খায়, তাই চুরি করে। রাতে ধরা পরসে। বাইন্ধা রাখসিল। এখন বাইর করসে,” বলতে বলতে চলে গেল। তার একগাল হাসি দিয়ে বলে যাওয়া কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। 

সারারাত বেঁধে সকালে উঠে আবারও ছেলেটিকে মারার লোভ সামলাতে পারছেনা তারা। আর এমতাবস্থায় এই মানুষগুলো (!), এমনকি ঐ ছোট বাচ্চাগুলোও হেসে হেসে যাচ্ছে কিভাবে! বাসায় কেউ ছিলনা তখন। আমি ভাবছিলাম কি করব। বের হয়ে থামাবো লোকগুলোকে? কিন্তু কিভাবে! অনেকক্ষণ পর আমার ভাইয়া এল। তাকে বললাম প্লিজ -“তুমি এক্ষুণি গিয়ে ওদেরকে থামাও। ছেলেটার অবস্থা করুণ”। ভাইয়া বের হতে না হতেই শুনতে পেলাম ছেলেটি মারা গেছে। ছেলেটিকে নাকি একটি ধানক্ষেতের মাঠে ফেলে ইট-পাথরও ছুঁড়ে মারা হয়েছিলো। আমার কান দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছিল। নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। কিছু আর বলতে পারছিলাম না। ভাবলাম হয়তো পুলিশ এসে কিছু একটা করবে। কিন্তু বরাবরের মত সেটাও ‘গণপিটুনি’ আখ্যা পেয়ে ধামাচাপা পড়ে গেল। 

এরকম প্রায় হাজারো গণপিটুনির ঘটনা রয়েছে, যেগুলো কোনোরূপ বিচারের সম্মুখীন হয়নি। “কিসের বিচার হবে? তারা তো অপরাধী!” আর যারা একজন জ্বলজ্যান্ত মানুষকে চুরির অভিযোগে খুন করে ফেললেন, সেটা কি অপরাধের খাতায় আসে না? সে চুরি করে অপরাধ করেছে বলছেন, কিন্তু তারা তো খুন করলেন- তাও আবার যৌথভাবে। সেটা তো তাহলে চুরির অপরাধের চেয়ে বড় কিছু হওয়ার কথা ছিল, তাই নয় কি? আর এই যে চুরির বা ছিনতাই এর অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটি কি কখনো খতিয়ে দেখা হয়েছে? আমি তো দেখি, “চুরি করসে রে” বলা মাত্রই হাত এসে পড়ে অভিযুক্তের উপর। কতবার এমন হয়েছে যে তার কথাটা সঠিকভাবে শোনা হয়েছে? শোনার ইচ্ছে বা সময়টুকু কি আছে সেসকল শক্তি প্রদর্শনে আগ্রহী কিছু মানুষের (!)? কথাটা যথাযথ মনে হচ্ছে না? তাহলে এবার আরেকটি ঘটনা বলি।

আমার চাচাতো ভাই, বেশ শুকনো, শ্যামবর্ণ আর মাথায় কোঁকড়া চুল। সাদামাটা চলতে পছন্দ করে বলে বেশিরভাগ সময়ই টি-শার্ট পরে বের হয়। একদিন সন্ধ্যায় মেডিকেল রিপোর্ট নিয়ে বাসায় ফেরার পথে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল। কয়েকজন মাঝবয়সী পুরুষ তাকে টার্গেট করে তার আশেপাশে ভিড়তে লাগলো। বুঝতে পেরে ভাইয়া সজোরে হাটতে শুরু করলো। আর তা টের পেয়েই সেই সংঘবদ্ধ দলের একজন চিৎকার করলো, “ছিনতাই করসে, ছিনতাই করসে।” মুহূর্তেই ১৫-২০ জন ভাইয়াকে ঘিরে জড়ো হয়ে গেল। প্রত্যেকেই কিছু না শুনেই তাদের শক্তি প্রদর্শনে মরিয়া হয়ে ছুটে আসলো। ভাইয়া চিৎকার করে বলে উঠলো- “ওয়েট, ফার্স্ট লিসেন টু মি।” ইংরেজী শুনে তারা তাৎক্ষণিক থেমে গেল। ভাইয়া ইচ্ছে করেই ইংরেজী বলেছিল যাতে করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। ভাইয়া মেডিকেল রিপোর্ট দেখালো। আর এক ছাত্র এসে তা চেক করলো। ভাইয়ার কথা প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেদিন যদি ভাইয়া এই অলৌকিকভাবে নিষ্কৃতি না পেতো, তাহলে আজ হয়তো সে আর পৃথিবীর আলো দেখতে পেত না।

দেশে কি তাহলে এ নিয়ে কোন আইন নেই? আছে! পেনাল কোড-১৮৬০ এর ২ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শাস্তি পাওয়ার আগে অভিযুক্ত ব্যক্তি তার অপরাধের ব্যাপারে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার রাখেন। তাও আবার প্রমাণিত হওয়ার পর। কিন্তু গণপিটুনি নামক হত্যাকাণ্ডে কি ঘটছে? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না পেয়েই আর অভিযুক্তের কথা না শুনেই শাস্তি প্রদান করা হচ্ছে। অন্যদিকে, হত্যার শাস্তি হিসেবে যাবতজীবন বা মৃত্যুদণ্ডের সাজা আছে আইনে। কিন্তু এই যৌথভাবে হত্যার জন্য হত্যাকারীরা কি সেই সাজা পাচ্ছে? 

একদিকে আমাদের মানবীয় গুণ সারা বিশ্বে চর্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে আমাদের দেশের রাজন, সাগররা চরম মনুষত্বহীনতার শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। আজ চুরির অপরাধে চলছে যৌথ উদ্যোগে হত্যা, যাকে কিনা আমরা ‘গণপিটুনি’ আখ্যা দিয়ে পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে চলেছি। আমার আক্ষেপ সেই হত্যাকারী নরপৈশাচদের জন্য হয় না, বরং হয় তাদের জন্য যারা কিনা পাশে থেকেও নূন্যতম প্রতিবাদটুকু করে না। বরং তাদের হাতে থাকে মোবাইল ক্যামেরা আর মনে থাকে ভিডিওটি আপলোড করার তীব্র তাড়না। আর পাশে দাঁড়ানো যাদের মুখে হাসি থাকে, তাদের কথা না-ই বা বলি।


লেখক: নৃতত্ববিদ, ব্রাক ইউনিভার্সিটি এবং সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


বিডি প্রতিদিন/১০ অক্টোবর ২০১৭/হিমেল

সর্বশেষ খবর