২ নভেম্বর, ২০১৭ ১৫:৫৮

শরৎচন্দ্রের চোখে সেই বার্মা

ড. জহির আহমেদ:

শরৎচন্দ্রের চোখে সেই বার্মা

ড. জহির আহমেদ

১৮৭৬ সালে একটি ব্রাহ্মন পরিবারে শরৎচন্দ্রের জন্ম। ১৯০৩ থেকে ১৯১৬ নাগাদ শরৎচন্দ্র বার্মাতে অবস্থান করেন। ১৯০৩ সালে তিনি প্রথম রেঙ্গুনে যান। মামা শ্রী আগরনাথ চট্টপাধ্যায়ের কাছে উঠেন তিনি। মামা ছিলেন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী। সে সুবাধে শরৎচন্দ্র আইন ও বার্মিজ ভাষা শেখেন। কিছুদিন পর রেঙ্গুনের বার্মা রেলওয়েতে চাকুরী পান। মামার অকাল মৃত্যু তার জীবনের পরিকল্পনায় ছন্দপতন ঘটায়। বারবার বাসা বদল করেন, অনিশ্চয়তাকে বরণ করেন। রেঙ্গুনের বার্নার্ড লাইব্রেরীতে নিয়মিত যেতেন এবং পড়তেন স্পেন্সার, টলস্টয়, কান্ট, ডিকেন্স। এই লেখকদের প্রভাব পড়েছে শরৎচন্দ্রের লেখনিতে।

ছোটবেলা থেকেই যাত্রাদলে যোগ দিতেন তিনি। ২৬ বছর বয়সে রেঙ্গুনে জীবিকার সন্ধানে শরৎচন্দ্র চলে যান। রেঙ্গুন ভ্রমন ও জীবনকালের স্বর্ণকাল- এসময়ে তিনি চরিত্রহীন, শ্রীকান্ত এবং পথের দাবি উপন্যাস লিখেন। দূরের একজন আত্মীয় তার ভাগ্যের চাকা খুলে দেয়। তখনকার বার্মা শরৎ চন্দ্রের কাছে হয় এমন একটা ভূমি যেখানে নগরের রাস্তাগুলোতে ছিল স্বর্ণের ছড়াছড়ি। যে মুহূর্তে ভারতের লোকজন বার্মায় গমন করে, তখন অনেকেই চাকুরী, বিত্ত, ক্ষমতা আর মর্যাদাবান হয়ে ওঠে।

শ্রীকান্তের কাছে শুধু ঋণ আর মর্যাদা আকর্ষণীয় ছিল না। বরং প্রমত্ত সমুদ্রের উত্তাল জলরাশি বেয়ে বেয়ে ভ্রমনের আকর্ষণও ছিল। বার্মায় সাময়িক অভিবাসী হবার আগে শ্রীকান্ত গিয়েছিল তার প্রেয়সী পিয়ারী বাঈ এর কাছে। পিয়ারী বাঈ এর অশ্রুসজল জিজ্ঞাসা ছিল, ”যারা বার্মায় যায় তার আর ফেরত আসে না, সেটি কি তুমি জান?” শ্রীকান্তের কাছে পিয়ারীর আকুতি ছিল তাকে যেন সঙ্গে করে বার্মায় নিয়ে যায়। যাতে নর্তকীর পরিচিতি ছাপিয়ে পিয়ারী নতুন পরিচিতি লাভ করে।

কিন্তু শ্রীকান্ত একাই বার্মায় যাবে বলে পণ করেছিল। সমুদ্রে সাইক্লোনে পতিত হয়ে শ্রীকান্ত ঝড়ের যে এথনোগ্রাফিক বর্ণনা দেন, তা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রবল ঝড়ে কিভাবে লঞ্চের ভেতরের যাত্রীরা জাম পাকা হয়ে একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে গড়াগড়ি খাচ্ছিল তা ছিল অসম্ভব অনুভূতিপ্রবন একজন লেখকের বর্ণনা। শরৎচন্দ্র যাত্রীদের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে- বয়স্ক অনেক মানুষ যারা কিনা ব্যবসার খাতিরে বার্মায় ভ্রমণ করে, অনেক যুগল যারা কিনা বার্মা বা আরাকানে পারিবারিক বাধা অতিক্রম করার জন্য ভ্রমণ করে; এবং ভাগ্যাহত মানুষেরা যার উন্নত জীবিকার জন্য নতুন দেশে ভ্রমণ করে। শ্রীকান্তের জীবনে বার্মা সফর ছিল জীবনের নতুন অধ্যায়।

কয়লা ঘাটের কোন এক কুয়াশা ঢাকা ভোরে খাকি পরা একজন কুলি তার ট্রাংক বহন করছিল। স্টেশনে প্রবেশ করে শ্রীকান্ত দেখলো যে, মানুষগুলো জন্তুর পালের মত গাদাগাদি হয়ে বসেছিল, কুয়াশার ঠান্ডায় জমে যাওয়ার ভয়ে টিনশেডে অশ্রয় নিয়েছিল তারা। বন্দরে শরৎচন্দ্রের অভিজ্ঞতা ছিল একজন তৃতীয় শ্রেনীর যাত্রী, ভেড়ার পালের মত যাত্রীদের স্বাস্ত্য পরীক্ষা করার জন্য একজন বৃটিশের তত্ত্বাবধানে শ্রীকান্তও লাইনে দাড়িয়েছিল। শরৎচন্দ্রের প্রতি এটি অমানবিক, আত্নমর্যাদার পরিপন্থি, উপনিবেশিকদের বৈষম্যের কৌশল। এভাবে স্টিমারে বেশ কয়বার ‘প্লেগ’ বিরোধী অভিযান চলছিল, যাতে ভ্যাকসিন নিশ্চিত করে বার্মায় প্রবেশ করতে হয়। 

পথের দাবি গল্পের নায়ক অপূর্ব মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুন প্রতিনিধি; কিন্তু অপূর্ব বাঙ্গালী ভদ্রলোকও। সে তার বিধবা মা, করুনাময়ী বড় ভাই ও তাদের স্ত্রীদের সাথে কোলকাতায় বাস করত। কলেজ পরীক্ষার পরপরেই অপূর্ব বার্মার রেঙ্গুনে একটি চাকুরীর প্রস্তাব পায়। মাসে ৪০০ টাকার মাহিনা, সাথে বাড়ি ভাড়া, এবং ৬ মাস পরে আরও ২০০ টাকা যোগ হওয়ার গ্যারান্টি। প্রস্তাবনাটি শুনে অপূর্বের মা কে এক অজানা ঝাঁকি দেয়, এটি কি এমন স্থান যেখানে অপূর্ব যাবে? অপূর্বের ভাষ্য “আমাকে বলা হয়েছে যে, বার্মা চরমভাবে একটি অধার্মিক দেশ, বর্বরদের বসবাস ওখানে, আমি কিভাবে ভাবলাম যে, আমার মা আমাকে যেতে দেবে? কিন্তু কলেজ গ্রাজুয়েটের বেকার থাকার ভয়ে করুণাময়ী অবশেষে অপূর্বকে বার্মা যাবার অনুমতি দেয়। অপূর্ব মায়ের রক্ষণশীল নিয়ম মেনে চলতে থাকে। বার্মা যাবার সময় তিওয়ারী নামক একজন ব্রাহ্মণ বাবুর্চিকে সাথে নিয়ে যায়। স্টিমারে অপূর্ব সাথে করে আনা খাবার খায় এবং স্টিমারের পানাহার থেকে বিরত থাকে। সে যখন রেঙ্গুন বন্দরে পৌঁছে, তাকে ভীষন দূর্বল দেখাচ্ছিল। কিন্তু অপূর্বর প্রশান্তি ছিল তাকে ব্রাহ্মণত্ব বিসর্জন দিতে হয়নি।

অপূর্ব যে বাড়িটিতে উঠেছিল সেটি ছিল জীর্ণশীর্ণ। তার উপরে প্রতিবেশীরা ছিল বিধর্মী। সেখানে ছিলেন চায়না ভদ্রলোক, আর একটি পরিবার ছিল এ্যাংলো ভারতীয়। উপর তলার ইউরোপীয় প্রতিবেশী একবার ময়লা পানি মেঝেতে ঢালার কারণে চুঁইয়ে অপূর্বের ঘাড়ে পড়তে থাকে। ফলে তার খাবার ও অন্যান্য জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যায়। ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে ঐ সাহেব উল্টো অপূর্বর বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা ঠুকে দেয় এই বলে যে অপূর্ব নাকি সাহেবের স্ত্রী ও কণ্যাকে অপমান করেছিল। অপূর্ব ও তার সহযোগীকে কোর্টে সমন জারি করা হয় ও ২০ রুপী জরিমানা করা হয়।

এর আগের ঘটে যাওয়া আরেকটি ঘটনা অপূর্বকে অপমানিত করেছিল। অপূর্ব যখন কোলকাতা থেকে বার্মার স্টেশনে পৌছেছিল, তখন সে প্লাটফর্মের একটি বেঞ্চেতে বসেছিল। হঠাৎ করে এ্যাংলো ইন্ডিয়ান ছেলেদের দল তাকে ধাক্কা দিল এবং ভারতীয় দুধ বিক্রেতা বলে উপহাস করছিল। আঘাত আর উপহাসের বিচার চাইল অপূর্ব স্টেশন মাষ্টারের কাছে। কিন্তু অভিযোগ গ্রহন করা হল না একারনে যে, অপূর্ব কোন দু:সাহসে ইউরোপীয়দের জন্য রিজার্ভ করা বেঞ্চে বসেছিল। বার্মায় এসে অপূর্ব এই প্রথম রেসিজম ও বৈষম্যের শিকার হল। অপূর্ব ভেবে পাচ্ছিল না কেন বিদেশের মাটিতে একজন শিক্ষিত ব্রাহ্মণ ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হবে? শ্রীকান্তের মতই পথের দাবি আত্নজীবনীমূলক। রেঙ্গুনে ভ্রমন ও বার্মায় অবস্থানকালীন শরৎচন্দ্রের অভিজ্ঞতায় ভরপুর ঐ উপন্যাসগুলো। শরৎচন্দ্রের ভ্রমনকাহিনী হলেও ওগুলো মধ্যবিত্তের ফ্যাশন নির্ভর ভ্রমন ছিল না।

রেঙ্গুনের জীবন অসমতা, বর্ণবাদ এবং তৎপ্রসূত উপনিবেশ বিরোধী এবং পুঁজিবাদ বিরুদ্ধ বার্তাগুলো দুটি উপন্যাসের পরতে পরতে আমরা পাই। রেঙ্গুন অপূর্বর কাছে বিচ্ছিন্ন শহর আর মানুষজন প্রতিনিয়ত সমস্যায় জর্জরিত। তিওয়ারীর যখন জলবসন্ত হয় অপূর্ব তাকে যত্ন নিতে পারেনি। উপরন্তু ভারতীয় প্রবাসী কুলীদের বাসস্থানে গিয়ে তার চোখ ছানাবড়া। দারিদ্রতা, রোগ-শোক- এগুলো নিজের মধ্যবিত্ত অবস্থান দিয়ে মেনে নিতে পারছিল না অপূর্ব। ভাঙ্গাচোরা, জীর্ণশীর্ণ টিনশেডের বসতি ছিল অমানবিক। সামনেই ছিল অনেকগুলো পানির কল আর পিছনে ছিল সারি সারি টয়লেট। যেখানে চটের ছালা ঝুলতেছিল দিনের পর দিন, বৎসরের পর বৎসর—হাজার হাজার পাঞ্জাবী, দক্ষিণ ভারতীয়, বার্মিজ, বাঙ্গালী, উড়িষ্যা, হিন্দু-মুসলিম, নারী-পুরুষ বসবাস করছিল ঔ গিঞ্জি এলাকাতে।

অপূর্বের মনে হচ্ছিল রেঙ্গুন এমনে একটি স্থান যেখানে পানির অপ্রতুলতা সাংঘাতিক আর গোসলখানাসহ প্রাইভেসির কোন বালাই ছিল না। অপূর্ব অবাক হয় আরও যখন দেখে ফ্যাক্টরীর শ্রমিকেরা কি মানবেতর জীবন যাপন করে। অপূর্বের ভাবনায় কেন ভারতীয়রা রেঙ্গুনে এই মানবেতর জীবন যাপন করতে অভিবাসন করে?

লেখক: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

বিডিপ্রতিদিন/ ০২ নভেম্বর, ২০১৭/ ই জাহান

সর্বশেষ খবর