৭ নভেম্বর, ২০১৭ ১৬:৪১

নৃশংস পশু হত্যা বিকৃত মস্তিষ্কের পরিচয়

শাকীর এহসানুল্লাহ

নৃশংস পশু হত্যা বিকৃত মস্তিষ্কের পরিচয়

ফাইল ছবি

সবদিক থেকে মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হলেও প্রাণ হারানো বা মৃত্যু যন্ত্রণার দিক থেকে পশু আর মানুষ একই। একটা মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করলে মানুষটার যে কষ্ট হয়, একটা পশুরও তাই হয়। মৃত্যু বা ব্যথা পাওয়ার ভয় যেমন মানুষের আছে, তেমন পশুরও আছে। যেমন আমরা গরু, ছাগল ও ঘোড়া ইত্যাদি পালন করতে গিয়ে লাঠি, বেত কিংবা চাবুক ব্যবহার করে থাকি। এতে বুঝা যায়, ব্যথা বা আঘাতের অনুভূতিটা একটা মানুষ আর পশুর মধ্যে সমান।

বর্তমানে বাংলাদেশে নৃশংসভাবে পশু হত্যার হার ব্যাপকভাবে বাড়ছে। প্রায় প্রতিদিনই আমরা নির্মমভাবে পশু হত্যার খবর পাই, ভিডিও দেখি। কারণে অকারণে, জেনে না জেনে পশুর উপর বীভৎস নির্যাতনের দৃশ্য দেখছি প্রতিনিয়ত।

সম্প্রতি রাজধানীর পশ্চিম রামপুরায় কুকুরের উপর মধ্যযুগীয় বর্বরতার খবর নিশ্চয় অনেকে জেনে গেছেন। সেখানে দুই মা কুকুরসহ নিষ্পাপ ১৪টি বাচ্চাকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হয়। প্রথমে দুটি মা কুকুরকে পেটানো হয়; চোখ উপড়ে ফেলা হয়; হাড় ভেঙে ফেলা হয়। এরপর তাদের চোখ না ফোঁটা ১৪টি বাচ্চাকে বস্তাবন্দী করে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হয় বাগিচারটেক জামে মসজিদের পাশে একটি ফাঁকা জায়গায়।

গত ৪ নভেম্বর মিরপুর মনিপুরি পাড়ায় বাথরুমে বন্দি করে নৃশংষভাবে হত্যা করা হয় আরেক কুকুরকে। এবং হত্যার একটিও ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ভিডিওটিতে দেখা যায় শক্ত রড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কুকুরটির চোখ উপড়ে ফেলছে একজন। আবার আহত অবস্থায় কুকুরটির মুখের ভেতরে রড ঢুকিয়ে জোরে আঘাত করছে! আশপাশে আরও বেশ কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছেন নির্বাক।

এ তো গেলো রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরের প্রতি নিষ্ঠুরতা। ঘরের উপকারী পশুও আজকাল রেহাই পাচ্ছে না মানুষের থেকে। গত ২৮ অক্টোরব শুক্রবার রাতে রাজবাড়ী সদর উপজেলায় একটি ঘোড়ার চার পা বেঁধে পায়ুপথে ও মূত্রনালিতে পৃথকভাবে বাঁশের লাঠি ঢুকিয়ে অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। প্রচণ্ড আঘাতে ঘোড়াটির নাড়িভুড়ি মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে!

ঘোড়াটি এতদিন যে মানুষদের উপকার করে আসলো, তাদের হাতেই নির্মমভাবে মরতে হলো অবশেষে। অথচ শত্রুতা ছিলো ঘোড়ার মালিকের সাথে। এমন ঘটনা আছে আরও অনেক। এর সামান্য কিছু আমরা জানি, আর বড় অংশটাই থেকে যায় আঁড়ালে।

আমি জানি, আপনি এখন ভাবছেন, যে দেশে মানুষকেই নৃশংষভাবে হত্যা করার ঘটনা প্রচুর। অনেক ক্ষেত্রে এসব হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচারও হয় না। সে দেশে আবার পশু হত্যা নিয়ে কথা! আসলে মানুষ হত্যার সাথে পশু হত্যার একটি সূক্ষ্ম সম্পর্ক আছে। ব্যাপারটা তাহলে খুলে বলছি। তার আগে দু'একটি ঘটনা মনে করিয়ে দেই।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর বগুড়ার কাহালু এবিসি টাইলস কারখানায় পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে স্কোয়ারিং মেশিনের হেলপার ২০ বছর বয়সী মো. রাসেলকে হত্যা করেছে ২৩ বছর বয়সী অপর শ্রমিক মো. রুবেল। এছাড়াও গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর খুলনায় শিশু রাকিব এবং চলতি বছরের জুলাই মাসে নারায়ণগঞ্জে শিশু সাগর বর্মণকে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়।

মানুষ হত্যা আর তার বিচারের ব্যাপারটা আমি বাদই দিলাম। যেহেতু আমাদের দেশে এটা এখন স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কিন্তু আপনি কি কখনও ভেবেছেন? এই হত্যার ক্ষেত্রে নৃশংসতাটা কোথা থেকে আসছে মানুষের ভেতরে? ঠিক কী কারণে মানুষের ভেতরে জঙ্গলের জানোয়ারের মতো অদ্ভুত স্বভাব ঢুকে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এই যেমন আমরা আগে শুনতাম গুলি করে হত্যা, মাথায় বাড়ি দিয়ে হত্যা, ছুরির আঘাতে হত্যা ইত্যাদি। কিন্তু হত্যার ধরণটা পাল্টে গেছে এখন। কেউ কাউকে হত্যা করতে গেলেও সাধারণ পন্থা ব্যবহার করছে না!

এখন তাহলে আপনাকে একটা মজার তথ্য দেই। সাধারণত মানুষ নৃশংস ও বর্বর হয় প্রথমে পশুর উপর। এবং ধীরে ধীরে নৃশংসতটা তার মস্তিষ্কে বসে যায়, এভাবে তার মধ্যে চলে আসে নৃশংসতার অভ্যস্ততা। তারপর একটা দুইটা তিনটা করতে করতে ছোট ছোট অপরাধগুলো বড় বড় অপরাধের দিকে এগিয়ে যায়। পশু হত্যা থেকে হাত চলে আসে মানুষ হত্যার উপর। পশুর মৃত্যু যন্ত্রণা ছটফটানি দেখতে দেখতে মানুষের ওপর নির্যাতনের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই অভ্যস্ততা চলে আসে।

কিছু দিন আগে আমেরিকায় এক গবেষণার মাধ্যমে এফবিআই (মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা) এর কাছে এক অদ্ভুত তথ্য আসে। তারা বেশ কিছু ক্রাইমের উপর গবেষণা করে জানতে পারেন যে, প্রায় যে কোনো বড় ধরনের ক্রাইমের সূত্রপাত হয় পশুর উপর নৃশংস হওয়ার অভ্যস্ততা থেকে। তাদের ধারণা, পশুর উপর বর্বরতা বন্ধ করতে পারলেই ভবিষ্যতে মানুষের উপর বর্বরতাকে কমিয়ে আনা সম্ভব।

এক কথায়, এফবিআই মনে করে, আজকে যে একটা নিরীহ পশু কে অত্যাচার করছে বা মারছে, কাল সে মানুষ মারতে দ্বিধা করবে না। তাই আজকে একজন পশু হত্যাকারী শনাক্তকরণ মানে কালকের একজন মানুষ হত্যাকারীকে শনাক্ত করা।
সূত্র : https://www.fbi.gov/news/stories/-tracking-animal-cruelty

অতএব, আপনি বা আমরা যারা বলি, যেই দেশে মানুষ হত্যা হয় প্রতিদিন, 

সেই দেশে পশু হত্যা নিয়ে আবার কিসের হৈ চৈ। আমাদের একটা জিনিস মাথায় রাখা উচিত যে, হত্যা হত্যাই। সেটা হোক মানুষ বা পশু। কারণ হত্যা থেকেই হত্যার অভ্যাস, অভ্যস্ততা বা সাহস তৈরী হয়। একটি পশুর প্রতি বর্বরতাকে যদি আজকে আমরা প্রশ্রয় দেই, আইনের আওতায় না নিয়ে আসি, তাহলে কাল মুখ বন্ধ করে মানুষের উপর বর্বরতা দেখে যেতে হবে আমাদের। এবং তাই হচ্ছে।

এখন দৃষ্টি দেই আইনের দিকে। এ ব্যাপারে আইন কী বলে।
ইংরেজদের আমলে বাস্তবায়ন করা 'পশু নির্যাতন আইন-১৯২০' এ উল্লেখ আছে, কেউ অপ্রয়োজনীয় নির্যাতনের দ্বারা পশু হত্যা করলে 'পশু নির্যাতন আইন-১৯২০ ধারা ৭' অনুযায়ী তার শাস্তি ২০০ (দুই শত) টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা ৬ (ছয়) মাস পর্যন্ত কারাদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবে।

হয়তো আপনি বলতে পারেন, কুকুর কামড়ালেও কি তাকে মারা যাবে না? যাবে। তবে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি সাপেক্ষে। আইনে এও উল্লেখ আছে যে, এ আইনের ২৩ ও ২৫ ধারা অনুযায়ী দুর্দশাগ্রস্ত বা অনুপযুক্ত কোন পশুকে ম্যাজিস্ট্রেট আরোগ্যালয়ে পাঠানো কিংবা নিধনের আদেশ দিতে পারেন।
সূত্র : http://www.mahid24.com/laws/পশু-নির্যাতন-আইন-১৯২০/

সেই ১৯২০ সালে ইংরেজরা পশু নির্যাতনের জন্যে জরিমানা ধরেছিলো দুই শত টাকা। যা বর্তমানের হিসেবে লাখ টাকার উপরে। আর ইংরেজদের বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান জাতি। তারা পশু নির্যাতনের ব্যাপারটাকে এতটা সিরিয়াসভাবে নিয়েছে। নিশ্চয় সেটা তারা কোনো গবেষণা বা চিন্তা ছাড়া অনর্থক করেনি।

এসব ব্যাপারগুলো মাথায় রেখেই গত ২০ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভায় 'প্রাণী কল্যাণ আইন-২০১৬’র নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। এই আইনে প্রাণী (পশু) হত্যা, ও পশুর সাথে নিষ্ঠুর আচরণ ও অতিরিক্ত কঠোর পরিশ্রমে বাধ্য করলে জেল ও জরিমানার বিধান রাখা রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বাংলাদেশ সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার নিয়মিত সাপ্তাহিক বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেছিলেন, ১৯২০ সালের বিদ্যমান নিষ্ঠুরতা আইন পরিবর্তন করে নতুন খসড়া আইনটি প্রণীত হয়েছে। তিনি আরো বলেন, মানুষ ছাড়া মেরুদণ্ড গৃহপালিত ও পোষা প্রাণী এ আইনের আওতামুক্ত হবে।

প্রস্তাবিত এই আইনে প্রাণী হত্যা ও গুরুতর আহতের ক্ষেত্রে ২ বছর জেল ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং নিষ্ঠুর আচরণের জন্য ৬ মাস জেল ও ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে প্রাণী সম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক বা তার অনুমোদিত কর্মকর্তা বা পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর থেকে ঊর্ধ্বতন পদমর্যাদা সম্পন্ন কর্মকর্তা এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারবেন।

সূত্র : http://www.kalerkantho.com/online/national/2017/02/20/466051

অতএব, ভবিষ্যতে এমন উদ্ভট ও বীভৎস মানুষ হত্যা বা ডেঞ্জেরাস ক্রাইমগুলোকে বন্ধ করতে হলে আমাদেরকে এমন পশু হত্যার মতো বিষয়গুলোকেও গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে। আজ যে রাস্তার একটি প্রাণীকে নৃশংসভাবে হত্যা করতে পেরেছে, কাল সে একটি মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করতে দ্বিধা করবে না। আজ যে একটি পশুর উপর বর্বরতাকে সহজভাবে নিতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে, কাল সে মানুষের উপরের বর্বরতাকেও সহজভাবে নিতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। 

তাই, এখনই সময় নিজে সুস্থ হওয়ার। সমাজকে সুস্থ করার।

বিডি-প্রতিদিন/০৭ নভেম্বর, ২০১৭/মাহবুব

সর্বশেষ খবর