২৮ মে, ২০১৮ ১৬:১৫

ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী: উল্টো পথেই কী থাকছে বিএনপি!

শিবলী হাসান

ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী: উল্টো পথেই কী থাকছে বিএনপি!

'ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানে কী করেছেন প্রধানমন্ত্রী’, মির্জা ফখরুলের এই প্রশ্নটি দিয়ে লেখা শুরু করছি, এই প্রশ্নের উত্তরে আমি অবশ্যই যাবো এবং ভারত বাংলাদেশের অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি কে কী করেছে তাও তথ্যসহ উপস্থাপন করবো। তবে তার আগে মির্জা ফখরুলের কাছে জানতে চাইবো, আপনারা যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন এই অমীমাংসিত ইস্যুগুলো নিয়ে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন? সমস্যা সমাধান করেছিলেন নাকি সমস্যা আরো বাড়িয়ে দিয়ে গেছেন?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ২৫ মে শুক্রবার দু'দিনের সফরে ভারত যান। বিশ্বভারতীর সমাবর্তন উৎসবে যোগদানের পর শান্তিনিকেতনের পূর্বপল্লিতে নির্মিত ‘বাংলাদেশ ভবনে’ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সম্মানজনক ডি-লিট ডিগ্রি প্রদান করেছেন। মূলত এই সম্মান একা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর না , এই সম্মান গোটা দেশের। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো প্রধানমন্ত্রীর এই সফরকে নিয়েও বিএনপি শুরু করেছে এক ঘৃণ্য রাজনৈতিক খেলা। ভারতের সাথে অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে কী করেছেন তা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। তো আসুন দেখা যাক এখন পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশের অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে কোন রাজনৈতিক দল সবচাইতে বেশি কাজ করেছে এবং সমস্যা সমাধান করেছে।

বাংলাদেশ ভারতের অমীমাংসিত বিষয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তিস্তা চুক্তি, তিনবিঘা করিডোর, ছিটমহল সমস্যা, অর্থনৈতিক ট্রানজিট বিষয়ক বিরোধ, উভয় দেশের যৌথ সংগঠন বঙ্গ সেনা এবং হরকত-আল-জিহাদের সশস্ত্র কর্মকাণ্ডসহ সন্ত্রাসী সঙ্গগঠনের কর্মকাণ্ড, অবৈধভাবে বাংলাদেশি নাগরিকদের ভারতে গমন, সমুদ্র অঞ্চলের মালিকানা নিয়ে বিরোধ। তিস্তা চুক্তি বাদে উপরে উল্লেখিত সবকটা অমীমাংসিত বিষয় মীমাংসা হয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। বর্তমান সরকারই ভারত-বাংলাদেশের অমীমাংসিত মূল ৭টা বিষয়ের মধ্যে ৬টি'র সমাধা করেছেন, তিস্তা চুক্তি এখনো ঝুঁলে আছে এবং সরকারের চেষ্টার কোন কমতি নেই তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে। তাই স্বভাবিকভাবেই আমাদের প্রশ্ন থাকবে মির্জা ফখরুলদের কাছে যে, আপনারা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকেও যেখানে অনেকগুলো অমীমাংসিত ইস্যুর একটিরও সমাধা করতে পারেননি সেখানে কোন মুখে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে এই ইস্যুতে প্রশ্ন করেন? একের পর এক এই ইস্যুতে আঙুল তুলেন? ন্যূনতম লজ্জাবোধ থাকলেও তো এই প্রশ্ন উত্থাপন করার কথা না!

বিএনপিকে একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, ১৯৮৩ সালে তিস্তার পানি সমবণ্টন নিয়ে প্রথম প্রস্তাব ওঠে। কিন্তু ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের কোন রূপরেখা গ্রহণ করেনি কোন সরকার। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ এবং ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন তিস্তা নিয়ে কার্যত কোন আলোচনাই হয়নি এমনকি ছিটমহল সমস্যা, সমুদ্রসীমাসহ অন্যান্য অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে কোন আলাপ আলোচনা করেনি তৎকালীন বিএনপি সরকার। বিএনপি ব্যস্ত ছিলো উত্তর-পূর্ব ভারতে সশস্ত্র আন্দোলনে ইন্ধনের মাধ্যমে ভারতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরিতে, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে বিএনপি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে স্বাধীনতা পরবর্তীকালের সবচাইতে জঘন্য সম্পর্কে পরিণত করেছিলো। ভারতের সাথে বাংলাদেশের অমীমাংসিত বিষয়কে মীমাংসা করা নয় বরং সমস্যা আরো জটিল করে তুলাতেই ব্যস্ত সময় পাডর করেছিলো তৎকালীন বিএনপি সরকার। পার্শ্ববর্তী দেশকে অস্থিতিশীল করার নেপথ্যে কাজ করতে গিয়ে নিজ দেশে আশ্রয় দেয়া হয় ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সঙ্গগঠনের নেতাদের এবং ওই সময়টিতে এর ভয়াবহ কুফল ভোগ করেছিল গোটা জাতি। সন্ত্রাসীদের যেহেতু কোন জাত ধর্ম বা দেশ নেই সেহেতু আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গোটা বিশ্বে সন্ত্রাসী দেশের তকমা লাগিয়ে ফেলে, দেশের ৬৪ জেলায় বোমা বিস্ফোরণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সমাবেশে হামলা তখন নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠে এই বিএনপি-জামায়াত জোটের অপশাসনে।

অবশেষে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে এবং ভারতের বিদ্রোহী দলের কিছু নেতাকে ভারত সরকারের হাতেও তুলে দেয় তারা। ফলে পার্শ্ববর্তী দেশের সাথে একটি চমৎকার সম্পর্কের মাধ্যমে অগ্রসর হতে থাকে বাংলাদেশ। অহেতুক ভারত বিরোধী নীতি যে কখনোই কোন অমীমাংসিত বিষয়কে মীমাংসার রেখা টানতে পারে না সেটা বিএনপি না বুঝলেও আওয়ামী লীগ বুঝতে পারে কেননা জাতির পিতার পররাষ্ট্রনীতি সর্বোপরি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কোন রাষ্ট্রের সাথে বৈরিতার শিক্ষা দেয় না। তারই ধারাবাহিতায় ২০১১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয় এবং সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে একটি খসড়া চুক্তি তৈরির জন্য দুই দেশের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়। অতঃপর ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের সময় দুই দেশের বহু অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় সাধারণ জনগণ। ছিটমহল সমস্যা সমাধানে মাধ্যমে হাজারো মানুষ তার নিজস্ব পরিচয় পায়, পায় তার ভূখণ্ড। চুক্তি কার্যকর হওয়ার ফলে ভারতের ১১১টি ছিটমহল (১৭,১৬০ একর জমি) বাংলাদেশের অংশ হয়েছে। অর্থাৎ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত যে বাংলাদেশের আয়তন আমরা পড়েছি ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিমি, সেই বাংলাদেশের আয়তন বেড়ে হয়েছে ১, ৪৭, ৬৩৯.৪৪ বর্গ কি.মি.। এটা শুধু বাংলাদেশের এক বিরাট অর্জন নয় বরং পৃথিবীর ইতিহাসে এক অনন্য অর্জন। কেননা আজ পর্যন্ত এই ছিটমহল সমস্যার সমাধান পারেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা মেক্সিকো। পৃথিবীর অনেক বড় বড় রাষ্ট্রও পারেনি এই ছিটমহল সমস্যা সমাধান করতে। সেখানে বাংলাদেশ পেরেছে শেখ হাসিনা সরকারের অনন্য নেতৃত্বগুণে।

এবার আসি সমুদ্রসীমা নিয়ে। সমুদ্রে ভারত-বাংলাদেশ অমীমাংসিত এলাকা ছিলো ২৫,৬০২ বর্গকিলোমিটার। মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা জয়ের পর এক অনন্য সাহসিকতা নিয়ে সমুদ্রসীমাতে যে অমীমাংসিত ভূমি রয়েছে তা মীমাংসার জন্য পদক্ষেপ নেয় বাংলাদেশ। নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী সালিসি আদালতের রায়ে বঙ্গোপসাগরের অমীমাংসিত ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা বাংলাদেশ পেয়েছে। বাকি ছয় হাজার ১৩৫ বর্গকিলোমিটার পেয়েছে ভারত। এই রায়ের ফলে প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়টি সুরাহা হওয়ায় বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে পেরেছে। বাংলাদেশ- ভারত উভয় রাষ্ট্রই আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়েছে। কেননা অমীমাংসিত বিষয়গুলো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ধরেই সমাধানের পথে এগিয়েছে বাংলাদেশ।

অপরদিকে একের পর এক কূটনৈতিক বিজয় ও ভারতের সাথে অমীমাংসিত বিষয়গুলো যখন মীমাংসা করে চলছে আওয়ামী লীগ সরকার তখন বিএনপি শুধুই অযৌক্তিক সমালোচনা করে যাচ্ছে। যে বিএনপি ঐতিহাসিক মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিকে একসময় 'দাসত্ব চুক্তি'/ 'গোলামি চুক্তি' হিসেবে উল্লেখ করেছিলো এখন কীনা সেই বিএনপি মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়নের তাগিদ দেয় সরকারকে! যাই হউক, তিস্তা বা অন্যান্য চুক্তি বাস্তবায়নের তাগিদ দেয়ার মাধ্যমে বিএনপি অন্তত এটা স্বীকার করে নিয়েছে যে, একসময় নিজেরা ভুল ছিল, মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিই যে মূলত কার্যকরী এবং ভারত-বাংলাদেশের অমীমাংসিত বিষয়কে সুরাহা করার যৌক্তিক চুক্তি ছিলো তা নিজেদের এখনকার বক্তব্যে প্রমাণিত হচ্ছে।

সবশেষে একটি ঘটনা দিয়ে আমার লেখা শেষ করছি, ঘটনার জন্মদাতা বেগম খালেদা জিয়া নিজেই। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে বেগম জিয়া ভারত সফরে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে আসার পর সংবাদ সম্মেলনে যখন বেগম জিয়াকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো যে, তিস্তা চুক্তি নিয়ে আলোচনা কি কতোদূর হয়েছে। বেগম জিয়ার উত্তর শুনে সংবাদকর্মীরা হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিলেন, বেগম জিয়া নাকি ভুলে গিয়েছিলেন তিস্তা নিয়ে আলোচনা উত্থাপন করতে! একজন প্রধানমন্ত্রী যদি রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়ে মূল ইস্যুই আলোচনা করতে ভুলে যান তবে সাধারণ জনতার প্রতিক্রিয়া কী হয় তা নাইবা বললাম! আবার সেই দলীয় প্রধান বা দলের নেতারা যখন ভারত-বাংলাদেশের অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে বড় গলায় কথা বলেন তখন স্বাভাবিক অর্থেই প্রশ্ন জাগে, কাদের হয়ে কথা বলছেন তারা? যে বিএনপি দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকেও ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে কোন মীমাংসায় যেতে পারেনি তাদের মুখে এসব বুলি হায়াহীন অপদার্থের বক্তব্য বলে মনে হয়! তাই এসব ফাঁকা বুলি না দিয়ে বিএনপির উচিত যুক্তি দিয়ে, বিবেচনা দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে মূল্যায়ন করা। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এবং দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ক্ষেত্রে বিরোধীতার মানসিকতা পরিহার করে বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পর্ককে যাচাই করা। তবেই দেশের মঙ্গল এবং জনগণের মঙ্গল।

লেখক: সমাজকর্মী, সাবেক শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাবি।

(পাঠক কলাম বিভাগে প্রকাশিত মতামত একান্তই পাঠকের, তার জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়) 

বিডি-প্রতিদিন/২৮ মে, ২০১৮/মাহবুব

সর্বশেষ খবর