কদিন আগের ঘটনা। সকালে ঘুম ভাঙল মোবাইলের শব্দে। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখি এলাকার এক ছোটভাই ফোন করেছে। ঘুম ভাঙার কারণে প্রথমে বিরক্ত হলেও পরে বেশ আগ্রহ নিয়েই ফোনটা রিসিভ করলাম। ছোটভাই অত্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত গলায় বলতে লাগল, ভাই, আমাকে বাঁচান। আমার লাইফ তামা তামা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। আমি বললাম, লাইফ তামা তামা হয়ে গেলে খুবই সমস্যা কিন্তু। কারণ এই যুগে তামার একদমই দাম নেই। যে কারণে কোনো বাড়িতেই এখন তামার তৈরি জিনিসপত্র দেখা যায় না। ছোটভাই খুবই হতাশ হলো, ভাই, আপনার কারণে আমি আমার বিপদের কথা বলতে এলাম, আর আপনি আমার সঙ্গে রসিকতা করেন? কষ্ট পেলাম ভাই। আমি এবার সিরিয়াস হলাম। গলার স্বর খাদে নামিয়ে জানতে চাইলাম কী হয়েছে। ছোটভাই বলল, আমার প্রেমিকার বাবা আমার পেছনে মাস্তান লেলিয়ে দিয়েছে। মাস্তানরা গত তিনদিন ধরে আমাকে খুঁজছে। হয়তো ধরাও পড়ে যাব। আমার কী হবে ভাই জানি না। আমি এবার তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে বসে গেলাম, মাস্তানরা তোকে খুঁজবে কেন? কী করেছিস তুই? ছোটভাই বলল, আমি কিছুই করিনি। প্রেমিকাকে শুধু একটা কথা বলেছিলাম। আমি বললাম, শুধু একটা কথার জন্য প্রেমিকার বাবা তোর পেছনে মাস্তান লেলিয়ে দিল? তা তুই তাকে কী বলেছিলি? ছোটভাই বলল, আসলে তেমন কিছু বলিনি। প্রেমিকার সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলাম। কিন্তু সেই ফোনালাপ ফাঁস হয়ে গেছে। আমাদের সেই ফোনালাপের রেকর্ড এখন প্রেমিকার বাবার হাতে। আমি খানিকটা অস্থির হয়ে বললাম, কিন্তু তুই প্রেমিকার বাবার ব্যাপারে এমন কী বলেছিলি যে... ছোটভাই বলল, আমি শুধু বলেছিলাম তোমার বাবার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে? মোটামুটি একই ঘটনা ঘটল আমার এক প্রতিবেশীর ক্ষেত্রে। পরশুদিন দেখা হতেই তিনি কাঁদো কাঁদো গলায় বলতে লাগলেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে ভাই। আমার দশ বছরের সংসার জীবনের হয়তো ইতি ঘটতে যাচ্ছে। আমি থমথমে গলায় বললাম, কী হয়েছে ভাই? ভাবির সঙ্গে কি কোনো সমস্যা হয়েছে? প্রতিবেশী বললেন, জি ভাই, বিরাট সমস্যা। আর সমস্যাটার মূল কারণ হচ্ছে দুলাভাই। আমি কোথায় যেন একটা রহস্যের গন্ধ পেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ভাবির সঙ্গে সমস্যা। তার মানে প্রেমের কোনো বিষয় না তো? প্রতিবেশী বললেন, আরে না, সে ধরনের কিছু না। আমি মোবাইলে আমার কলেজ জীবনের এক বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তেমন কোনো কথা না। হাই হ্যালো। কিন্তু সেই ফোনালাপ ফাঁস হয়ে যাওয়ায় আপনার ভাবি রাগ করেছে। বলছে আজীবনের জন্য বাপের বাড়ি চলে যাবে। আমি কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বুঝতে না পেরে বললাম, আপনি যে বললেন মূল কারণ নাকি আপনার দুলাভাই। দুলাভাইয়ের বিষয়টা ঠিক বুঝতে পারলাম না। আপনার দুলাভাই কি ফোনালাপটা ফাঁস করেছে? প্রতিবেশী বললেন, না বুঝে কথা বললেন না। দুলাভাই ফোনালাপ ফাঁস করতে যাবেন কেন। আমি দুলাভাইকে দোষারোপ করছি এই জন্য, কারণ সর্বপ্রথম মোবাইল কেনার পরামর্শটা সে-ই আমাকে দিয়েছিল। যদি আজ আমার মোবাইল না থাকত, তাহলে ফোনালাপ কি ফাঁস হতো? বলেন?
আমাদের গ্রামের এক লোক দু সপ্তাহ হয় মোবাইল কিনেছে। কদিন আগে বাড়িতে গিয়ে জানতে পারলাম এই দুই সপ্তাহে সে কার সঙ্গে ফোনে কী কথা বলেছে সবই নাকি আশপাশের লোকজন জানে। আমি বললাম, আসলে আজকাল ফোনালাপ খুব ফাঁস হচ্ছে তো! তাই সহজেই বিভিন্নজনের গোপন কথা জানাজানি হয়ে যাচ্ছে। আমার কথা শুনে পাশ থেকে আরেকজন বলে উঠল, আপনে যা ভাবতেছেন তা না মিয়া। উনার ফোনালাপ কেউ ফাঁস করে নাই। ফাঁস উনি নিজেই করছে। কারণ উনি কথা বলার সময় এত জোরে জোরে কথা বলে যে, পুরা গেরামের লোক শুনতে পায়।
আমার এক চাচা পোস্টঅফিসে চাকরি করেন। তাকে সেদিন খুবই উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলাম, এত খুশি যে চাচা? কী হয়েছে? চাচা বললেন, এখন সবার ফোনালাপই কম-বেশি ফাঁস হচ্ছে। আশা করি, আমাদের সুদিন ফিরে আসবে। আমি কিছুক্ষণ তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বললাম, ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার সঙ্গে আপনাদের সুদিন ফিরে আসার সম্পর্ক কী? চাচা বললেন, ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার ভয়ে আর কেউ ফোনে কথা বলবে না। কথাবার্তা যা বলার বলবে চিঠিপত্রের মাধ্যমে। আর চিঠিপত্র আদান-প্রদান যত বাড়বে আমাদের পোস্টঅফিস তত জমজমাট থাকবে, ঠিক কি না? চলো ভাতিজা, এই খুশিতে তোমাকে বাতাসা খাওয়াই। চলো।