সোমবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা
লাইফ স্টোরি

এই মলম আমি পাই কোথায়?

আলিম আল রাজি

এই মলম আমি পাই কোথায়?

অর্ধেক খাওয়া চা হাত থেকে টেনে নিয়ে সড়ুৎ করে গিলে ফেলেন এরকম বড় ভাই প্রায় সবারই থাকেন। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছিলেন টেনিদা, আমার আছেন রফিক ভাই। টেনিদার সঙ্গে রফিক ভাইয়ের পার্থক্য হচ্ছে, টেনিদার ছিল ইয়া লম্বা নাক আর রফিক ভাইয়ের নাক একদম ছোট্ট। শৈশব থেকে শাসনের ওপর রাখছেন রফিক ভাই। শাসন না বলে মধুর অত্যাচার বলাই ভালো। বলতে লজ্জা নেই, এই অত্যাচারকে আমি কিছুটা ভয় পাই। বড় হয়ে গেছি, এখনো ভয় পাই।

গত মাসের শুরুর দিকের ঘটনা। মোবাইলে রিংটোন বাজছিল। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি ‘রফিক ভাই কলিং’। ভয় নিয়ে ফোন ধরলাম। সেই চিরচেনা ধমকের সুরে রফিক ভাই বললেন, ‘চামড়ার দাগ উঠানোর ওষুধ দে’।

আমি বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হইলো ভাই? জখম টখম হই নাই তো? দাগ পড়লো ক্যামনে’?

রফিক ভাই আবার আমাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন, ‘এতো জেনে কী করবি? তোরে ওষুধ দিতে বলছি, ওষুধ দে’। অগত্যা আমি বাধ্য হয়ে একটা উপায় বাতলে দিলাম। এই উপায়ে যদিও কাজ হওয়ার সম্ভাবনা কম। বললাম, ‘মসুর ডাল বেটে প্রতিদিন রাতে দাগের ওপর লাগিয়ে রাখবেন। উপকার পাবেন’। রফিক ভাই, ‘আচ্ছা’ বলে ফোন রেখে দিলেন। আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

১৫ দিন পর আবার ফোন। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রফিক ভাই বলতে থাকলেন, ‘কী ওষুধ দিলি? কী ঘোড়ার ডিমের ডাক্তার হইছোছ? দাগ উঠার তো কোনো লক্ষণ নাই’। আমি মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কীসের দাগ একটু বলবা? কবে পড়ছে দাগ? কেন পড়ছে? কত বড়’? আমাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন রফিক ভাই। বললেন, ‘চুপ কর গাধা। বেশি বড় ডাক্তার হয়ে গেছিস? ওষুধ দিতে বলছি দে। এতো প্রশ্ন করিস না’। আমি চুপসে গেলাম। আরেকটা ওষুধের নাম বলে ফোন রেখে দিলাম।

কিন্তু আমার মাথা থেকে চিন্তা গেল না। রফিক ভাই যে ধরনের মানুষ, আমার ধারণা কিছুদিন পর আবার চেপে ধরবেন। ধারণা সত্যি হলো। এবার রফিক ভাই ফোন না, সোজা চেম্বারে হাজির। হুড়মুড় করে ঢুকে গেলেন রুমে। আমি ভেবেছিলাম রফিক ভাই কিছুক্ষণের মধ্যেই চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেবেন। কিন্তু না, আমাকে অবাক করে দিয়ে ভাই চুপচাপ লাজুক মুখে বসে রইলেন। আমি প্রশ্ন করলাম, ‘দাগ কমেনি’?

রফিক ভাই আস্তে করে আমাকে বললেন, ‘তোর এসিসটেন্টকে বের কর। গোপন কথা আছে’। আমি ইশারায় এসিসটেন্টকে বাইরে যেতে বললাম।

রফিক ভাই গলা নামিয়ে আমাকে দাগ এবং দাগবিষয়ক ঘটনার বিস্তারিত বললেন। শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল।

ঘটনা সংক্ষেপে এরকম—

কৈশোরে রফিক ভাই এক মেয়েকে পছন্দ করতেন। মেয়ের নাম ছিল নীলা। ওই মেয়েকে পটানোর জন্য হাত কেটে কনুইয়ের পাশে নীলা নামের প্রথম ইংরেজি শব্দ লিখেছিলেন ‘এন’। তারপর অনেক চন্দ্রবিন্দু। অমাবস্যা কেটে গেছে। নীলা চলে গেছে। গত মাসে রফিক ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। মেয়ের নাম পলি। বিয়ের সবকিছু ঠিকঠাক। কিন্তু সমস্যা বাধিয়ে দিয়েছে হাতের

এই ‘এন’। ‘পি’ অক্ষরের পলিকে এখন ‘এন’ এর ব্যাপারে কী ব্যাখ্যা দেবেন রফিক ভাই?

তাই ১৫ বছরের পুরনো এই দাগ তোলার মলম খুঁজছেন হন্যে হয়ে। রফিক ভাইকে বললাম, ‘মলম দিয়ে এই দাগ সরানো সম্ভব না। তুমি বরং পলিকে সব খুলে বলো’। রফিক ভাই বললেন, ‘সম্ভব না। এখন বলতে পারব না। আরেকটু আন্ডারস্ট্যান্ডিং হোক মেয়ের সাথে। তুই আপাতত সমাধান দে’। আমি বললাম, ‘সার্জারি করে ফেল’। রফিক ভাই মাথা নেড়ে জবাব দিলেন, ‘অসম্ভব। এসব ভয় পাই।’ রফিক ভাই একটু থেমে বললেন, ‘তোর তো মাথায় অনেক ফালতু আইডিয়া ঘোরে। একটা কিছু বের কর’। আমি পড়লাম কঠিন বিপদে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভাইকে বললাম, ‘এক কাজ করো, পলিকে এই ‘এন’ দেখিয়ে বইলো—

প্রিয়তমা, এই ‘এন’ কোনো রমণীর নামের অক্ষর নয়। এই ‘এন’ মানে হচ্ছে ‘নাই’। ‘নোবোডি’ও ধরতে পার। অর্থাৎ তোমার আগে আমার জীবনে কেউ ছিল না। নোবোডি। ‘তুমিই প্রথম, তুমিই শেষ’। রফিক ভাই চুপ করে কথা শুনলেন। বুদ্ধি মনে হয় পছন্দ হয়েছে। তিনি উঠে চলে গেলেন।

এক মাস পর রফিক ভাই ভাবীসহ চেম্বারে আসলেন। আমি অভিনন্দন জানালাম। রফিক ভাই বসলেন, চা খেলেন। যাওয়ার আগে একটা চোখ টিপি দিয়ে গেলেন। এই চোখ টিপির কী অর্থ কে জানে! মনে হয় বুদ্ধি কাজে দিয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর