শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা
গল্প

নক্ষত্র-সময়

বিপ্রদাশ বড়ুয়া

নক্ষত্র-সময়

অলংকরণ : আহমেদ তারেক

সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। ছিল এক মন্ত্রজানা গুরু। তিনি নক্ষত্র দেখে বিশেষ দিনে মণিরত্ন বর্ষণ করার জাদুমন্ত্র জানতেন। তখন বোধিসত্ত্ব বিদ্যাশিক্ষার জন্য সেই গুরুর শিষ্য হন।

একদিন সেই গুরু বোধিসত্ত্বকে সঙ্গে নিয়ে চেতিয়রাজ্যে গমন করেন। পথে একটি বন ছিল। সেখানে প্রেষণক নামে পাঁচশ দস্যু থাকত। তাদের উৎপাতে পথিকেরা লুটপাটের শিকার হতো। তাদের প্রেষণক বলার কারণ হলো- তারা দুইজন পথিক ধরলে একজনকে পণ নিয়ে আসার জন্য প্রেষণ বা প্রেরণ করত। বাপ ও ছেলেকে ধরলে বাপকে বলত, 'তুমি ঘরে গিয়ে পণের টাকা নিয়ে এসে ছেলেকে মুক্ত করে নিয়ে যাও।'

এভাবে মা ও মেয়েকে ধরলে মাকে পাঠিয়ে দিত। দুই ভাইকে ধরলে বড় ভাইকে পাঠিয়ে দিত। গুরু ও শিষ্যকে ধরলে শিষ্যকে পণের টাকা আনতে পাঠিয়ে দিত।

সেই দস্যুরা গুরু ও বোধিসত্ত্বকে ধরল। আর দস্যুদের নিয়ম অনুসারে গুরুকে ধরে রেখে বোধিসত্ত্বকে পণ আনার জন্য ছেড়ে দিল। বোধিসত্ত্ব গুরুকে প্রণাম করে বললেন, 'গুরুদেব, আমি দুই-এক দিনের মধ্যে পণ নিয়ে ঠিক ফিরে আসব। আর শুনুন, আমি যেমন বলছি ঠিক সে রকম করবেন। তা হলে আপনার কোনো ভয় নেই। আজ আকাশ থেকে রত্ন পড়ার বিশেষ সময় আছে। কিন্তু সাবধান, বিপদে ভয় পেয়ে সেই বিশেষ সময়ে মন্ত্র পাঠ করে রত্নবর্ষণ করাবেন না। রত্নবর্ষণ করালে আপনার এবং এই পাঁচশ দস্যুর সর্বনাশ ঘটবে।' গুরুকে এভাবে বিশেষ সাবধান করে বোধিসত্ত্ব পণ সংগ্রহ করতে চললেন।

সন্ধ্যার সময় দস্যুরা গুরুকে বেঁধে ফেলে রাখল। এদিকে পুব আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠল। ঝলমল চাঁদের আলোয় বনের গাছপালা যেন ভেসে ভেসে হাঁটছে। পাতা ও ডালের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো মাটিতে পড়ে ছেলেমেয়েদের মতো খেলছে। চি বুড়ি, গোল্লা ছুট, দাড়িয়াবান্ধা ইত্যাদি কতরকম তাদের খেলা! বোধিসত্ত্বের গুরু আকাশের তারা দেখে বুঝলেন, সেই বিশেষ সময় এসে গেছে। তখন তিনি ভাবলেন, শুধু শুধু এই কষ্ট কেন ভোগ করছি! মন্ত্রপাঠ করে রত্নবর্ষণ করলেই তো সব সমাধান হয়ে যায়! দস্যুদের পণ দিলেই তো আমি মুক্তি পেয়ে যাই! যেখানে ইচ্ছা চলে যেতে পারি।

এরকম চিন্তা করে তিনি দস্যুদের বললেন, 'তোমরা আমাকে এভাবে বেঁধে রেখেছ কেন?'

'পণের টাকা পাওয়ার জন্য', ওরা বলল।

'যদি ধন লাভই তোমাদের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে এক্ষুণি আমার বাঁধন খুলে দাও। আমাকে স্নান করে নতুন কাপড় পরতে দাও। সুগন্ধ মেখে দাও, ফুলের মালা এনে দাও। আর একা মন্ত্র পড়ার সুযোগ করে দাও। শীঘ্রই, সময় বেশি নেই।

শুনে দস্যুরা তাড়াতাড়ি তার বাঁধন খুলে দিল। সবকিছুর ব্যবস্থা করল। নতুন কাপড় আনল, গায়ে সুগন্ধ মেখে দিল, মলি্লকা ও জুঁই ফুলের মালা পরিয়ে দিল গলায়। বোধিসত্ত্বের গুরু সময় ঠিক করলেন, নক্ষত্রের যোগ ও অবস্থান দেখলেন। সঠিক সময়ে মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন, আকাশের দিকে তাকালেন। বনভূমির ঘুম ঘুম গাছপালার দিকে দেখলেন। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া পৃথিবী ও আকাশ দেখে মন্ত্রপাঠ শেষ করলেন। তারপর আকাশের দিকে তাকালেন। অমনি ঝরঝর শব্দে আকাশ থেকে রাশি রাশি রত্ন, মণি ও মাণিক্যের বৃষ্টি শুরু হলো। দস্যুরা তা কুড়াতে শুরু করল। তাদের গায়ের চাদর ভরে গেল। পুঁটলি বেঁধে নিল। বোধিসত্ত্বের গুরুও তাদের পেছন পেছন চলতে শুরু করলেন।

কিন্তু কি বিচিত্র খেলা! একটু পরে অন্য পাঁচশ দস্যু এসে তাদের ধরে ফেলল। তখন প্রথম দস্যুদল দ্বিতীয় দস্যুদলকে বলল, 'তোমরা আমাদের ধরলে কেন?'

'ধন পাওয়ার জন্য।'

'যদি ধন পেতে চাও, তবে এ লোকটিকে ধর। ইনি আকাশের দিকে তাকালেই রত্নবৃষ্টি হয়। আমাদের কাছে যে ধনরত্ন আছে তা ইনিই দিয়েছেন।'

শুনে দ্বিতীয় দস্যুদল প্রথম দস্যুদের ছেড়ে দিল। বোধিসত্ত্বের গুরুকে ধরে বলল, 'আমাদের ধনরত্ন দাও।'

'ভদ্রগণ, তোমাদের ধনরত্ন দিতে আমার একটুও আপত্তি নেই। কিন্তু যে সময় ও নক্ষত্রযোগে রত্নবর্ষণ হয়ে থাকে, তা ফিরে আসতে এক বছর সময় লাগবে। যদি তোমরা সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা কর তাহলে তোমাদের জন্য আমি রত্নবর্ষণ করাব।' বোধিসত্ত্বের গুরু বললেন।

শুনে দস্যুরা ভীষণ রেগে গিয়ে বলল, 'তুমি খুব ধূর্ত। তুমি এইমাত্র ওদের ধনরত্ন দিলে, আর আমাদের এক বছর অপেক্ষা করতে বলছ!' তারপর সঙ্গে সঙ্গে তারা তরবারির আঘাতে তাকে দুই টুকরা করে রাস্তায় ফেলে ছুটল। তাড়াতাড়ি ছুটল প্রথম দস্যুদলকে ধরতে। ভীষণ যুদ্ধ হলো দুই দলের মধ্যে। যুদ্ধে দ্বিতীয় দলের জয় হলো। তারা প্রথম দলকে হত্যা করে তাদের ধনরত্ন দখল করে নিল। কিন্তু তখনই নিজেরা ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ঝগড়া করে দুই দলে ভাগ হয়ে গিয়ে কাটাকাটি মারামারি আরম্ভ করল। তাতে ২৫০ জন নিহত হলো। তারপর বেঁচে যাওয়া দস্যুরা আবার দুই দলে ভাগ হয়ে মারামারি শুরু করল। এভাবে মারামারি কাটাকাটি করতে করতে তাদের মধ্যে দুই জন বেঁচে গেল। এক হাজার দস্যুর মধ্যে অন্য সবাই মারা পড়ল।

দুই দস্যু তখন সব ধনরত্ন নিয়ে এক গ্রামের কাছাকাছি জঙ্গলে লুকিয়ে রাখল। তারপর একজন দস্যু তা পাহারা দেওয়ার জন্য তরবারি হাতে বসে রইল। অন্যজন চাল-ডাল জোগাড় করে রেঁধে আনতে গ্রামের দিকে চলল।

যে দস্যুটি বসে বসে ধন পাহারা দিচ্ছিল সে ভাবছিল নানা কথা। ভাবল, এতগুলো ধনরত্নের মালিক মাত্র ওরা দুই জন! জীবনে এত বড় সুযোগ আর কোনো দিন আসেনি। ভবিষ্যতেও কোনো দিন আসবে কিনা সন্দেহ! আমার সঙ্গী ফিরে এসে এর অর্ধেক নেবে। কিন্তু তাকে না দিয়েও তো আমি একা এর মালিক হতে পারি। তাকে না দিয়ে সে আসামাত্র তাকে এই তরবারির এক কোপে শেষ করে ফেলি না কেন?

এই ভেবে সে তরবারিটা খাপ থেকে খুলে রাখল। তার আসার অপেক্ষায় বসে রইল। এদিকে যে ভাত রান্না করে আনতে গিয়েছিল সে-ও ভাবছিল সব ধনরত্ন কী করে একা ভোগ করা যায়। ভাবল, অর্ধেক ধন তো দেখি আমার সঙ্গী নেবে। কিন্তু ভাতে যদি আমি বিষ মিশিয়ে দেই, তাহলে সে খাওয়ামাত্র মরে যাবে। আমি একাই সব ধন ভোগ করব।

এই ঠিক করে সে নিজের অংশ খেয়ে নিল। বাকি অংশে বিষ মিশিয়ে সঙ্গীর কাছে ফিরে এলো। সে হাত থেকে ভাতের পুঁটলি নামিয়ে রাখতেই অন্য দস্যু তরবারির এক কোপে তাকে দুই টুকরা। তারপর দুই টুকরা শরীর ওপাশের ঝোপে লুকিয়ে রাখল। তার পেটে তখন ভীষণ খিদে। অমনি সে শুরু করল খাওয়া। গোগ্রাসে গিলতে লাগল। মরতেও সময় লাগল না। সেই ধনরত্নের জন্য বোধিসত্ত্বের গুরু একা নয়, এক হাজার দস্যুও শেষ।

বোধিসত্ত্ব তার কথা মতো দুই দিন পর ধন সংগ্রহ করে ফিরে এলেন। তিনি দেখলেন তার গুরু সেখানে নেই। দস্যুরাও নেই। চারদিকে ধনরত্ন পড়ে আছে। এতে তার মনে সন্দেহ ও ভয় হলো, তার গুরু সম্ভবত উপদেশ না শুনে রত্নবর্ষণ করিয়েছেন। আর তাতেই সবার মৃত্যু হয়েছে। তিনি তখন রাজপথ দিয়ে চলতে লাগলেন এবং গুরুর দুই টুকরা শরীর দেখতে পেলেন। 'হায়, আমার কথা না শুনে গুরু জীবন হারালেন।' এরকম বিলাপ করতে করতে কাঠ জোগাড় করে চিতা সাজালেন। তারপর চিতায় আগুন দিয়ে দাহ কাজ শেষ করলেন। বনফুল দিয়ে বাকি কাজ সমাপ্ত করলেন। তারপর আরও এগিয়ে গিয়ে প্রথম দস্যু দলের পাঁচশ শব দেখতে পেলেন। অদূরে গিয়ে দেখলেন ২৫০ জনের মৃতদেহ। আরও কিছুদূরে গিয়ে যেখানে বাকি ২৫০ জনের লড়াই হয়েছিল সেখানে পৌঁছলেন। সেখানে মৃতদেহ গুনে দেখে পেলেন ২৪৮ জনের লাশ। তারাও একে অন্যের সঙ্গে বিবাদ করেছে, লড়াই করেছে তা বুঝতে পারলেন। কিন্তু বাকি দুইজন কোথায় গেল? ভাবতে ভাবতে কিছুদূর গিয়ে দেখতে পেলেন রাজপথ থেকে একটি পথ বের হয়ে গ্রামের পাশের জঙ্গলের দিকে গেছে। এই পথ ধরে তিনি জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়লেন।

সেখানে দেখতে পেলেন এক জায়গায় পুঁটলিতে বাঁধা রাশি রাশি রত্ন পড়ে রয়েছে। আর অদূরে একজন দস্যুর মৃতদেহ এবং তার পাশে কলাপাতার পুঁটলি-খোলা ভাত এলোমেলো পড়ে আছে। দেখার সঙ্গে সঙ্গে বোধিসত্ত্ব সব বৃত্তান্ত বুঝতে পারলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে বাকি একজন দস্যুর খোঁজ শুরু করলেন। খুঁজতে খুঁজতে পাশের এক ঝোপে তার দুই টুকরা শব দেখতে পেলেন।

বোধিসত্ত্ব ভাবলেন, তাহলে দেখছি আমার কথা না শুনে গুরুদেব নিজেও মরলেন আর এক হাজার দস্যুর প্রাণও গেল।

[জাতকের কাহিনীর পুনর্কথন। তিন হাজার বছর আগের কাহিনী]

 

 

সর্বশেষ খবর