শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা
গল্প : এলিসিও দিয়েগো

সাধ পূরণ না পূরণের গল্প

রূপান্তর : বজলুল করিম বাহার

সাধ পূরণ না পূরণের গল্প

জন্মান্ধ ছিল লোকটি। এ সড়কটি তার চেনা। এ পথ দিয়েই তাকে হেঁটে যেতে হয়। লাঠি ঠুকে ঠুকে পথের মসৃণতা মেপে। একদা যাওয়ার সময় পায়ে ঠোকা লেগেছিল সেই বস্তুটি। কুড়িয়ে পায় এক চারকোণা জিনিস। হাতের স্পর্শে বস্তুটির স্বরূপ বুঝতে না পারলেও ঝোলায় পুরেছিল সেটি। তখন মনে হয়েছিল এটি তার নিজেরই একটি জিনিস। এ স্বাতন্ত্র্যবোধ তাকে পুলকিত করে।

মাঝে মাঝে জিনিসটির গায়ে হাত বুলাতে তার ভালো লাগত। কল্পনায় নানা কিছু ভেবে স্বস্তি পেত। অন্ধের এক বধির বন্ধু ছিল। বধির সেই লোকটি মাঝে মাঝে তার কাছে আসত। তখন তারা মন খুলে নিজেদের কথা বলে সুখী হতো। অন্ধ সে জিনিসটি বধিরকে দেখাল। বধির সেটি দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, 'বাহ, কী আশ্চর্য, ভারি চমৎকার একটি খেলনা! লাল টুকটুকে। দেখি দেখি।' অন্ধ জবাবে বলে উঠল, 'দেখ দেখি, ওটি যে খেলনা, আমি কী তা বুঝেছি? আবার রঙিন, না জানি কত সুন্দর। আমার কি ভাগ্য যে, তোমাকে ওটি দেখাতে পেরেছি।' বধির ওটি হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখে উল্লাসে বলে ওঠে, 'আরে এ তো দেখছি তিনটি মেয়ের মূর্তি! কী রূপ মেয়েগুলোর! পরীর মতো!' অন্ধ সোৎসাহে খেলনাটিতে আঙ্গুল বুলায়। মেয়েগুলোর রূপ ও কোমলতা অনুভব করার জন্য আগ্রাসী হয়। এদের কখনো নিজের মতো করে না পাওয়ার জন্য বিষণ্ন হয়।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ওই খেলনাটি বধির বন্ধুকে দিয়ে দেয়। বলে, 'ওটি তোমার কাছেই থাক। আমার কাছে থাকা আর অন্ধকারে পড়ে থাকা একই জিনিস।'

বধির বাড়ি ফিরে এসে একসময় খেলনাটি দেখতে গিয়ে ওতে একটি স্প্রিং আবিষ্কার করে। চাপ দিতেই রূপসীরা অপূর্ব ভঙ্গিতে হেলেদুলে নাচতে শুরু করে। এক ধরনের শুভ্রতা ছড়িয়ে পড়ে তখন।

কিন্তু তার এই সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। এদের নিজের করে কখনো না পাওয়ার বেদনায় সে তার এক বন্ধুকে খেলনাটি দিয়ে দেয়। বন্ধু ওটি দেখে বিস্মিত হয়। স্প্রিংয়ে চাপ দিতেই শুরু হয় সেই মোহন নাচ। আর ওই খেলনা থেকে বাজতে থাকে এক অপূর্ব সুরের সিম্ফনি। এ নৃত্য ও সুরের অভিঘাতে তার মধ্যে এক অদ্ভুত উদ্দীপনা জাগে। প্রেমের এমন শরীরি আহ্লাদের আগে সে কখনো অনুভব করেনি। ভালো লাগে বড় ভালো লাগে তার। কিন্তু এ রোমান্টিক আবেগ পরক্ষণেই মিলিয়ে যায়। এই তিন অপ্সরীকে কখনো নিজের করে না পাওয়ার বিষাদ তাকে এতটাই আচ্ছন্ন করে যে, মন কেমন করে ওঠে। কোনো কিছুই আর ভালো লাগে না। সাধ অপূর্ণ থাকার কষ্টে সে ওই খেলনাটিকে ওই এলাকার এক জ্ঞানী লোকের কাছে সমর্পণ করে। জ্ঞানী লোকটি ওই খেলনার চমৎকরিত্ব দেখে খুশি ও বিস্মিত হয়।

নিঃসঙ্গ মুহূর্তে ওটি বের করে। লক্ষ্য করে তিন রমণীর রূপের পশরা, শুনতে পায় তিন নারীর জন্য নিবেদিত কাসিদা, সুরের মনকাড়া শব্দ। যেন কোনো নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ তিনি অনুভব করছেন। হঠাৎ এই তিন রমণীর পরিচয় তিনি আবিষ্কার করেন।

এরা হচ্ছেন গ্রিক পুরাণের স্বর্গের তিন দেবী। সৌন্দর্যের অধিষ্ঠাত্রী। নক্ষত্রের বুক থেকে এরা পৃথিবীতে এসে সুন্দরতা ছড়ায়। প্রেমময়। সৌন্দর্যপিপাসু মানুষ যুগে যুগে এসব দেবীর প্রতীক্ষায় থেকেছে। কত যে প্রবাদ কিংবদন্তি রচিত হয়েছে এদের ঘিরে। তিনি মগ্ন হয়ে দেখেন এই রূপ। অনুভব করেন পরিব্যাপ্ত হওয়া সুর। সব মিলে যেন নিজের অস্তিত্বেরই অসহ্য এক দেবায়ন। তিনি সুখী হোন। স্বস্তিতে তার মন ভরে ওঠে।

আনন্দের অগ্ন্যুৎসারে বহুকাল পর আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠেন। কিন্তু তার পরক্ষণেই মনে হয় বড় ক্ষণস্থায়ী এই অনুভূতি। নিজের করে কখনো এদের পাওয়া সম্ভব নয়। অপ্রাপ্তির এই বোধ তাকে ম্রিয়মাণ করে তোলে। ইচ্ছা পূরণ না হওয়ার বেদনায় দুঃসহ ক্লান্তি বোধ করতে থাকেন। ক্রমেই অবসন্ন হয়ে পড়েন। এর কিছুকাল পরই তার মৃত্যু হয়। স্বর্গীয় সেই মোহন রূপ ও সৌন্দর্য নিজের অধিগত করতে না পারার বিষাদ তার মলিন মুখমণ্ডলে তখনো লেগে ছিল।

পাদটীকা : এলিসিও দিয়েগো কিউবার প্রখ্যাত কবি ও গল্পকার। জন্মেছিলেন হাভানায়। লিখেছেন বেশ কিছু প্রতীকী গল্প। লঘু চালে। উইট ও হিউমার দিয়ে রচিত এ গল্পগুলো পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে।

 

 

সর্বশেষ খবর