শুক্রবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

‘বাঁকা জল’ : বাস্তবতায় হোঁচট খাওয়া উপন্যাস

হরিশংকর জলদাস

‘বাঁকা জল’ : বাস্তবতায় হোঁচট খাওয়া উপন্যাস

‘বাঁকা চোখ বুঝি, বাঁকা উঠান বুঝি, বাঁকা কথাও বুঝি। কিন্তু বাঁকা জল তো বুঝছি না। বাঁকা জলও হয় নাকি?’ ঠোঁট একটু বাঁকা করে জিজ্ঞাসা করেছিল সুনীতা। আমি কপালটা একটু বাঁকা করে বলেছিলাম, “হয় গিন্নি, হয়। বাঁকা মনের মতো বাঁকা জলও হয়। নইলে কি আর ইমদাদুল হক মিলন তার উপন্যাসের নাম রাখেন ‘বাঁকা জল’?” স্ত্রী আমার কথার কী মানে বুঝল কে জানে। কিছুক্ষণ ঝিম ধরে লেখার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর মৃদুস্বরে বলল, “কী জানি বাপু, তোমরা সাহিত্যিকরা কিসের মধ্যে যে কী টেনে আন, বুঝতে পারি না। কোন বিশেষ্যর আগে কোন বিশেষণ বসবে, আগে তার একটা ঠিকঠিকানা ছিল, এখন সব ছেঁড়াবেড়া। এখন তোমরা লিখছ ‘ভয়ংকর সুন্দর’, ‘অসম্ভব রূপসী’, ‘ভীষণ ভালোবাসি’- এসব। মিলনদা লিখলেন ‘বাঁকা জল’ নামের উপন্যাস।” ঠোঁটে একটু বক্র হাসি ছড়িয়ে গৃহান্তরে গেল সুনীতা।

আমি স্বগত কণ্ঠে বললাম, জলের গতি-প্রকৃতি মিলন ভালো করে জানতেন। জলাবর্ত, জলতরঙ্গ, জলোচ্ছ্বাস, জলস্ফীতি, জলকল্লোল, জলপ্রবাহ, জলপ্লাবন, জলধারা, জলস্রোত, জলপান, জলকর, জলকাদা, জলপড়া, জলকেলি, জলপথ, জলটুঙ্গি, জলপট্টি, জলপিপি, জলক্রীড়া, জলখাবার, জলঢোঁড়া, জলপ্রপাত, জলকন্যা, জলবিছুটি, জলহস্তী, জলহাওয়া, জলাশয়, জলে পড়া, জলে ফেলা, জলে যাওয়া- এসবের অর্থ জানেন মিলনদা। জলদস্যু আর জলদাস যে সমগোত্রীয়, এটাও বোঝেন। পানীয় জল, খর জল, নরম জল, নোনা জল, লেবুর জল, বৃষ্টির জল, বদ্ধ জল- শব্দগুলোর মানে মিলনের নখদর্পণে। তা ছাড়া রবীন্দ্রনাথকে তো তিনি ভুলে যাননি। দশজন সাধারণ বাঙালির চেয়েও রবীন্দ্রনাথকে বেশি করে পড়েছেন ইমদাদুল হক মিলন। ‘সোনার তরী’ কোন বাঙালির না পড়া? মিলনের তো পড়া থাকবেই। ভরা বর্ষার বিবরণ দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-

‘গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।

ক‚লে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।

রাশি রাশি ভারা ভারা ধান কাটা হল সারা,

ভরা নদী ক্ষুরধারা খরপরশা-

কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।’

এই ‘সোনার তরী’ কবিতার দ্বিতীয় স্তবকের শুরুটা এ রকম-‘একখানি ছোট খেত আমি একেলা-/চারিদিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।’

এই কবিতায় দুটো অনুষঙ্গ ঘুরেফিরে এসেছে- ধান আর জল। মিলন যখন জলের কথা নিয়ে উপন্যাস লিখতে বসলেন, ‘সোনার তরী’র কথা ভুললেন না। নামকরণে তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে হাত পাতলেন। ‘চারিদিকে বাঁকা জল করিছে খেলা’- এই পঙক্তিটি থেকে ‘বাঁকা জল’ শব্দগুচ্ছটি গ্রহণ করলেন।

ইমদাদুল হক মিলন উপন্যাসের নামটা নিলেন বটে রবীন্দ্রনাথ থেকে, কিন্তু এক ঘোরলাগা কাহিনী তৈরি করলেন ‘বাঁকা জলে’। প্রতিটি বাক্য বাক্সময়। বিশেষ করে তিনি যখন প্রকৃতির বর্ণনা লেখেন, বাক্যের প্রতিটি শব্দ কথা বলে ওঠে। এক বালকের স্বপ্নসাধের কাহিনী ‘বাঁকা জল’। অনেকটা পিতা-মাতা পরিত্যক্ত হয়ে বালকটি নানাবাড়িতে মানুষ হচ্ছে। নানা নেই, নানী আছে। নানীকে সে বুজি ডাকে। আর আছে ঝুনু খালা। ঝুনু খালা অবিবাহিত। আছে ফতির মাও। বুজির ঘরকন্নার সাহায্যকারী। কাছে-দূরে অন্যান্য আত্মীয়স্বজনও আছে। সে সবাইকে নিয়ে আছে, সবাইও তাকে নিয়ে আছে। কিন্তু সবাই তাকে নিয়ে থাকলেও সে যেন কারও নয়। সে নিঃসঙ্গ। সে পাখির সঙ্গে কথা বলে, গাছের সঙ্গে তার যত বন্ধুত্ব। সে অবাক চোখে জল দেখে, জলে ডোবা ধানক্ষেত দেখে, ঘরবাড়ি, সূর্যের আলো, দিনশেষের পাখি, দিগন্ত থেকে ভেসে আসা হাওয়া, ঘাসফড়িং- এসব দেখে দেখে নিজের ভিতরে আলাদা একটা জগৎ তৈরি করে। সেই জগতে সে নিজে ছাড়া অন্য কোনো মানুষ নেই। সে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে, নিজের ভিতরে তারই মতো অন্য এক বালকের অস্তিত্ব টের পায়। সেই বালককে সে অনুভব করে, কিন্তু সেই অনুভ‚তির রহস্য উদঘাটন করতে পারে না। লেখক অসাধারণ দক্ষতায় সেই বালক মনের একটা বাতাবরণ তৈরি করেন। সেই বাতাবরণে কোনো গুরুপনা নেই। একজন স্বল্পবয়সী বালক যে পরম চোখে ফুল-পাখি-জল-মানুষকে দেখে, ঠিক সেই চোখেই দেখেছেন মিলন। যারা লেখালেখি করেন তারা জানেন, ছোটদের চোখে দেখা পৃথিবীর বর্ণনা দেওয়া কত কঠিন। সেই কাঠিন্যকে তরল-সরল করার করণকৌশল মিলনের সম্যকভাবে জানা।

ধানের সঙ্গে জলের সম্পর্ক, জলের সঙ্গে বর্ষার। কিন্তু এই উপন্যাসটির কাহিনী যে ঋতুলগ্ন, তা বর্ষকাল নয়। তারপরও বালকটির নানাবাড়ির গোটা গ্রামটি জলে ডোবা। নদীতে ঢল নেমেছে। সেই ঢলের জল গাঁও-গেরামকে গ্রাস করতে বসেছে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় জল বাড়ছে উঠানে, বিলে ধানীজমিতে “সকালবেলা বুক চিতিয়ে জেগে ছিল পাথর। পাথরে দাঁড়িয়ে দোরগোড়ায় বাঁশের লম্বা কঞ্চি পুঁতে রেখেছি। কঞ্চির গাঁটে আলকাতরার দাগ দেওয়া। সেই দাগ ছাড়িয়ে জল উঠেছে অনেক দূর।” জল বাড়ায় অন্যের মনে ভয় জাগলেও গল্পকথক বালকটি শিহরিত হয়। সে মাছ নিয়ে মশগুল হয়ে পড়ে। সে ভাবে, বেনো জল ঘরের ভিতর ঢুকলে ভারি মজা হবে। নানাবাড়ির বনেদি পালঙ্কের ওপর বসে সে নানা ধরনের মাছ ধরবে। বড়শির টানে টানে উঠে আসবে পুঁটি, টেংরা, টাকি, গোলসা, বেলে, বাইন, কই, শিং, মাগুর।

বাংলাদেশে কত মিঠা পানির মাছ- রুই, রোহিত, কাতলা, তেলাপিয়া, মদ্গুর, চিতল, বোয়াল, ফলি, পারশে, মৃগেল, রয়না, ভেদা, আড়, বেলে, মৌরলা, চাপলে, তপসে, চিংড়ি, শোল, বাঁশপাবদা, বাঁশপাতা, কাজলি, শফরী, খলসে- আরও কত কত! এত সব মাছের নাম তো আর উপন্যাসে উল্লেখ করা যায় না। উল্লেখের দরকারও নেই। ওই গাঁয়ে যে মাছগুলো পাওয়া যায়, সে মাছগুলোর নামই উল্লেখ করেছেন উপন্যাসকার। কিন্তু বিস্মিত হতে হয় তখনই, যখন মিলন মাছদের খাদ্য গ্রহণের বিবরণ দেন। তীক্ষè পর্যবেক্ষণ-শক্তি আর অসাধারণ একটা বালকবেলা না থাকলে এবং সেই বালকবেলার অধিকাংশ সময় খালেবিলে মাছ ধরায় না কাটালে এ রকম বিবরণ লেখা অসম্ভব। ইমদাদুল হক মিলনের তীব্র পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতা আছে এবং ঐশ্বর্যময় একটা বালকবেলা ছিল। তাই তো তিনি লিখতে পেরেছেন মাছদের এ রকম খাবার কৌশলের নিবিড় বিবরণটি। বালকটির মুখ দিয়েই বলিয়েছেন তিনি- ‘শুনেছি বন্যার জল ঘরে ঢুকলে রাজ্যের মাছ এসে ঢোকে ঘরে। ঘরের মেঝেতে নাকি মাছের নানা রকমের খাদ্য থাকে। তারা আসে খাদ্যের লোভে। মানুষের নিত্যদিনের খাবারের কোনাকানি খেতে আসে পুঁটি টেংরা বেলে; কেঁচো খেতে আসে কই শিং মাগুর টাকি। ব্যাঙ কিংবা ইঁদুর খেতে আসে অতিকায় শোল গজার বোয়াল। তবে তারা সব দামি মাছ। রাতের অন্ধকার ছাড়া ঘরে ঢোকে না।’

জলভরা ধানক্ষেতে চাঁই ফেলে মাছ ধরার এক অদ্ভুত বিবরণ দিয়েছেন লেখক। এ এক তড়িৎসম্পর্কিত বর্ণনা। এই বর্ণনা এমন নিখুঁত এবং বাল্যস্মৃতি-জাগানিয়া যে, যে কোনো পাঠক, তিনি যদি ফুল-পাখি ধানক্ষেত নদীর গাঁয়ে জন্মান এবং বাল্যকালটা গায়ে কাটান আর খালবিলের জলে দুরন্তপনা করেন, শিহরিত হবেন। আমি হয়েছি। আমার যে জলজীবন, তার প্রথম দিকের সময়টাকে ছুঁতে পারি মিলনের এই মাছ ধরার বর্ণনায়। শুধু জলতলে চাঁই ফেললে হবে না, মাছদের ভাতুর করে তুলবার জন্য প্রয়োজন মৃত ফড়িং। এই ফড়িংগুলো শলায় গেঁথে চাঁইয়ের ভিতর আটকে দিতে হয়। সব ধরণটা লেখকের অভিজ্ঞতায় ধরা আছে। ওই যে কোনো কোনো মনীষী বলেছেন না, লেখক সারাটা জীবন শুধু একটা জীবনের কাহিনী লিখে যান। নানা কায়দায়, নানা প্রকরণে। কখনো কখনো হয়তো কিছু উপকাহিনী এসে যুক্ত হয় মূল কাহিনীর সঙ্গে। তাতে মূল কাহিনীপ্রবাহে কোনো বিঘœ সৃষ্টি হয় না। মিলনের উপন্যাসেরও একই অবস্থা। গোটা জীবন তিনি একটি কাহিনী লিখে গেছেন, সেটা নিজেরই জীবনকাহিনী। ‘বাঁকা জল’-এর এই যে বালকটা, মিলন ছাড়া আর কেউ নন। বালকটির ভিতরে মিলন বসে আছেন। বালকটির চোখ মিলনের চোখ, বালকটির মন শৈশবের মিলনের মন। তার বালকবেলার অভিজ্ঞতাগুলো এই উপন্যাসের পরতে পরতে বর্ণিত হয়েছে। জানি না, নানাবাড়িতে মিলনের বালকবেলা কেটেছে কিনা, যদি না-ও কাটে, খাল বিল জল ডোবা মাছ ফড়িংয়ের এক অসাধারণ জগৎ ছিল মিলনের জীবনে। ফড়িং আর চাঁই দিয়ে মাছ ধরার অপূর্ব বিবরণ আছে ‘বাঁকা জলে’। হাফেজ মামার সঙ্গে বালকটি বর্ষার ধানক্ষেতে চাঁই বসাতে গেছে। তার এক দারুণ বিবরণ- ‘চাঁই পাততে বিলের দিকে গেলেন না হাফেজ মামা। ধানফড়িং ধরা শেষ করে অনেকক্ষণ ধরে ঝাড়–র শলায় চারটা-পাঁচটা করে ফড়িং গাঁথলেন। চাঁইয়ের ভেতর হাত ঢুকিয়ে কায়দা করে আটকে দিলেন ফড়িংশলা। কোন ফাঁকে প্রতিটি চাঁইয়ের বুক বরাবর বেঁধেছেন খয়েরি রঙের নুন সুরু কাতা, আমি টের পাইনি। শেষ বিকেলের ম্লান আলোয় নিজের বাপ-চাচাদের ধানীজমির বিভিন্ন জায়গায় পাততে লাগলেন চাঁই।’ এই রকম অসাধারণ বর্ণনার জন্যই উপন্যাসটির কোনো কোনো অংশ কবিতা হয়ে উঠেছে। ‘বাঁকা জল’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। মিলনের ৩৮ বছর বয়সের রচনা এটি। ৬৪ পৃষ্ঠার চটি উপন্যাস। ২৮ পৃষ্ঠা পর্যন্ত জল আর প্রকৃতির বর্ণনা। ফাঁকে ফাঁকে বুঝি হাফেজ মামা, ঝুনু খালা আর গল্পকথক বালকটির কথা। জল মাছ ধানক্ষেত ফড়িং কোষা ঘরবাড়ি বন্যা- এসবের বিবরণ দিতে দিতে ২৮টি পৃষ্ঠা শেষ হয়ে যায়। তার মধ্যে আমরা জেনে যাই, কথক বালকটির নাম মিলু। তার মা আছে, বাবা আছে, ভাইবোনও আছে। থাকে ওরা ঢাকায়। শুধু মিলু থাকে গ্রামে, নানাবাড়িতে।

২৯ পৃষ্ঠায় এসে কাহিনী উঁকি দেয়। উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য রহস্যময়তা, ব্যক্তিজটিলতা, অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতি, ঔৎসুক্য- এসব। ২৯ নম্বর পৃষ্ঠার সূচনাতেই রহস্যময়তা ও ব্যক্তিজটিলতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখানে এসেই যেন শ্লথ পায়ে এগিয়ে চলা কাহিনীটি বাস্তবতার রূঢ় পাথরধাক্কা খেল। কাহিনী-রহস্য একটি বিশেষ মাত্রা পেয়ে যায়, যখন গভীর রাতে নানাবাড়ির শোবার ঘরের জানালায় খোকা দাদা নামের এক তরুণ ঠুকঠুক করে টোকা দেয় এবং খালা ও বুজির মধ্যে মনোমালিন্য হয় ওই রহস্যময় খোকা দাদাকে নিয়ে। মা-মেয়ের রাগ-অভিমানের কথা বলতে গিয়ে লেখক লেখেন, “সংগোপনে কোনও বেনো জল ঢুকে গেছে দুজন মানুষের মাঝামাঝিখানে। বাঁকাচোরা হয়ে কেমন করে বইছে সে জল। ‘বাঁকা জল’ উপন্যাসের কাহিনী সামান্য ঝুনু আর খোকা নামের দুই তরুণ-তরুণীর মন দেওয়া-নেওয়া। দুই বছর আগে এক শীতসকালে খোকা এলো বুজির বাড়িতে। বুজি নিজ কন্যা ঝুনুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে, ‘এ খোকা। আমার দূরসম্পর্কের মামাতো ভাইয়ের ছেলে। কলেজে পড়ে।’ তার সঙ্গে মেলামেশার স্বাধীনতা ছিল ঝুনুর। তাতেই ভাবসাব। বুজি তক্কে তক্কে ছিল, সুযোগে খোকার সঙ্গে ঝুনুর বিয়ে দেবে। উল্লেখ্য, এই কাহিনীর পটভ‚মি একাত্তর-পূর্ববর্তী। কলেজে পূর্ব পাকিস্তানি ছাত্রের হাতে পশ্চিম পাকিস্তানি একজন ছাত্র মারা যায়। খুনিদের তালিকায় খোকার নামটিও উঠে যায়। সেই থেকে পালানোর জীবন শুরু হয় খোকার। কিন্তু সে তো খুন করেনি। তারপরও পুলিশ তাকে খুঁজে বেড়ায়। এক রাতে খোকা এসে আশ্রয় নেয় ঝুনুদের বাড়িতে। ঝুনুর মা বুজি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে- খোকার সঙ্গে ঝুনুকে বিয়ে দেবে না। খুনির সঙ্গে কোন মা আত্মজাকে বিয়ে দিতে চায়। কিন্তু প্রেমের বেনো জল তো তখন ঝুনুর মনের পরতে পরতে। মায়ের কথা সে মেনে নেবে কেন? মাকে সে বোঝায় খোকা খুন করেনি, চক্রান্তের শিকার সে। মা বিশ্বাস করে না। মা খোকাকে অপমান করে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলে।

খোকা ঝুনুদের বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় বলে যায়, থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করবে। ফাঁসি হলে ফাঁসি হোক তার। এই ফাঁসি ঝুনুর মায়ের অপমানের চেয়ে শ্রেয়। সেই রাতে ঝুনু আত্মহত্যা করে।

সারা গাঁয়ে হৈচৈ পড়ে যায়। দলে দলে লোক আসে দেখতে। ঝুনুর তখন জিব বেরিয়ে আছে বিঘতখানেক, চোখ ঝুলে আছে খল্লা মাছের চোখের মতো। এসব দৃশ্য মিনু নামের অল্পবয়সের একজন বালকের চোখ দিয়ে দেখা। এই উপন্যাসে বুজি দেখে তার কন্যার ভবিষ্যৎ আর কন্যা দেখে তার প্রেমের ভবিষ্যৎ। একটা সময়ে ঝুনুর মনে হয়, খোকাবিহীন জীবনের কোনো মূল্য নেই। তাই আঁচল পেঁচিয়ে প্রাণ দেয় সে।

উপন্যাসের শেষদিকে ফতির মা নামের অতি নিরীহ প্রায় বোবা মহিলাটি ঝলসে ওঠে। গোটা উপন্যাসে রান্নাবান্নায় সহযোগিতা করা আর তামুক খাওয়া ছাড়া যে ফতির মা কিছুই করেনি, বলা যায় পাঠকের দৃষ্টিসীমার মধ্যেই আসেনি, সেই ফতির মা একঝটকায় লাইমলাইটে চলে আসে। যে কথাটি অন্য দশজনে বলতে সাহস পায়নি, সেই সত্য কথাগুলো গল্প নিয়ে জনসম্মুখে বলে গেছে ফতির মা। বুজি যখন কন্যা ঝুনুর আত্মহত্যার ঘটনাটি বারবার ঢাকতে চাইছে, তখন ফতির মা বলে উঠেছে-‘চুপ করো তুমি শয়তান মাইয়া ছেইলে। জানো না, জানো না তুমি, কেন জান দিছে তোমার মাইয়া। এর লেইগা তুমি দায়ী। তোমার লাইগা গলায় ফাঁসি দিছে ঝুনি।... নিজের আত্মীয় দেইখা, ভাল বংশের পোলা দেইখা খোকারে তুমি বাড়িতে আনছিলা। তুমি চাইছ খোকার লগে ঝুনুর বিয়া হোক। ঝুনুরে ইচ্ছা কইরা খোকার লগে মিলামিশা করতে দিছ। মাইয়াডা যহন মন দিয়া দিছে, তহন তুমি হোনচ খোকা হইল খুনের আসামি। তহনে তুমি বেইকা বইছ। নিজে মাইয়া হইয়া একটা মাইয়ার মন বোঝ নাই। জানো না কোন কোন মাইয়া একবার কেঐরে মন দিলে সেই মন আর ফিরাইয়া নিতে পারে না।’

‘বাঁকা জল’ প্রথমদিকে পড়তে পড়তে পাঠকের মনে একটা নিবিড় প্রকৃতিলীনতা লাগে। জল্লাত গাঁও-গেরামকে দেখার গভীর একটা ঔৎসুক্য সৃষ্টি হয় পাঠকের মনে। সেই প্রকৃতিমগ্ন জলধোয়া মনটায় প্রচণ্ড একটা ধাক্কা লাগে ঝুনুর আত্মহত্যায়। খোকার আগমনে কাহিনীতে যে একটা রহস্যঘেরা আবেশের সৃষ্টি হয়, পাঠক যখন তৈরি হতে থাকে আরও বেশি মগ্নতায় নিমজ্জিত হতে, লেখক আচমকা একটা ধাক্কা দেন। ঝুনুর আত্মহত্যার জন্য পাঠক মোটেই প্রস্তুত নয়। পাঠক আশা করে, খোকা বেকসুর খালাস পাবে, আবার ফিরে আসবে ঝুনুর কাছে। ঝুনু তখন মাথায় তেল ঘষে চুল আঁচড়াবে, ভালো শাড়ি পরবে, গায়ে আতর মাখবে, চোখে কাজল দেবে। এ-ই যখন পাঠক আশা করে, লেখক তখন ছোট ছোট বাক্যে ঝুনুর আত্মহত্যার দৃশ্যপট নির্মাণ করেন। পাঠকের স্বপ্নপূরণের সুযোগ দেন না ইমদাদুল হক মিলন।

লেখক কী করে স্বপ্নপূরণের সোপান তৈরি করবেন। স্বপ্ন আর বাস্তবতা তো এক নয়। লেখকরা বাস্তবতার রূপকার। তারা তাদের লেখায় স্বপ্নকল্পনাকে প্রশ্রয় দেন বটে, শেষ পর্যন্ত জয় ঘোষণা করেন বাস্তবতার। ‘বাঁকা জল’ উপন্যাসে ইমদাদুল হক মিলনও তার ব্যতিক্রম নন।

সর্বশেষ খবর