শুক্রবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সাহিত্যকর্ম

সাহিত্য ডেস্ক

শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সাহিত্যকর্ম

শহীদ মুনীর চৌধুরী [জম্ম : ১৯২৫-১৯৭১]

শহীদ মুনীর চৌধুরীর জম্ম ১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর মানিকগঞ্জ শহরে। তার পৈতৃক নিবাস নোয়াখালী জেলায়। পিতা খানবাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরী ছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। মুনীর চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি (১৯৪৭), বাংলা ভাষা ও সাহিত্য (১৯৫৪) এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্বে (১৯৫৮) স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি খুলনার ব্রজলাল কলেজ (বিএল কলেজ)-এ অধ্যাপনার (১৯৪৭-৫০) মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ (১৯৫০) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ও বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন। তিনি শিক্ষা ও পেশাগত জীবনে বামপন্থি রাজনীতি ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ঢাকার প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ, কমিউনিস্ট পার্টি, ভাষা আন্দোলন ইত্যাদির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৮ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনে তিনি যোগদান করেন এবং ওই বছরেরই শেষ দিকে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ড এবং পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে সভা হয় তাতে তীব্র ভাষায় বক্তৃতা দেওয়ার অভিযোগে নিরাপত্তা আইনে সরকার তাকে বন্দী করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে গিয়ে পুলিশের ধাক্কা খেয়ে পড়ে যান। ২৬ ফেব্রুয়ারি শিক্ষকদের প্রতিবাদ সভা আহ্বান করতে গিয়ে গ্রেফতার হন ও তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এ সময় প্রায় দুই বছর তিনি দিনাজপুর ও ঢাকা জেলে বন্দী জীবনযাপন করেন। বন্দী অবস্থায় ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দীদের অভিনয়ের জন্য লেখেন ‘কবর’ নামের একাঙ্কিকা। ১৯৫৩ সালে বামপন্থি রণেশ দাশগুপ্ত জেলখানাতে ২১ ফেব্রুয়ারি উৎযাপনের লক্ষ্যে মুনীর চৌধুরীকে একটি নাটক লেখার অনুরোধ জানান। নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন হয় জেলখানার ভেতরে, যাতে কারাবন্দীরাই বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সঙ্গী কারাবন্দী অধ্যাপক অজিত গুহের কাছ থেকে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের পাঠ গ্রহণ করেন।

বাঙালি সংস্কৃতিতে শ্রদ্ধাশীল মুনীর চৌধুরী সংস্কৃতির ওপর কোনো আঘাতকে সহ্য করেননি। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকার রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধের নির্দেশ দিলে তিনি তার প্রতিবাদ জানান। পরের বছর সংস্কারের নামে বাংলা বর্ণমালা বিলোপের উদ্যোগ নেওয়া হলে তিনি তারও প্রতিবাদ করেন। মুনীর চৌধুরী সমকালীন জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গেও নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সম্পৃক্ত করেছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন তার সঙ্গে একাÍতা ঘোষণা করে তিনি পাকিস্তান সরকারের দেওয়া সিতারা-ই-ইমতিয়াজ (১৯৬৬) খেতাব বর্জন করেন। তিনি সাহিত্যচর্চায় কৃতিত্ব অর্জন করেন মূলত প্রগতি লেখক ও শিল্পীসংঘের সঙ্গে যুক্ত থাকা অবস্থায়। প্রথম জীবনে তিনি বেশ কিছু ছোটগল্প রচনা করেছিলেন, কিন্তু সেগুলো সংগৃহীত হয়নি। তার প্রধান আকর্ষণ ছিল নাটকের প্রতি। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের পটভ‚মিকায় লেখা তার মৌলিক নাটক ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’-এর (১৯৫৯) মূল চেতনায় আছে যুদ্ধবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে নরনারীর প্রেম। তার আরেকটি মৌলিক নাটক চিঠি-তে (১৯৬৬) আন্দোলনের নামে একশ্রেণির লোকের স্বার্থবোধ ও অগণতান্ত্রিক আচরণ ধরা পড়েছে। মুনীর চৌধুরী বিদেশি নাটকের অনুবাদেও অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। কেউ কিছু বলতে পারে না (১৯৬৭), রূপার কৌটা (১৯৬৯), মুখরা রমণী বশীকরণ (১৯৭০) ইত্যাদি নাটকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। মুনীর চৌধুরীর নাটক কৌতুকপ্রবণতা, ঘটনাবিন্যাস এবং বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপের কারণে খুবই উপভোগ্য। এক কথায় বলা যায়, ১৯৪৭-পরবর্তী বাংলাদেশের সাহিত্যে মুনীর চৌধুরী ছিলেন নবনাটকের উদ্গাতা। সাহিত্য-সমালোচনার ক্ষেত্রে মুনীর চৌধুরী এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন। মীর-মানস (১৯৬৫) ও তুলনামূলক সমালোচনা (১৯৬৯) গ্রন্থ দুটিতে তার পরিচয় পাওয়া যায়। কোনো কিছুর নিরাসক্ত মূল্যায়ন, দুটি ভাষার সাহিত্যকর্মের তুলনা, আবার একই চরিত্র বিভিন্ন নাট্যকারের হাতে কেমন রূপলাভ করে ইত্যাদি বিশ্লেষণ তার সমালোচনার মৌলনীতি। তার বাংলা গদ্যরীতি (১৯৭০) নামক গ্রন্থে বাংলা গদ্যের, বিশেষত পূর্ব বাংলার সমকালীন বাংলা গদ্যরীতির পরিচয় পাওয়া যায়।

মুনীর চৌধুরী মঞ্চ, বেতার, টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্র মাধ্যমে নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা ও সংগঠকের ভ‚মিকা পালন করেন। তার একটি বিশেষ কীর্তি বাংলা টাইপ রাইটারের কী-বোর্ড (১৯৬৫) উদ্ভাবন, যা ‘মুনীর অপটিমা’ নামে পরিচিত। তিনি নাটকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬২) ও দাউদ পুরস্কার (১৯৬৫) লাভ করেন। ঢাকার থিয়েটার নাট্যগোষ্ঠী তার স্মরণে মুনীর চৌধুরী সম্মাননা (১৯৮৯) পদক প্রবর্তন করে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চ‚ড়ান্ত বিজয়ের দুদিন আগে ১৪ ডিসেম্বর তিনি পাকবাহিনীর সহযোগীদের দ্বারা অপহƒত ও নিহত হন। তার সাহিত্যকর্মের মধ্যে নাটক : রক্তাক্ত প্রান্তর (১৯৬২) [পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের কাহিনী এর মূল উপজীব্য। নাটকটির জন্য তিনি ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান।], চিঠি (১৯৬৬), কবর (১৯৬৬) [নাটকটির পটভ‚মি হলো ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন।], দণ্ডকারণ্য (১৯৬৬), পলাশী ব্যারাক ও অন্যান্য (১৯৬৯)। অনুবাদ নাটক : কেউ কিছু বলতে পারে না (১৯৬৯); জর্জ বার্নার্ড শ-র You never can tell -এর বাংলা অনুবাদ। রূপার কৌটা (১৯৬৯); জন গলজ্ওয়র্দি-র  The Silver Box বাংলা অনুবাদ। মুখরা রমণী বশীকরণ (১৯৭০); উইলিয়াম শেকসপিয়ারের Taming of the Shrew বাংলা অনুবাদ। প্রবন্ধ গ্রন্থ : ড্রাইডেন ও ডিএল রায় (১৯৬৩, পরে তুলনামূলক সমালোচনা গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত), মীর মানস (১৯৬৫), রণাঙ্গন (১৯৬৬); সৈয়দ শামসুল হক ও রফিকুল ইসলামের সঙ্গে একত্রে। তুলনামূলক সমালোচনা (১৯৬৯), বাংলা গদ্যরীতি (১৯৭০)। অন্যান্য : An Illustrated Brochure on Bengali Tzpewriter (১৯৬৫)। ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমি থেকে আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায় চার খণ্ডে মুনীর চৌধুরী রচনাবলী প্রকাশিত হয়।

তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (নাটক), ১৯৬২, দাউদ পুরস্কার (মীর মানস গ্রন্থের জন্য) ১৯৬৫ ও সিতারা-ই-ইমতিয়াজ (১৯৬৬) লাভ করেন।

সর্বশেষ খবর