শুক্রবার, ৪ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

অমর শিল্পী আবদুল লতিফ ও ভাষার গান

ইন্দ্র মোহন রাজবংশী

অমর শিল্পী আবদুল লতিফ ও ভাষার গান

অমর সংগীতশিল্পী ও গীতিকার আবদুল লতিফের জন্ম ১৯২৭ সালে। ভাষা আন্দোলনের অকুতোভয় গীতিকার, সুরকার। প্রথম জীবনে ভাষার জন্য লড়াই করে শেষ জীবনেও ভাষার মাসেই ২০০৫ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। রেখে যান তার সৃষ্ট অফুরন্ত গীতিভাণ্ডার ও ভাষা আন্দোলনকালীন কিছু অমর গান, যা চিরকাল বাঙালি জাতিকে বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জোগাবে। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের পর পাকিস্তান রাষ্ট্র তাদের পূর্ব অঞ্চল বা পূর্ব পাকিস্তানকে তারা বিমাতাসুলভ দৃষ্টিতে দেখত। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন গভর্নর কায়েদ-এ-আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সেই দম্ভোক্তিতে, ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। কিন্তু বাঙালি ছাত্র-জনতা তা মেনে নেয়নি। না-না-না বলে সমস্বরে সমুখে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। ওই সময় থেকে সূচনা হয় ভাষা আন্দোলন। পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা’র দাবিতে তীব্র আন্দোলনে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, শফিক ও জব্বারদের বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হলে বিদীর্ণ হয় কোটি কোটি বাঙালির বুক। স্বজন হারানোর বেদনায় গর্জে ওঠে বাঙালি। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচনা করেন অমর প্রতিবাদী কবিতা— ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি’। যা বাঙালিকে আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান করে তোলে। প্রায় একই সময়ে বাগেরহাটের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ক্ষুদ্র তেল ব্যবসায়ী ও গীতিকার মো. শামসুদ্দিন (মতান্তরে শামসুদ্দিন আহমেদ) রচনা করেন এক মর্মস্পর্শী গান ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালি/তোরা, ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি...’। যে গানের প্রতিটি শব্দে আজও ঝরে ঝরে পড়ে বাঙালির বুকফাটা কান্নার অব্যক্ত আর্তনাদ।

ঘটনাচক্রে দুটি রচনাই আবদুল লতিফের হস্তগত হয়। জানা যায়, রচিত হওয়ার পরপরই আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কবিতাটি এক পাতায় মুদ্রণ করে ছাত্রদের মাঝে বিতরণ করা হয়। তারই একটি পাতা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম কর্মী রফিকুল ইসলাম দ্রুত এসে আবদুল লতিফের হাতে দিয়ে বলেন, ‘লতিফ ভাই, আপনাকে এই কবিতাটিতে সুর দিতে হবে এবং আমাদের প্রতিবাদ অনুষ্ঠানগুলোতে গাইতে হবে।’ কালবিলম্ব না করে আবদুল লতিফ পরম মমতায় তাতে সুর সংযোজন করেন এবং তার বলিষ্ঠ ও সুরেলা কণ্ঠে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তা পরিবেশন করতে থাকেন (পরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আলতাফ মাহমুদ আবদুল লতিফের অনুমতিক্রমেই বর্তমান প্রচলিত সুরটি সংযোজন করেন)। এমনিভাবে একবার খুলনার বাগেরহাটে একটি অনুষ্ঠানে গান গাইতে গেলে শামসুদ্দিন নিজেই তার রচিত গানখানা বিনীতভাবে আবদুল লতিফের হাতে তুলে দেন। গানটি আবদুল লতিফের খুবই পছন্দ হয় এবং তিনি তা আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে, তাতে সুর দিয়ে নিজেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেয়ে বেড়াতে থাকেন। পরে তিনি আলতাফ মাহমুদ ও লোকগানের কালজয়ী শিল্পী আবদুল আলীমের কণ্ঠে গানটি তুলে দেন। আমি নিজেও শ্রদ্ধেয় লতিফ কাকুর (আমি তাকে ‘কাকু’ বলেই ডাকতাম) কাছ থেকে গানটি তুলে নেই। এসব গানের পাশাপাশি আন্দোলনকে তীব্রতর করার লক্ষ্যে আবদুল লতিফ দেশের সহজ-সরল মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য রচনা করেন— ‘ওরা আমার মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়/ওরা, কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে পায়...।’ পুরো গানজুড়ে তিনি এমনই সব জোরালো যুক্তি স্থাপন করেন— যাতে ফুটে উঠেছে সব বাঙালির অন্তরের কথা। বিদ্যুৎ বেগে ছড়িয়ে পড়ে সে গান বাংলার ঘরে ঘরে। বিশেষ করে ‘কইমুনা ভাই কইমুনা/অন্য কথা কইমুনা/যায় যদি ভাই দিমু সাধের জান/সেই, জানের বদল রাখুমরে ভাই বাপ-দাদার জবানের মান...’ এই ধরনের প্রত্যয়ী উচ্চারণ বাংলার আপামর গণমানুষকে জাগিয়ে তুলে ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে। এখানেই শেষ নয়, তার মাধ্যমে পরপর জন্ম নেয় ‘মাগো, আটই ফাল্গুনের কথা আমরা ভুলি নাই’, ‘ও আমারি বাংলা ভাষা’, ‘কত সাধের মানিকরে তুই ভাষারে’, ‘ও আমার মায়ের মুখের মধুর ভাষা’ ইত্যাদি কালজয়ী গান এবং অগণিত দেশপ্রেমমূলক গান। আমরা হূদয়ের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে স্মরণ করছি মহান এই গীতিকবি, সুরকার, সংগীত পরিচালক ও কণ্ঠযোদ্ধাকে।

সর্বশেষ খবর