শুক্রবার, ২২ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা
দ্রোহে ও প্রেমে

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

তুহিন ওয়াদুদ

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

পাকিস্তানি শোষণ-পীড়ন-আগ্রাসন দেখতে দেখতে বোধের উন্মীলন হয়েছে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর। ১৫ বছর বয়সেই প্রত্যক্ষ করেছেন ৩০ লাখ প্রাণ আর সীমাহীন নারী লাঞ্ছনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বিনির্মাণ। নতুন দেশ, নতুন স্বপ্ন। প্রত্যাশার পাত্রটিও অনেক বড়। কিন্তু প্রাপ্তির পরিমাণ আশানুরূপ ছিল না। এমনকি যার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশ রচিত হয়েছে, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রাণ দিতে হয়েছে ঘাতকের হাতে। সীমান্ত নিরাপদ রাখার জন্য যাদের তৈরি করা হয়েছে, তারাই রাষ্ট্রচালক হয়ে উঠেছেন। গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র সবকিছুই অনিশ্চিত এবং দূরের বিষয় হয়ে উঠেছিল। সেনাতন্ত্রই তখন দেশের নিয়তি। অনাহারী-অভাবী মানুষের প্রতি রাষ্ট্র ছিল দৃষ্টিহীন। রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যে কবিতাগুলো লিখেছেন তার অধিকাংশই স্বাধীনতা-উত্তর অস্থিতিশীল গণমানুষবিমুখ সামরিক সময়ের বাস্তবতার নিরিখে। প্রেমনির্ভর অনেক কবিতাও লিখেছেন যেখানে ব্যক্তি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহই যেন মুখ্য হয়ে উঠেছেন।

মাত্র ৩৫ বছরের জীবনে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা কবিতায় যা সংযোজন করে গেছেন তার পরিসীমা কালভেদী। ঝরঝরে শব্দব্যঞ্জনায় স্বচ্ছ অভীষ্টে পৌঁছবার এক ধারাবাহিক আকুতি তার কবিতাসম্ভার। ‘উপদ্রুত উপকূল’-এর প্রথম কবিতা ‘অভিমানের খেয়া’য়— ‘অভিলাসী মন চন্দ্রে না-পাক জোস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই,/কিছুটাতো চাই কিছুটাতো চাই— বললেও সময়ের অন্তর্ঘাতে’ তিনি বাস্তবতার দগদগে রূপ আরও উপলব্ধি করেন এবং তার সেই চাওয়া ক্রমশ গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার চাওয়ায় পরিণত হয়। ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’-এর মতো পাঠকপ্রিয় শিল্পোত্তীর্ণ কবিতাও তিনি জীবনের শুরুতেই লিখেছেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থের ‘শব্দ-শ্রমিক’ কবিতায় নিজের পরিচয় স্পষ্টত তুলে ধরেছেন। এই একটি কবিতা বিশ্লেষণ করলেই রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অন্তর্কাঠামো সহজেই পড়ে নেওয়া যায়। এই কবিতায় লিখিত প্রতিটি শব্দে-পঙিক্ততে তিনি নিজেকে তুলে ধরেছেন। শব্দের আঘাতে তিনি মানুষকে ফেরাতে চেয়েছেন— ‘মানুষ মানুষের জন্য’— অনুভূতিতে।

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে চেনা যায় খুব সহজেই। তিনি মানুষের বেদনাবিধুর জীবনের যন্ত্রণাদগ্ধ রূপ দেখেছেন খুব নিবিড় করে। অন্য ১০ জনের মতো তিনি নীরব দর্শকের ভূমিকাতে ছিলেন না। ক্ষত-বিক্ষত সমাজের বিদীর্ণ আর্তনাদ তিনি উপলব্ধি করেছেন। তিনি সমাজের ব্যাধিমূল চিহ্নিত করেছেন এবং ব্যাধি নিরসনে যাদের ভূমিকা রাখার কথা তাদের নিষ্ক্রিয়তায় ভীষণভাবে আহত হয়েছেন। তার মূল্যায়নে শিল্পী-সাহিত্যিক-রাজনীতিক সবাই তাদের নিজ নিজ ভূমিকায় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রথম কাব্যগ্রন্থে যে বোধের বীজ রোপণ করেছেন তা দ্রুতই বৃক্ষে রূপায়িত হয়েছে পরবর্তী কাব্যগুলোতে। ১৯৭৬-৭৭ সালে কবির বয়স ২০-২১ বছর। সে সময়ে তার লেখা কবিতাগুলোতে যথেষ্ট ক্ষোভ উচ্চারিত হয়েছে। ১৯৮০ সালে প্রকাশিত ‘ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম’ কাব্যগ্রন্থে তার সেই ক্ষোভের চরমতম প্রকাশ লক্ষ করা যায়। জাতির বিপদে-আপদে যাদের অগ্রণী ভূমিকা রাখার কথা তারাও যেন নীরব হয়ে গেছে।

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর লেখার সঙ্গে সমকালীন রাজনীতির ছিল এক গভীরতর সম্পর্ক। সমকালীন রাজনীতি-রাষ্ট্রনীতির অসারতার চিত্র তিনি তুলে এনেছেন ‘হাড়েরও ঘরখানি’ কবিতায়— ‘বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে/রাজনীতিকের ধমনী শিরায় সুবিধাবাদের পাপ/বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে/বুদ্ধিজীবীর রক্তে স্নায়ুতে সচেতন অপরাধ’। রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতাঙ্গনে প্রবেশ সেনাশাসিত বাংলাদেশে। তার সমগ্র কবিতাজীবনই প্রায় কেটে গেছে সেনাশাসনে। কারা বেঁচে থাকে কারা মারা যাচ্ছে সে কথাও তিনি লিখেছেন— ‘হাজার সিরাজ মরে, হাজার মুজিব মরে/হাজার তাহের মরে/বেঁচে থাকে চাটুকার, পা-চাটা কুকুর,/বেঁচে থাকে ঘুণ পোকা, বেঁচে থাকে সাপ।’

‘ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম’ নামের কোনো নাম কবিতা না থাকলেও কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতা ‘হারানো আঙুল’ কবিতায় তিনি যে স্বর্ণগ্রামের উল্লেখ করেছেন তা অতীত বাংলাদেশ। এ কবিতার একটি চরণ উদ্ধৃত করেছেন উৎসর্গপত্রে— বিশ্বাসের তাঁতে আজ আবার বুনতে চাই জীবনের দগ্ধ মসলিন। মসলিন সমৃদ্ধ সুবর্ণ অতীতের কাছে কবির নতজানু হতে কোথাও কোনো বাধা নেই। সময় খুঁড়ে খুঁড়ে তিনি পৌঁছতে চান সমৃদ্ধির পর্বে— ‘এই ধুলো, ক্লান্তি, ভুল, জীর্ণ দুঃখগুলো ছিঁড়ে খুঁড়ে ফিরে যাবো স্বর্ণগ্রামে।’ 

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘মানুষের মানচিত্র’। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে ক্ষুধা-জরাজীর্ণ-পতিত জীবনের পক্ষে থাকার জন্য যে আহ্বান জানিয়েছেন তার ক্রমাগত বয়ান হচ্ছে তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। নিজেকে তিনি কবির পরিবর্তে শব্দ-শ্রমিক বলে যে নিজের অবস্থান নির্দেশ করেছেন তার পরিচ্ছন্ন মূল্যায়ন হচ্ছে ‘মানুষের মানচিত্র’ কাব্যটি। ১ থেকে ৩২ সংখ্যা পর্যন্ত কাব্যের পরিধি। এ কবিতাগুলোর স্বতন্ত্র নামের প্রয়োজন হয়নি। অনাহারী-অভাবী-অপুষ্ট-জীর্ণ-শীর্ণ অবহেলিত-উপেক্ষিত-বঞ্চিত জনপদের জমাটবদ্ধ অপরিমিত কষ্টের মানচিত্র এ কাব্যের পটভূমি। গরিবদের জন্য আর্থ-সামাজিক অবস্থা এতটাই নাজুক— খাবার জোটে না। এমনকি ভিক্ষাও পাওয়া দায়। স্বামী কাজের জন্য স্ত্রীকে রেখে দূরে যায়। মেয়েদের অনেক সময়ে জীবন বাঁচাতে দেহটাকে অবলম্বন করতে হয়েছে। স্বামীর জন্য স্ত্রীদের দীর্ঘ অপেক্ষায় কাটে দিন। অভাবে স্বামী যখন স্ত্রীকে খাবার দিতে ব্যর্থ হয় তখন অনেক সময়ে সংসার ভেঙেছে। ১০ সংখ্যক কবিতায় দেখা যায় তারই চিত্র— ‘সোয়ামির ঘর থেকে তালাক হয়েছে তার, জোটেনি তালাক/জীবনের কাছ থেকে। জীবন নিয়েছে তারে অন্ধকারে টেনে।’ অভাবের দিনগুলোতে নারীরা যেন আরও অসহায় হয়ে পড়ে। ১২ সংখ্যক কবিতার মধ্যেও তালাকভীতির উচ্চারণ— ‘তুমি যদি কথা দাও কার্তিকের অনটনে দেবে না তালাক,/তোমার বুকের নিচে আমি তবে ভূমি হবো, হবো এক নদী’। আটপৌরে জীবনের প্রতিটি ছত্রে ছত্রে বেদনার্ত সংলাপ। অনাহারী সময়ের কাছে জীবনের সকল বিলাস-ব্যসন পরাহত। রাষ্ট্রপ্রধানদের আশ্বাসেও কোনো আস্থা রাখা সম্ভব হয় না। অনটন তাড়িত জীবনে আসে না পরিবর্তন।

সমাজের প্রতিকূল জীবনে তিনি নিজের মুখচ্ছবি ছাড়া যেন আর কাউকেই দেখতে পাননি। তিনি একাকিত্ববোধে পীড়িত হয়েছেন এবং যে কথা প্রিয়তমার কাছে চিঠিতে লিখেছেন সেই কথাই লিখেছেন কবিতায়। ১৯৮৩ সালে তসলিমা নাসরিনের কাছে পাঠানো চিঠিতে তিনি লিখেছেন— ‘লেখক বলতে আজ আর লোকে গগনবিহারী দ্বিপদী প্রাণী বোঝে না। একজন লেখকের ভূমিকা আজ অনেক দায়িত্বপূর্ণ। অনেক বেশি স্পষ্ট, ইতিবাচক, আমাদের অধিকাংশ রাজনীতিকেরা বড় বেশি ফাঁপা, বড় বেশি আপোসমুখী। আমাদের প্রায় সব বুদ্ধিজীবী মেরুদণ্ডহীন, বিভ্রান্ত। আমাদের অধিকাংশ লেখক ডোবার মতো— পচা জল, স্রোতহীন, শ্যাওলা ঢাকা।’

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অবিনাশী। জীবনঘনিষ্ঠতার পরতে খোদাই করা স্বতন্ত্র উপস্থিতি তার। অনেক সময়ে শিল্পের আঙ্গিক বিনির্মাণের চেয়ে জীবনের প্রপাতেই ভেসেছেন। তার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘ছোবল’ এর প্রতিপাদ্যও সাধারণ মানুষ। সব শ্রেণির মানুষকে তিনি লেখনি দ্বারা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছেন। অধপতিত সময় আর সমাজের পুনরুদ্ধার চেযেছেন। মানুষের বোধে শব্দের হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করেছেন। সামরিক জান্তার গুলিতে যখন দেশের সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন তখন তিনি সমাজের প্রতি নিজের দায়বদ্ধতার জায়গাটি তিনি পরিষ্কার করেন এভাবে— ‘পরস্পর দ্যাখা হলে আমরা এখনো কেন জিজ্ঞাসা করছি:/ কেমন আছেন? আমরা কেন জিজ্ঞাসা করছি না : আন্দোলন কতোদূর?/ হরতালে ‘নিখিল’ ফাটবে?/ আমরা কেন জিজ্ঞাসা করছি না : সামরিক না জনতা?/ কোন পক্ষ? ধনী না মানুষ?’ স্বৈরাচার অভিধা খ্যাত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময়ে যখন রাজনীতিকরাও কোণঠাসা তখনো তার দ্বিধাহীন অকপট উচ্চারণ— ‘এখন তোমাকে আর ঘৃণা করতে চাই না,/আমি থুতু দিতে চাই জলপাই বাহিনীর মুখে—/যারা শিশু একাডেমী, নীলক্ষেত রক্তে ভিজিয়েছে, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছে গুলিবিদ্ধ লাশ,/বুটের তলায় পিষে যারা খুন করেছে মানুষ,/আজ সেই জলপাই বাহিনীর রক্ত নিতে চাই’।

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ শিল্পী-সাহিত্যিকদের নিষ্ক্রিয়তার তীব্র সমালোচনা করেছেন। তার কাছে শিল্প হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ারসম। সামরিক জান্তার দুঃশাসনে গণমানুষের স্বাধীনতা বিপর্যস্ত। অস্ত্রের মুখোমুখি দাঁড়াতে যে শিল্পী-সাহিত্যিকরা অক্ষম তাদের প্রতি বারংবার ঘৃণাবর্ষণ করেছেন। চেষ্টা করেছেন তাদের ভোঁতা বোধসমূহকে জাগ্রত করার। ১৯৭৪ সালে দেশে যে দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছিল তা প্রত্যক্ষ করেছেন কবি। গণামানুষের মুক্তিকামী কবি লক্ষ্য করেছেন দুর্ভিক্ষের রেশ কাটতে না কাটতেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। দেশের অভাবী মানুষের ক্ষুধা-দারিদ্র্য দূরীকরণের চেয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন শাসকরা। জিয়াউর রহমান-হুসেইন মুম্মহদ এরশাদ অভিন্ন সূত্রে গাথা। ‘সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি’ কবিতা তিনি দেশবাসীর কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন— ‘দাঁড়াও, নিজেকে প্রশ্ন করো— কোন পক্ষে যাবে? একদিকে বিত্তবান,/অন্যদিকে বিত্তহীন ক্ষুধার্ত মানুষ।/একদিকে পুঁজিবাদ,/অন্যদিকে সাম্যবাদী শান্তির সমাজ। ইতিহাস সাক্ষী দ্যাখো, অনিবার্য এ-লড়াই— কোন পক্ষে যাবে?’ পক্ষ বলতে তিনি দেশস্বার্থে ইতি এবং নেতি দুটি পক্ষকে বুঝিয়েছেনে। সামরিক বাহিনীর দেশ শাসন প্রক্রিয়াকেও তিনি নেতির মধ্যে যুক্ত করেছেন।

প্রণয়ের ধারাপাত রচনাতেও সিদ্ধহস্ত রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভালোবাসায় নারী-পুরুষের চিরায়ত সম্পর্ককেও তিনি করে তুলেছেন শিল্পখচিত। গভীরতর প্রেম উপলব্ধি করা যায় যখন দূরে থাকা যায়। কাছে থাকলে প্রেমের গভীরতা অনেক সময়ে উপলব্ধি করা যায় না। বস্তুগত উপস্থিতিতে ব্যক্তিকে পাওয়া যায় কিন্তু অনুভূতিলোকে অনুভব করতে হলে অনুপস্থিতির কালকেই বেছে নিতে হয়। বস্তুবাদী রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে প্রেমের মূল্যায়নে অনুপস্থিতির কালকেই অধিক প্রেমাবিষ্টের কাল বলে স্বীকার করে নিতে হয়েছে। ‘এ কেমন ভ্রান্তি আমার’ কবিতায় তিনি একখানে বলেছেন— ‘এলে মনে হয় কোনোদিন আসতে পারোনি...  একই কবিতার অন্যখানে লিখেছেন— চ’লে গেলে মনে হয় তুমি এসেছিলে,/ চ’লে গেলে মনে হয় তুমি সমস্ত ভুবনে আছো’। তার প্রেমবিষয়ক বেশ কিছু কবিতা রয়েছে। এ ধারার তার অন্যতম কবিতা হচ্ছে ‘পরাজিত প্রেম’। তার অপরাপর প্রেমের কবিতাগুলোর মতো এটিও আত্মঅনুভূতির স্মারক।

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রেমপ্রধান কবিতাগুলোর মধ্যে কবি স্বয়ং যেন বাস করছেন। বৈবাহিক বিচ্ছেদের করুণ অনুভূতিও স্থান করে নিয়েছে কবিতায়। ‘গল্প’, ‘দিয়েছিলে সকল আকাশ’ কিংবা মৌলিক মুখোশ কাব্যগ্রন্থের অনেকগুলো কবিতায় ব্যক্তিক প্রেমের নানান মাত্রা শিল্পরূপ লাভ করেছে।

জীবনের কথা লিখতে গিয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য শিল্পের মোড়ক যথাযথ রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন অভিযোগ করা হয়। রণেশ দাশগুপ্ত ‘শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে’ প্রবন্ধ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন—শিল্প সাহিত্য রচিত হওয়া উচিত সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির জন্য। রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর লেখায় সেই দর্শনই তির্যকভাবে উঠে এসেছে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম কিংবা সুকান্ত ভট্টাচার্যের পাঠকপ্রিয়তায় কোনো কমতি নেই। এর অন্যতম মন্ত্রপাঠ হচ্ছে জীবন ঘনিষ্ঠতা। রুদ্র নজরুল-সুকান্তের পথ ধরে হাঁটলেও তার কবিতার ঠাসবুনন পাঠক-সমালোচকের কাছে গোপন থাকে না। প্রচলিত বাংলা বানানের পরিবর্তে তিনি স্বতন্ত্র বানান প্রয়োগ করেছেন। কবিতার আঙ্গিক প্রশ্নে তিনি ছিলেন সচেতন। ‘মানুষের মানচিত্র’ কাব্যগ্রন্থ স্লোগানধর্মী হলেও একটি সাক্ষাৎকারে এ কাব্যগ্রন্থে কবিতার ফর্ম ভাঙার চেষ্টার কথাই বলেছেন— ত্রিশের বিভ্রান্ত কবিরা যেসব কারণে একটি কবিতাকে আধুনিক কবিতা বলতে চেয়েছেন, এবং এখনো আমাদের অনেক অগ্রজ সাহিত্যিক যে গুণাবলির জন্য একটি কবিতাকে আধুনিক কবিতা বলে থাকেন, ‘মানুষের মানচিত্রে’ আমি প্রাণপণে সেসব লক্ষণ ও গুণাবলিকে অবহেলা করতে চেষ্টা করেছি। বর্জন করতে চেষ্টা করেছি। রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রাজনীতি-সচেতন ছিলেন। মানুষের অন্তস্থ এবং বহিস্থ সুখ-দুঃখ, রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির জটিল সম্পর্ক সবকিছুই বুঝেছেন দরদ দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ পর্ব তার লেখায় কালজয়ী রূপে বিন্যস্ত। জীবন এবং শিল্প এ দুপক্ষের মধ্যে তিনি প্রথমটিই বেছে নিয়েছেন। শিল্পের মধ্যে পরোক্ষভাবে উঠে আসা জীবনের পরিবর্তে তিনি জীবনকে শিল্পে প্রত্যক্ষরূপে স্থান করে দিয়েছেন। জীবনঘনিষ্ঠতার কারণেই তার কবিতার আবেদন আজও ক্রমসম্প্রসারমাণ। ২১ জুন ছিল তার মৃত্যবার্ষিকী। পাঠকের পক্ষে রুদ্র স্মরণে জীবনবাদী প্রণতি।

সর্বশেষ খবর