শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

বাংলা উপন্যাস ও মহাশ্বেতা দেবী

বদরুন নাহার

বাংলা উপন্যাস ও মহাশ্বেতা দেবী

উনিশ শতকে বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের যাত্রা শুরু। তখন ঔপনিবেশিক শাসনের কাল এবং বাংলা উপন্যাস যাত্রায় ছিল ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রভাব। মূলত সেই সময় সামাজিক নকশামূলক রচনা এবং ইতিহাসকেন্দ্রিক রোমান্সের ধারায় আধুনিক উপন্যাসের সূচনা করেন প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪), কালীপ্রসন্ন সিংহ (১৮৪০-১৮৭০) প্রমুখ। তবে আধুনিক বাংলা উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সর্বজনস্বীকৃত।

সেই সময় ঔপন্যাসিকরা আর্থ-সামাজিকভাবে উচ্চ ও মধ্যবিত্তের অবস্থান থেকে এসেছিলেন। তাদের উপন্যাসে বাংলার ভূমি ও মানুষের উপস্থিতি থাকলেও তা ছিল ঔপনিবেশিক অবস্থান থেকে অভিজাত ও মধ্যবিত্তের প্রেক্ষাপটকে প্রাধান্য দিয়ে নির্মাণ। কাহিনী ও চরিত্র বিন্যাসে তা পরিলক্ষিত। নিম্নবর্গের মানুষের কথা ছিল উচ্চবিত্তীয় সামান্ত মানসিকতার মধ্য থেকে উপস্থাপিত। তাই বলা যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮—১৮৯৪), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮)-এর উপন্যাস নিরীক্ষায় বাংলার শিকড়ের আখ্যান উপস্থাপিত হলেও তা ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রবহমানতায় আবিষ্ট উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত। তাদের দ্বারা উপন্যাস সাহিত্যের যে যুগের বিকাশ ঘটেছিল, তার বিরুদ্ধে চূড়ান্তভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয় ‘কল্লোল’ বাস্তবতার যুগে। এ সময় থেকে বাংলা উপন্যাস গতানুগতিক ইউরোপীয় উপন্যাসের বিষয় ও আঙ্গিকের অভিনবত্বে আচ্ছন্ন না থেকে নতুনভাবে ভারতীয় জীবনমুখিতায় অভিষিক্ত হতে শুরু করে। এই পরিবর্তনীয় ভাবধারায় বাংলা উপন্যাসে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জীবনের বাধা পরিধিকে অতিক্রম করে সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবর্গের মানুষের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১), বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬), সতীনাথ ভাদুড়ী (১৯০৬-১৯৬৫), অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১৯১৪-১৯৫১), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (১৯২২-১৯৭১) প্রমুখ ঔপন্যাসিক তাদের অনুসন্ধানী দৃষ্টিক্ষেপণে নতুন আখ্যান নিয়ে আসেন বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে। তারা দীর্ঘদিনের অবহেলিত ও উপেক্ষিত নিম্নবর্গের সমাজ ও মানুষের কথা নিয়ে আসেন সংবেদনশীলভাবে।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপ্যাধ্যায় উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে যেসব চরিত্র তৈরি করেছেন, তার বেশিরভাগই ছিল উচ্চবর্গের মানুষ। তার রচিত দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫), কপালকুণ্ডলা (১৮৬৬), চন্দ্রশেখর (১৮৭৫) প্রভৃতি উপন্যাস লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই, এসব উপন্যাসের চরিত্ররা সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণি থেকে উঠে আসা মানুষবিশেষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপন্যাসে তুলে আনলেন উচ্চবিত্ত থেকে উচ্চ মধ্যবিত্তের মানুষের কথা, তাদের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। তার রচিত চোখের বালি (১৯০৩), গোরা (১৯১০), ঘরে-বাইরে (১৯১৬), যোগাযোগ (১৯২৯) প্রভৃতি উপন্যাসে তা স্পষ্ট। শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপন্যাস রচনায় উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের ঘরের কথা, নারীর কথা এলো সমাজের মানবিকবোধ পরিবার ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের আলোকে। তার চরিত্রগুলো প্রধানত সামন্ততান্ত্রিক সমাজ থেকে তুলে আনা। এক্ষেত্রে তার রচিত দেবদাস (১৯১৭), চরিত্রহীন (১৯১৭), শ্রীকান্ত (১৯১৭-৩৩), দেনাপাওনা (১৯২৩) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে নিম্নবর্গের মানুষের আখ্যান নিয়ে এলেন তিন বন্দ্যোপাধ্যায়। ভূমিমুখী ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাত তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাসের বিষয়বস্তুর নতুনত্বে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মানুষজনের গণ্ডি অতিক্রম করে নিম্নবর্গের মানুষজনকে নিয়ে এলেন কমিউনিস্ট-কথিত সমাজ রূপান্তরের মাধ্যমে। তার রচিত ধাত্রীদেবতা (১৯৩৯), কালিন্দী (১৯৪০), গণদেবতা (১৯৪০) ও কবি (১৯৪৪) উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গণদেবতা উপন্যাসটি সম্পর্কে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন— শুধু তারাশঙ্করেরই নয়, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যেরই একটি যুগ-পরিচায়ক উপন্যাস।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসটি যে কারণে বিশিষ্ট হয়ে উঠে তা হলো অস্পৃশ্য ডোম বা দলিত জনগোষ্ঠী থেকে কবি নির্মাণ। অন্যদিকে হাঁসুলী বাঁকের উপকথা (১৯৪৭) উপন্যাসে তিনি হাঁসুলী নদীর বাঁকে বসবাসকারী কাহার সমাজের মানুষ। নাগিনীকন্যার কাহিনী (১৯৫৩)-তে তিনি বেদে সম্প্রদায়ের জীবনকে উপন্যাসে রূপ দেন। মূলত তিনি বীরভূম, মানভূম, সাঁওতাল পরগনা অঞ্চলের লোকজীবন, গণমানুষ, উপকথা-রূপকথা গ্রহণ করে আঞ্চলিক উপন্যাসের সূচনা করেন।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস পথের পাঁচালী (১৯২৮)-তে তিনি শুধু গ্রামীণ জীবনকে চিত্রিত করেই আলোচিত হননি বরং তার প্রাকৃতবাদের প্রকাশও ঘটে। তবে তার আরণ্যক (১৯৩৯) উপন্যাসে অরণ্য প্রকৃতি ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি লক্ষণীয়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস প্রসঙ্গে অচ্যুত গোস্বামী বলেন— ...বিভূতিভূষণের উপন্যাসে প্রাকৃতবাদ উভয় অর্থে প্রতিফলিত হয়েছে। বাস্তবের বিজ্ঞানী-সুলভ চিত্রায়ণ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ‘ব্যাক টু নেচার’ আবেদন। অন্যদিকে রাজনৈতিক উপন্যাস দিয়ে শুরু করলেও সতীনাথ ভাদুড়ী শিকড়সন্ধানী হয়ে চলে গেলেন একেবারে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত শ্রেণির মানুষের কাছে ঢোঁড়াইচরিতমানস (১৯৪৯, ১৯৫১) উপন্যাসে। সপ্তকাণ্ডের রামায়ণের মতোই এই উপন্যাসে সাতটি কাণ্ডে বিভক্ত করে রচিত। সাত কাণ্ডের উপন্যাসে অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষজন অধ্যুষিত এলাকা তাত্মাটুলি-ধাঙড়পল্লীর কাহিনী ও ভারতবর্ষের ঔপনিবেশিক রাজনীতি, সামন্তবাদ, কংগ্রেসি গান্ধীবাদ প্রভৃতিকে সমান্তরালে চিত্রিত করেন।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৩৬), পুতুল নাচের ইতিকথা (১৯৩৬), তিনি পূর্ববঙ্গীয় ভাষার ব্যবহার ও নদীকেন্দ্রিক নিম্নবর্গের জেলে সম্প্রদায়ের জীবনকে উপন্যাসে নিয়ে আসেন। অন্যদিকে খোদ জেলে পরিবার থেকে উঠে এসে হৃদয়াবেগে স্ফূর্ত হয়ে উপন্যাস রচনা করেন অদ্বৈতমল্ল বর্মণ। নিম্নবর্গের জেলে সম্প্রদায়কে নিয়ে তার অনবদ্য রচনা তিতাস একটা নদীর নাম (১৯৪৫-৪৭) উপন্যাসটি উল্লেখযোগ্য। নিম্নবর্গীয় আখ্যান নির্মাণে নিজস্ব ভাষার সক্রিয়তা তৈরি করেন কমলকুমার মজুমদার (১৯১৪-১৯৭৯)। তার অন্তর্জলী যাত্রা (১৯৫৯) এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। এরপর অমিয়ভূষণ মজুমদার (১৯১৮-২০০১), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (১৯২২-১৯৭১), মহাশ্বেতা দেবী (১৯২৬-২০১৬), দেবেশ রায় (১৯২৬), অভিজিৎ সেন (১৯৪৫) বিষয়ের বহুমাত্রিকতায় যুক্ত হন। তারা নিম্নবর্গের জীবনসংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এসে প্রতিবাদী ও বিপ্লবী উপাখ্যান নিয়ে আসেন উপন্যাস সাহিত্যে। বিশ শতকে তাদের এই ধারাকে উপন্যাসের নবযাত্রা বলা যেতে পারে।

এই অভিযাত্রায় বিষয়ের বহুমাত্রিকতা ও দেশজ আখ্যানের অনুসন্ধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন মহাশ্বেতা দেবী। তিনি ইতিহাস ও রাজনীতি থেকে যে উপন্যাস রচনা শুরু করেন, সেখানে যেমন ঝাঁসির রানীর মতো চরিত্র রয়েছে তেমনি রয়েছে সার্কাসের শিল্পী ও নৃত্যশিল্পীদের আখ্যান। তার শুরুর দিকের উপন্যাস ঝাঁসির রানী (১৯৫৬), মধুরে মধুরে (১৯৫৮), প্রেমতারা (১৯৫৯), আঁধার মানিক (১৯৬৬), বায়স্কোপের বাক্স (১৯৬৪)সহ প্রভৃতিতে নানা শ্রেণির জীবনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। তবে তার সবচেয়ে আলোচিত রাজনৈতিক উপন্যাস হাজার চুরাশির মা (১৯৭৪), এই উপন্যাসকে তার সাহিত্যের বাঁক পরিবর্তনের সূচনা বলে মনে করা হয়। এটা তার দ্বিতীয় পর্যায়ের রচনাকাল। এ সময় তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হলো : হাজার চুরাশির মা (১৯৭৪), ঘরে ফেরা (১৯৭৯), তিতুমীর (১৯৮৪), স্বেচ্ছা সৈনিক (১৯৮৬), অক্লান্ত কৌরব (১৯৮২), বিবেক বিদায় পালা (১৯৮৩), বন্দোবস্তি (১৯৮৮), মার্ডারারে মা (১৯৯২) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

এরপর তিনি ইতিহাস অনুসন্ধানে চলে গেলেন একেবারে প্রান্তিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে। ইতিহাস, রাজনীতি ও উপকথাকে কেন্দ্র করে যে উপন্যাস লেখা শুরু করেন, তা সভ্য সমাজের মানুষের বিচরণের বাইরের জগৎ। সত্তরের মাঝামাঝি সময়ে তার উপন্যাসকে নিয়ে গেলেন একেবারে অন্য আলোয়, যা তার উপন্যাস রচনার তৃতীয় পর্যায় হিসেবে ধরা যায়। সেই পথে গিয়ে মহাশ্বেতা দেবী একের পর এক উপন্যাস রচনা করে স্বতন্ত্রতা প্রকাশ করেন। তিনি উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক ভৌগোলিক পরিবর্তনের সঙ্গে ভারতীয় রাজনৈতিক ইতিহাসের পরিবর্তনের ধারায় সে দেশীয় আদিবাসী জীবনের পরিবর্তন বর্ণনা করেন। পাহাড়ি অরণ্য জীবনের সঙ্গে উপন্যাসে ফুটে উঠে পরিবেশের বিপন্নতার চিত্র, যা আজকের পৃথিবীকেও বিচলিত করে, সেই আখ্যান সাহিত্যে রূপ দিয়ে আদিবাসী জীবনে ঘটে যাওয়া উলগুলান (১৯০০), কোলহান (১৮৩৫) এবং হুল (১৮৫৫-৫৬) সম্পর্কে পাঠক মনে সাড়া জাগান মহাশ্বেতা দেবী। তার আদিবাসী জীবনকেন্দ্রিক উপন্যাসগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য : কবি বন্দ্যঘটী গাঞির জীবন ও মৃত্যু (১৯৬৭), অরণ্যের অধিকার (১৯৭৫), চোট্টি মুণ্ডা এবং তার তির (১৯৮০), সুরজ গাগরাই (১৯৮৩), স্বেচ্ছাসৈনিক (১৯৮৫), টেরোড্যাকটিল, পূরণসহায় ও পিরথা (১৯৮৭), বন্দোবস্তী (১৯৮৯), ক্ষুধা (১৯৯২), কৈবর্ত খণ্ড (১৯৯৪) প্রভৃতি। এছাড়া অরণ্যের অধিকার উপন্যাসের প্রেক্ষিতেই কিশোরদের জন্য বিরসা মুণ্ডা (১৯৮১) নামের একটি উপন্যাসও লিখেন। উল্লেখ্য, উপন্যাসগুলো রচনার ক্ষেত্রে রয়েছে বিষয়বস্তু এবং প্রকরণগত বিশিষ্টতা।

অরণ্যচারী জনগোষ্ঠীর মুখে মুখে ঘুরে ফেরা জীবন ও ঐতিহ্য থেকে সেই জাতিসত্তার যে ইতিহাস তিনি রচনা করেন, তা বঙ্কিমচন্দ্রের দেখানো পথে বা ভাবধারায়ও নয়, একেবারে তার নিজের মতো করে প্রকাশ। মহাশ্বেতা অন্ত্যজ আদিবাসীদের চোখ দিয়ে জীবনকে ব্যাখ্যা করেন। এসব উপন্যাসে প্রধান চরিত্রগুলো এসেছে আদিবাসী সমাজ থেকে। বিভূতিভূষণ যেমন তার ‘আরণ্যক’ উপন্যাসটিতে অরণ্যচারী প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা এনেছিলেন। যা ছিল একজন কলকাতার বাবুর চোখ থেকে দেখা। সেখানে মুগ্ধতা আর করুণার চোখে নির্মিত হয়েছিল প্রেক্ষাপট। কিন্তু মহাশ্বেতার অরণ্যের অধিকারের কথা সেই সমাজের জীবনাপোলব্ধি। তাদের বাঁচার অধিকার থেকে তুলে আনা প্রেক্ষাপট। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অরণ্যবহ্নি (১৯৬৬) ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহের অমর নায়ক সিধু-কানুর কৌমচেতনা ও দেশচেতনায় উজ্জীবিত উপন্যাস। সত্যেন সেনের বিদ্রোহী কৈবর্ত (১৯৬৯) উপন্যাসটি পাল যুগে উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্র অঞ্চলের শূদ্রস্থানীয় কৈবর্ত বিদ্রোহ নিয়ে রচিত। অবহেলিত কৈবর্ত বিদ্রোহ নিয়ে মহাশ্বেতা দেবীও একটি উপন্যাস রচনা করেছেন, কৈবর্ত খণ্ড (১৯৯৪) নামে। সমরেশ বসু (১৯২৪-১৯৮৮) রচিত মহাকালের রথের ঘোড়া (১৯৭৭) যা আদিবাসী জীবনঘনিষ্ঠ উপন্যাস। চল্লিশের দশকের কথকার সাবিত্রী রায় (১৯১৮-১৯৮৫) তার পাকা ধানের গান (১ম পর্ব ১৯৫৬, ২য় পর্ব ১৯৫৭ এবং ৩য় পর্ব ১৯৬৫ সালে) লিখেন। যেখানে তিনি হাজং অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষিত নিয়ে আসেন ।

মহাশ্বেতা দেবীর বিশিষ্টতা তিনি বাংলা সাহিত্যে সর্বাধিক আদিবাসী জীবনকেন্দ্রিক উপন্যাস রচনা করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তার কাছে সাহিত্য শুধু বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার মিশ্রণ নয়, বরং সাহিত্যও শ্রমসাধ্য বিষয়। মহাশ্বেতার কলমের কালি বুলেটের মতো সমাজকে বিদ্ধ করে। ধীমান দাশগুপ্ত মহাশ্বেতার সাহিত্যকৃতির নান্দনিক তাত্পর্য ব্যাখ্যায় বলেন— মহাশ্বেতার সাহিত্যিক ক্ষেত্রটিকে, বলা যায়, মানিকের রিয়ালিজম, সতীনাথের ফর্ম্যালিজম এবং তারাশঙ্করের এক্সপ্রেশনিজমের এক একীভূত ক্ষেত্র। আমার বিচারে মানিক বা তারাশঙ্করের চেয়েও সতীনাথের সঙ্গে মহাশ্বেতার আত্মীয়তা যেন অধিক।... সতীনাথের মতোই মহাশ্বেতাও ‘শ্রেণিবিভক্ত বর্ণবিচ্ছুরিত যৌনতাশাসিত ধর্মসাপেক্ষ প্রাদেশিকতা-নির্ভর’ এক ভারতবর্ষের লেখক।

বাংলা সাহিত্যে মহাশ্বেতা দেবীকে নিছক সমাজতাত্ত্বিক নয় বরং সমাজ মনস্তাত্ত্বিক বলা যেতে পারে। এক স্বতন্ত্র ঘরানার লেখক তিনি। বলা যায় পোস্টমডার্নিজমের ক্ষেত্রে সাব-অলটার্ন আসার আগে থেকেই মহাশ্বেতা সাহিত্যে নিজের মতো করে সাব-অলটার্ন চর্চা করে গেছেন। অনেক বেশি শিকড়ে গিয়েই তিনি অরণ্যের অধিকার লিখেছেন, তা প্রমাণিত হয় যখন তিনি আদিবাসী মুণ্ডা সমাজের ঘরের লোক হয়ে ওঠেন। সেই আদিবাসী সমাজ তাকে ‘মারাং দাই’ বলে স্বীকার করে নেয়। মহাশ্বেতা দেবী কাজের প্রতি এতই সচেতন থেকেছেন যে তিনি আদিবাসী সংস্কৃতির ইতিহাসের মাধ্যমে তথা তাদের লোকগাথা, উপকথা, মিথকে কেন্দ্র করে যে জীবন ও সংগ্রামকে তুলে ধরে উপন্যাস লিখেছেন, তা মোটেও আরোপিত হয়ে ওঠে না বরং জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে যায়। এভাবে সত্তুরের দশকের পর তিনি পুরোপুরিভাবে সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে এসটাবলিশমেন্ট-বিরোধী হয়ে ওঠেন।

মহাশ্বেতা দেবীর আদিবাসী উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে। উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে ঘটনার নাটকীয়তার চেয়ে মানব-চরিত্রের দিকে বিশেষ মনোযোগ তিনি দিয়েছেন। তার উপন্যাসের বেশিরভাগ প্রধান চরিত্রগুলো আদিবাসী শ্রেণি থেকে উঠে আসা মানুষ। অরণ্যের অধিকার এ বীরসা মুণ্ডা, ধানী মুণ্ডা, সুগানা, করমি, কোমতা, সালী ও ডোনকা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। চোট্টি মুণ্ডা এবং তার তীর উপন্যাসটিতে চোট্টি মুণ্ডা, ধানী মুণ্ডা, দুখিয়া, হরমু, পাহানসহ অসংখ্য চরিত্র মুণ্ডা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। এছাড়া কবি বন্দ্যঘটী গাঞির জীবন ও মৃত্যু-তে কবি বন্দ্যঘটী গাঞি, সুরজ গাগরাই-এর সুরজ গাগরাই, নান্দি কালু সুমরাই প্রমুখ কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলো আদিবাসী মানুষ। তবে টেরোড্যাকটিল, পূরণ সহায়ও পিরথা-এর প্রধান চরিত্র এনেছেন নিম্ন মধ্যবিত্ত হিন্দু সমাজের প্রতিনিধি, অন্যদিকে বিখিয়সহ বেশ কিছু চরিত্র আদিবাসী। তার চরিত্রেরা আদিভারতীয় অধিবাসী, নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি।

 

মহাশ্বেতা দেবী উপন্যাসে অসংখ্য বীরের কাহিনী তুলে এনেছেন। এই বীরের কাহিনী শুধু বীরসা চরিত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এছাড়াও আরও বীর চরিত্র আমরা পেয়েছি। যেমন— চোট্টি মুণ্ডা এবং তার তীর-এর চোট্টি একজন বীর তীরন্দাজ। সুরজ গাগরাই-এর সুরজ চরিত্রটিতেও বীরের উপস্থিতি দেখতে পাই। মহাশ্বেতা দেবী লেখাকে সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গায় নিয়ে গেছেন। তার উপন্যাস বেশিরভাগই সময়ের দলিল হয়ে পৌঁছে যাবে ভবিষ্যতের দিকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় অরণ্যের অধিকার উপন্যাসটি। এ ক্ষেত্রে মহাশ্বেতা গ্রন্থটির ভূমিকায় বলেছেন— এ উপন্যাস রচনায় সুরেশ সিং রচিত Dust storm and Hanging mist বইটির কাছে আমি সবিশেষ ঋণী। সুলিখিত তথ্যপূর্ণ গ্রন্থটি ছাড়া বর্তমান উপন্যাস রচনা সম্ভব হতো না। সুরেশ সিং-এর বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে। মহাশ্বেতা তার অরণ্যের অধিকার রচনা প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। কিন্তু সুরেশ সিং-এর বই দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালে। Birsa Munda and His Movement-১৮৭৪-১৯০১ নামে। ইতিহাস-গবেষণা ও উপন্যাস রচনার এমন পারস্পরিক সমন্বয় খুব একটা ঘটে না। এ থেকে বলা যায় যে, মহাশ্বেতা দেবী ইতিহাস থেকে এমন চরিত্র নির্মাণ করেন, যা নিজেই ইতিহাস হয়ে যায়।

মহাশ্বেতা দেবী আদিবাসী উপন্যাসে লোকজনের মুখে মুখে ঘুরেফেরা ভাষার অনবদ্য ব্যবহার করেন, তা চমৎকারভাবে চলতি বাংলার সঙ্গে অঞ্চলিক শব্দের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে। তার উপন্যাসের ভাষায় কাব্যিক বাহুল্য পূর্ণ নয়। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যের সঙ্গে পরিমিতি বোধ লক্ষণীয়। উপন্যাসে মহাশ্বেতা দেবী ভূমিলগ্ন-আদিবাসীর জীবন আখ্যানকে এমনভাবে তুলে এনেছেন যা মূলত হাজার বছরের ভারতীয় প্রান্তিক আদিমজনের জীবন-সংস্কৃতিরই সাক্ষ্যবাহী। যা বাংলা উপন্যাসকেও নতুন আঙ্গিকে সমৃদ্ধ করেছে। গত কয়েক বছর ধরেই সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্তির লিস্টে ছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। গত ২৮ জুলাই তিনি মারা যান। তার মতো সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে থাকবেন।

সর্বশেষ খবর