শুক্রবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
বরষার বিরূপ দুঃস্বপ্নে জর্জরিত

প্রাণীদের কথা

ইকবাল আজিজ

প্রাণীদের কথা

বরষা নিয়ে বাঙালি কবি ও গায়কদের মধ্যে উৎসাহের শেষ নেই। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে কালো মেঘে ছেয়ে যায় প্রান্তর, কিন্তু তখন শ্রমজীবী মানুষের মনে গভীর বিষণ্নতা। আসলে কবি ও গীতিকাররা বরষার রিমঝিম বৃষ্টি নিয়ে যেমন ভাবপ্রবণ হয়ে ওঠেন; সচেতন, বস্তুবাদী বিশেষ করে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী কথাসাহিত্যিকরা তেমনটা হন না। তারা বরষার কদম কিংবা কামিনী ফুল নিয়ে গল্প লেখার বদলে বরং বরষার দিনে ঝুঁকিপূর্ণ জীবনের দুর্দশাকে অবলোকন করেন অনেক আন্তরিকভাবে। অবশ্য জনপ্রিয় কল্পনাবাদী কথাকারদের কথা আলাদা; তারা মেঘ বৃষ্টি বাদলের দিনে ঝিলের পানিতে পদ্ম-শাপলার রূপ ও নরনারীর প্রেমকাহিনীর শিহরণমূলক বর্ণনাতেই অভ্যস্ত বেশি। সুতরাং কথাসাহিত্যিকদের মধ্যেও বরষার প্রভাব সবার ক্ষেত্রে সমান নয়। বিত্তবান যারা বরষার সন্ধ্যায় আপন বাড়ির জলসাঘরে উচ্চাঙ্গ সংগীতের রাগরাগিনীর আসর বসান, তাদের কেউ কেউ বরষা-বাদলের দিনে রাস্তায় জমে থাকা কাদাপানির বিরূপ পরিবেশে বড় বেশি বিরক্তিবোধ করেন। তবে বরষার জল ছল ছল কল কল ধারা হয়তো ক্ষণিকের জন্য হলেও মানুষের মনকে উদাসীন করে তোলে। হয়তো এই মিশ্র অনুভূতি নিয়েই জীবনের অভিযাত্রা প্রবহমান। অবশ্য বরষা নিয়ে কবি আর গীতিকারদের মুগ্ধতা ও তার প্রবণতার শেষ নেই।

বরষার রিমিঝিম বৃষ্টি নিয়ে কোনো একটি জীবনের কাহিনী বা অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে আমার প্রায়ই একটি কাহিনীর কথা খুব মনে পড়ে। তার আগে বরষা ছিল আমার কাছে রবীন্দ্রনাথের ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আজ নাহিরে— ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।’ কীভাবে একথা ভুলি যে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ একজন মহাকবি ছাড়াও ছিলেন একজন বড় জমিদার; পূর্ববঙ্গের একটা বিশাল এলাকাজুড়ে ছিল তার জমিদারি।

তাই বরষার দিনে দু’মুঠো অন্নের সন্ধানে তার বাইরে বেরোনোর প্রয়োজন হয়নি। জমিদার বাড়িতে কিংবা নদীবক্ষে বজরার জানালার পাশে বসে তিনি ঝর ঝর বৃষ্টির অপরূপ সৌন্দর্য কিংবা জলেভরা ধানক্ষেত দেখেছেন। কিন্তু আমাদের মতো নুন আনতে পান্তা ফুরোনো মানুষদের জন্য সে সুযোগ বড়ই সীমিত। বরং বরষায় একটানা বৃষ্টিও রাস্তায় জমে থাকা কাদা আমাদের কাছে বড় বিরক্তিকর বলে মনে হয়। ১৯৮৪ সালের আষাঢ় মাসে তেমনই এক বরষার দিন। মেঘের গর্জন আর নিরন্তর জলবর্ষণ উপেক্ষা করে ছাতা মাথায় আমি হেঁটে চলেছি ‘হাতিরপুলে ভূতের গলি’ থেকে শান্তিনগরে আমার কর্মস্থলে। ঈদের মাত্র চার দিন আগে আমাদের কর্মপ্রতিষ্ঠানের মালিক বলেছেন, অফিসে গিয়ে বেতন নিয়ে আসতে। সেদিন আমার নিঃসঙ্গ জীবনে টাকার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু আমার চেয়েও বেশি প্রয়োজন ছিল আমার সহকর্মী ফিরোজার।

সংসারে তার দুই সন্তান ও পঙ্গু স্বামীর যাবতীয় দায়ভার তাকেই বহন করতে হয়। কদিন ধরেই ফিরোজার স্বামী এক ধরনের জটিল জ্বরে আক্রান্ত, তার ওপর ঈদ। তখনো পৃথিবীতে বামপন্থি জনকল্যাণের রাজনীতি শেষ হয়ে যায়নি; আর আমিও তখন ছিলাম এখনকার চেয়ে অনেক বেশি গরিব শোষিত মানুষের পক্ষে। তখনো স্বপ্ন ছিল, দুনিয়াজুড়ে একদিন গরিব শোষিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। পুঁজিবাদের সহযোগী ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীদের ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞ তখনো শুরু হয়নি দুনিয়ায়। তখন পল রোবসনের কণ্ঠে জন হেনরির শ্রমের গান ডেকে ফিরছিল পৃথিবীর অনেক মেহনতি মানুষকে। বরষার দিনে ছাতা মাথায় হাঁটার সময় এ অসহায় শ্রমজীবীদের কথাই আমি ভাবছিলাম। একটু হয়তো অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ করে ভিকারুন নিসা নূন স্কুলের সামনে বেইলি রোডে পিছল রাস্তায় আছড়ে পড়ে আমি যেন কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম। স্কুলের ছাত্রী দু’তিনজন কিশোরী মেয়ে আমার এ আছড়ে পড়ার দৃশ্য দেখে খিল খিল করে হাসল; নিমিষেই আমার জামা প্যান্ট কাদা পানিতে ভিজে গেল। তবু আমি এ বাধা উপেক্ষা করে উঠে দাঁড়ালাম। আমাকে যেতে হবে শান্তিনগর মোড়ের ওপাশে আমার মাসিক বেতন আদায়ের জন্য। আমার সহকর্মী ফিরোজা হয়তো এতক্ষণে এসে গেছে; কারণ তার প্রয়োজন আমার চেয়ে অনেক বেশি।

২.

শান্তিনগর মোড় পার হয়ে কিছুদূর এগোনোর পর ডানের গলিতে একটু হেঁটে একটি একতলা বাড়ির গায়ে টিনের সাইনবোর্ড তখন অনেকেরই চোখে পড়ত। সাদা জমিনের ওপর বড় বড় কালো হরফে লেখা ‘সুশিক্ষা সমঅধিকার।’ বাংলাদেশের অসংখ্য ছোট ছোট এনজিওর মধ্যে এও একটি। আর তখন এদেশকে শাসন করেছেন একজন স্বৈরাচারী সামরিক শাসক। আমি ক্লান্ত শরীরে অফিসের সামনে পৌঁছে দেখি অফিসে তালা লাগানো। ফিরোজা আমারই মতো ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে আছে অফিস ঘরের সামনে টিনের চালের নিচে খেলা বারান্দায়। ফিরোজা সকালে নাশতা করেছে কিনা জানি না। তবে তাকে ক্লান্ত ও দুর্বল বলে মনে হলো। সে হতাশার স্বরে বলল, ‘আজ হয়তো আসবে না আলতাফ ভাই। আজ বেতন না পেলে পল্টুর বাবার জন্য ওষুধ কেনা হবে না। বাজারও হবে না। ঈদ তো অনেক পরের কথা।’

ফিরোজাকে সাহস দেওয়ার জন্য বললাম, ‘আমারও একই অবস্থা।’ এমন সময় আবার বৃষ্টি শুরু হলো। অভুক্ত শরীরে এ বৃষ্টিকে বড়ই নির্মম ও নিষ্ঠুর বলে মনে হলো। অফিসের সামনের বারান্দায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি, কিছু দূরে মাঠের পাশে একটি কদম গাছে অনেক কদমফুল বৃষ্টি ও বাতাসের ঝাপটায় দুলছিল আমাদের জীবনের অনিশ্চিত দিনগুলোর মতো।

প্রায় আধাঘণ্টা পরে বৃষ্টি একটু কমে এলে ফিরোজা বলল, ‘চলুন আজিজ ভাই, শান্তিনগর মোড়ে গিয়ে আলতাফ ভাইকে ফোন করি।’ এখানে বলা নিষ্প্রয়োজন যে, তখন মোবাইল ফোনের আবির্ভাব ও ব্যবহার এভাবে পৃথিবীর জনজীবনকে এখনকার মতো এক সূত্রে বাঁধেনি। দুজনে শান্তিনগর মোড়ের কাছে ছোট বটগাছতলায় এলাম। সেখানে ‘সিদ্দিকিয়া রেস্টুরেন্ট’ থেকে পয়সা দিয়ে ফোন করলাম আমাদের দুজনের বস অর্থাৎ ‘সমঅধিকার সুশিক্ষা’র ম্যানেজিং ডিরেক্টর আলতাফ চৌধুরীকে। ওপারে অনেকক্ষণ ধরে ফোন বাজল কিন্তু কেউ ফোন ধরল না। ভাবলাম, আলতাফ ভাই হয়তো তার মোটরসাইকেলে চরে অফিসে আসার পথে রয়েছেন। আমরা রিমঝিম বৃষ্টির মধ্যদিয়ে হেঁটে শান্তিনগর ‘পীর সাহেবের গলিতে’ আমাদের অফিসে এলাম। যথারীতি বদ্ধ তালা, আমরা অফিসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। কদম ফুলের গাছের দিকে তাকিয়ে কৈশোরের বরষার প্রথম কদম ফুল দেখার স্মৃতি মনে করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ক্ষুধার্ত শরীরে আর কত বৃষ্টিভেজা কদম ফুল দেখব? এখন সবই বিস্বাদ, বিবর্ণ ও বেদনার্ত। এ অফিসে আমরা তিনজনই বসি। ফিরোজাকে অবশ্য প্রায়ই মগবাজারে রেললাইনের পাশে বস্তির স্কুল প্রকল্পে যেতে হয়। আলতাফ চৌধুরীর পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে গরিব শিশুদের মধ্যে ‘সুশিক্ষা ও সমানাধিকার’ বাস্তবায়নের কাজ করা হয়। বাস্তবায়নের দায়িত্বে আছেন শিক্ষা প্রকল্পের ম্যানেজার ফিরোজা ও তার অধীনস্থ শিক্ষকরা। আমি অবশ্য ফিরোজার সিনিয়র, এ প্রতিষ্ঠানের রিসার্চ অফিসার। কিন্তু গবেষণার যে কী কাজ করি, তার কিছুই জানি না।

আমরা এ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি টিনের চালের নিচে অফিসের খোলা বারান্দায়; চারদিকে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। ফিরোজা বলল, ‘ভেবেছিলাম, এতক্ষণে বেতন পেয়ে বাসায় বাজার নিয়ে যাব। পল্টু, রীনা আর ওদের বাপকে ভাত রেঁধে খাওয়াব। আজ বোধোহয় তা হলো না। বিকালে বাসায় ফিরে পরিচিত মুদির দোকান থেকে চাল, ডাল, আলু আর ডিম কিনতে হবে।’ আশির দশকের এ কাহিনী তখনকার নিম্ন আয়ের প্রায় সব শ্রমজীবীর জীবনে একইরকম। ফিরোজা আর আমি কেন সেই সমাজ কাঠামোর বাইরে থাকব? আমরা সরল, বোকা আবেগপ্রবণ। অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের সামাজিক কৌশলগুলো শিখতে পারিনি। তাই বরষার ঝরঝর বৃষ্টির ভিতর মনের মধ্যে গভীর আশা নিয়ে অপেক্ষায় থাকলাম আলতাফ চৌধুরীর। তিনি এলেন না। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে বৃষ্টি থামলে আবার এলাম শান্তিনগর মোড়ের কাছে ছোট গাছটির নিচে সিদ্দিকিয়া রেস্টুরেন্টে। তখন খিদেয় আমাদের পেট জ্বলছে। ফিরোজাকে দেখে মনে হলো, সে আমার চেয়েও বেশি ক্ষুধার্ত। ওকে বললাম, ‘চলুন আমরা ভাত খাই।’ এই ‘সিদ্দিকিয়া রেস্টুরেন্টে’ আমি নতুন নই। এখানকার ঝাল তরকারি, ঝরঝরে গরম ভাত আর ঘন ডাল অনেকেরই প্রিয়। ফিরোজা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালে আমরা দুজনেই একটা টেবিলে মুখোমুখি বসলাম। হোটেলের পরিচিত কর্মী আবদুল হেসে কাছে এসে দাঁড়াল। বলল, ‘স্যার খাবার আছে গরুর ভুনা গোশত, ভাত আর ডাল।’ ঘাড় নেড়ে ইশারায় সম্মতি জানালাম। কিছুক্ষণের মধ্যে টেবিলে খাবার এলো। বহুদিন পর মনে হলো, এই খাদ্য গ্রহণের আদিম প্রয়োজনেই আমাদের এই বেঁচে থাকা, এই সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি পরিশ্রম।

দুজনেই বুভুক্ষের মতো খেলাম এবং অতিরিক্ত আরও দুই প্লেট ভাত নিলাম। এই রেস্টুরেন্টে একটা সুবিধা আছে, তরকারি শেষ হয়ে গেলেও ঝোল চাইলে দু’এক টুকরো গোশত দেয়। পেট ভরে ভাত খেয়ে পরিতৃপ্ত ও শান্ত হলো দুটি শরীর। খাওয়ার পর সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে মনে হলো এখন আমি কত সুখী মানুষ। কিন্তু ফিরোজার চোখেমুখে এখনো উদ্বেগের চিহ্ন দেখতে পেলাম, সে হয়তো ভাবছে তার ক্ষুধার্ত স্বামী ও সন্তানদের কথা। এবার আমার পান খাওয়ার ইচ্ছা হলো। আমি আবদুলকে সুগন্ধি মিষ্টি জর্দা দিয়ে পান আনতে বললাম।

পান চিবিয়ে মনে হলো, আমাদের প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট বসীর আহমদকে ফোন করি। তিনি কাছেই চামেলিবাগে থাকেন। একটা জিনিস লক্ষ করেছি, গত দু’এক বছর ধরে মানবসেবার কাজে ব্যস্ত থেকে আমাদের বুদ্ধিও আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। বেঁচে থাক সুশিক্ষা ও সমানাধিকার কার্যক্রম। আমরা আর মফস্বলের সহজ সরল ক্যাবলাকান্ত নেই। অ্যাডভোকেট বসীর আহমদ বিত্তবান এবং ভদ্রলোক। তিনি ফোনে আমাদের পরিচয় জেনে কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। আমাদের সমস্যাটা তাকে খুলে বললাম। তিনি বললেন, ‘আলতাফ চৌধুরী যে ঢাকায় নেই, একটা কি তোমরা জানো না? সে তো গতকাল ব্যাংককে একটি সেমিনারে যোগ দিতে গেছে? পাঁচ দিন পরে ফিরবে। অর্থাৎ ঈদের একদিন পরে। এবার আমি বললাম, ‘ তাহলে আমরা ঈদ করব কীভাবে?’ বসীর সাহেব বললেন, ‘তোমরা এখনই আমার বাসায় চলে এসো।’ আমি আর ফিরোজা তার বাসায় গেলে তিনি আমাদের সঙ্গে যথেষ্ট ভালো ব্যবহার করলেন। চা খাওয়ালেন এবং দুজনের হাতে দুটি ৫০০ টাকার নোট দিলেন। বললেন, ‘চিন্তার কোনো কারণ নেই। তোমাদের বেতন থেকে কেটে নেওয়া হবে।’ এতক্ষণ পরে দেখলাম, ফিরোজার মুখে হাসি ফুটেছে। বসীর আহমদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যে যার বাসায় রওনা হলাম। নিজেকে মনে হলো পরিপূর্ণ চিন্তামুক্ত। বৃষ্টি থেমে আছে। বাসায় ফেরার পর আবার বৃষ্টি শুরু হলো। কিন্তু এবার বৃষ্টিকে মনে হলো ঈশ্বরের চোখ থেকে ঝরে পড়া আনন্দের অশ্রুর মতো।

১৯৮৪ সাল সেই কবে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু সেই প্রথম আমি ঝর ঝর বরষার একটি দিনকে অসংখ্য কল্পনাপ্রবণ কবির বদলে একজন কথাসাহিত্যিকের দৃষ্টিতে দেখতে সক্ষম হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল শান্তিনগরে বরষার কদম ফুলের চেয়ে ‘সিদ্দিকিয়া রেস্টুরেন্টের’ ভাত ও ভুনা গরুর গোশত অনেক বেশি কাঙ্ক্ষিত, সজীব, লোভনীয় ও পবিত্র।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর