শুক্রবার, ২০ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিরাট বড় চাচা

গল্প ♦ মোস্তফা মামুন

বিরাট বড় চাচা

আমাদের এক বড় চাচা আছেন। বিরাট সাইজ, বিরাট চাকরি এবং বিরাট ক্ষমতা। আমরা কোনো বিপদে পড়লেই বাবা এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে তার বাসায় হাজির হন। বড় চাচা মিষ্টি খেতে খেতে কাহিনীটা শোনেন। তারপর যে আমাদের ক্ষতি করছে তাকেই এমন ক্ষতিতে ফেলেন উল্টা বেচারারা আমাদের বাসায় এসে মাফ চায়। একজন তো মায়ের পা জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করেছিল।

যাই হোক এমন একজন বড় চাচা থাকায় আমাদের ভীষণ সুবিধা। কোনো বিপদ আর বিপদই নয়। উল্টা বরং আমরা নিজেরাই নানারকম ক্ষমতার চর্চা করি। এই যেমন আমাদের ফ্ল্যাট অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন হবে। সবসময় সভাপতি হন মকবুল চাচা। খুব ভালো মানুষ, দেখা হলেই সালাম দেন আর বলেন, ‘গুলিস্তান যান আর উত্তরা যান শেষ পর্যন্ত পথ কিন্তু একটাই।’

তিন তলার আশরাফ সাহেব নতুন এসেছিলেন। অবাক হয়ে বললেন, ‘গুলিস্তান আর উত্তরার পথ একটা কী করে হয়। দুটো তো দুইদিকে রাস্তা।’

মকবুল চাচা হাসলেন। হেসে মিষ্টি করে একটা আরবি আয়াত পড়তে পড়তে বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত পথ একটাই। আল্লার পথ। রসুলের দেখানো রাস্তা।’

তার কথা মতো আল্লার পথ আর রসুলের রাস্তা যে সবাই ধরেছে এমন নয়, তবে তার কাজ হয়। প্রতিবার নির্বাচনের আগেই তিনি পাস। কিন্তু এবার বাবা বললেন, ‘আমি দাঁড়াব।’

শুরুতে সবাই একটু অবাক। মকবুল চাচা আরবি বাদ দিয়ে সোজা ইংরেজিতে গিয়ে বললেন, ‘হাউ ডেয়ার!’

উত্তেজনা যখন তুঙ্গে তখন একদিন বড় চাচা এলেন। পুলিশের পোশাকে তাকে দেখাচ্ছিল অদ্ভুত কিন্তু দেখলাম সেদিকে কারও নজর নেই। সবার এমন অভিভূত ভাব যে, এমন সুন্দর মানুষ ওরা জীবনে দেখেনি। তা সেরকম ভাবার কিছু কারণ আছে। যদি সামনে-পিছনে পুলিশের গাড়ি পাহারা দেয়, হাতে অস্ত্র ধরা কেউ একজন গাড়ির দরজা খুলে দেয় তাহলে তাকে দেখে অভিভূত হতেই হয়।

মকবুল চাচা সবার আগে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘কী সৌভাগ্য আমাদের। কত গল্প শুনেছি আপনার। আমরা ধন্য হয়ে গেলাম।’

আমি বড় চাচার আসার কারণটা বুঝেছিলাম। আর ভেবেছিলাম চাচা মকবুল সাহেবকে ধমকে দিয়ে বলবেন, ‘আমার ছোট ভাই সভাপতি হতে চায়। আপনি বাড়াবাড়ি করবেন না।’

কিন্তু এর কিছুই না। মকবুল চাচার বরং খোঁজখবর নিলেন। তার ছেলেমেয়েরা কোন ক্লাসে পড়ে, বাবা-মার শরীর কেমন ইত্যাদি সব প্রশ্ন। মকবুল চাচা বিগলিত হয়ে উত্তর দিলেন। অতি উত্তেজনায় মেয়ের নাম ভুলও বলে ফেললেন একবার।

বড় চাচা বিদায় নেওয়ার সময় বললেন, ‘কোনো কাজ-টাজ হলে যোগাযোগ করবেন। আপনারা আমার ছোট ভাইয়ের বন্ধু, মানে তো আমারও ছোট ভাই। আমার ভাইটার দিকে একটু খেয়াল রাখবেন।’

মকবুল চাচা মাথা নিচু করে আরও বিগলিত হয়ে বললেন, ‘এটা তো আমাদের দায়িত্ব। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।’

আমি একটু হতাশ হয়ে বললাম, ‘বড় চাচা তো কিছু বললেন না। বাবার কাজটা তো হলো না বোধহয়।’

বড় ভাইয়া পাশ থেকে বলল, ‘একশ ভাগ হয়েছে। দেখবি মকবুল চাচা নিজেই এবার বাবার নাম প্রস্তাব করবে সভাপতি হিসেবে।’

‘সত্যি?’

“এই যে ‘খেয়াল রাখবেন’ বললেন এতেই কাজ হয়ে গেল। বড় মানুষদের কথাও ভেঙে বলতে হয় না।”

আমি ঠিক নিশ্চিত হতে পারলাম না। কিন্তু কাজ হলো ম্যাজিকের মতো। পরদিনই মকবুল চাচা ডেকে বললেন, ‘আমার বয়স হয়েছে এখন আর আগের মতো কাজ করার শক্তি পাই না। আর কাজ কী, কেয়ারটেকারকে ধমকাও, ময়লা ফেলার লোক এলো কিনা এগুলো নিয়ে ভাব। এসব ছোটলোকি কাজ আর আমি করতে পারব না। নতুন মানুষ দরকার, তরুণ কেউ।’

সেই তরুণ কেউটা অবশ্যই বাবা। যদিও বাবার বয়স ৫৫ এবং তিনি খুব সম্ভব মকবুল চাচার চেয়ে এক-আধ বছর বড়, তবু তার তারুণ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠল না। বাবা সভাপতি হয়ে গেলেন বিনা বাধায়।

বড় চাচাকে আবার কাজে লাগাতে হলো ভাইয়ার স্কুলে। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিনে ক্লাস নাইনের কয়েকজন ছাত্র গেম টিচারকে টিজ করেছে, এই হচ্ছে অভিযোগ। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাদের সবাইকে টিসি দিয়ে দেওয়ার। বাবা তদবির করতে গেলেন। গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হলো সেটা তিনি কাউকে বললেন না। শুধু ভাইয়াকে বললেন, ‘আফসোস তোর মতো ছেলেকে আমি জন্ম দিয়েছিলাম।’

উপায়! বড় চাচা আছেন না। এবার ব্যাপারটা একটু জটিল বলে মাসহ মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে যেতে হলো। বড় চাচা শুরুতে খুব বিরক্ত হলেন। বললেন, ‘বদমাশটাকে মেরে কাঠ বানিয়ে দে।’

বরফ গলাতে বিস্তর পরিশ্রম হলো। মা প্রয়োজনীয় সময়ে চমৎকার করে কাঁদতে পারেন। কেঁদে কেঁদে ‘আপনি যা বলেছেন সমীরের এরচেয়েও বড় শাস্তি হওয়া উচিত। ওকে কেটে পানিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু ভাইজান এবারের মতো আপনি উদ্ধার করে দেন। এই সময় স্কুল থেকে বের করে দিলে তো ওকে মেট্রিক পরীক্ষা দিতে হবে গ্রামে গিয়ে। ভালো কোথাও ভর্তি করা যাবে না।’

বড় চাচা কী যেন ভাবলেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, ‘এই স্কুলটা তো কথাবার্তা শুনে না। ফিন্যান্স মিনিস্টারের কথাও রাখেনি কিছুদিন আগে। আচ্ছা ঠিক আছে খাওয়া-দাওয়া কর। আমি দেখছি।’

দুইদিন পর চাচা তার গাড়িবহর নিয়ে গেলেন স্কুলে। যে বাবা দুইদিন আগে প্রিন্সিপালের কাছে অপমানিত হয়ে ফিরেছেন সেই বাবাকেও এদিন সাদর অভ্যর্থনা জানানো হলো।

আধ ঘণ্টা পরে প্রিন্সিপাল সাহেব চাচাকে বিদায় দেওয়ার সময় গাড়ি পর্যন্ত এসে বললেন, ‘আপনার আসার দরকার ছিল না। একটা ফোন করলেই হতো। আর ওই যে...আমার ভাতিজার মামলাটার কথা বললাম একটু দেখবেন।’

বড় চাচা বললেন, ‘আপনার কাজ হয়ে গেছে ধরেন। ওকে কালকে আমার অফিসে দেখা করতে বলবেন। রাইট অ্যাট টেন ও ক্লক।’

ভাইয়ার সঙ্গী অপরাধীরা বহিষ্কৃত হয়ে গেল। ভাইয়া সগৌরবে টিকে থাকল। অন্য অভিভাবকরা ঘোঁট পাকানোর চেষ্টা করেছিল। একটা অনলাইন পত্রিকায় নিউজও বেরিয়ে গেল, ‘ক্ষমতার দাপট।’

পরদিন একটা ছোট্ট কাজ করতে হলো। চাচার অফিস থেকে তার অধঃস্তন একজন অফিসার সেই অভিভাবকদের একজনকে ফোন করে বলল, ‘স্লামুআলাইকম। আমি র‌্যাব হেডকোয়ার্টার থেকে বলছি...।’ ব্যস। বিপ্লব-বিদ্রোহ সব শেষ।

এর মধ্যে একদিন বড় চাচার পিএস সকালে গাড়ি নিয়ে হাজির। জরুরি তলব। বাবা-মাকে যেতে হবে।

ব্যস্ততার কারণে বড় চাচা খুব বেশি আমাদের ডাকার সুযোগ পান না। বাবা তো অভিভূত হয়ে গেলেন। মা আরও বেশি। কী হতে পারে কারণ এই নিয়ে একটা ছোটখাটো মতবিনিময় সভার মতোও হলো। বাবার ধারণা, বড় চাচার প্রমোশন হচ্ছে। তিনি এখন পুলিশের দুই নম্বর ব্যক্তি, খুব সম্ভব এক নম্বর হতে যাচ্ছেন। সেই সুসংবাদটা জানাতেই...।

ভাইয়া বলল, ‘কী মজা হবে। দুই নম্বরেই যে ক্ষমতা ছিল এক নম্বর হলে তো আর কথাই নেই। পরীক্ষা না দিয়েই এখন থেকে পাস করব।’

বাবা বললেন, ‘পরীক্ষা দেওয়া কী রে! ঘরে বসে থাকবি। আর স্যাররা এসে সার্টিফিকেট দিয়ে যাবেন।’

ফেরার সময় এই খুশিটা অবশ্য থাকল না। বরং গাড়িতে বাবা আর মার ঝগড়া শুরু হলো। মা বললেন, ‘তুই এক কথায় এভাবে রাজি হয়ে গেলে কেন?’

বাবা বললেন, ‘কী করব? ভাইয়া একটা জিনিস চেয়েছে। আমি দেব না? তাছাড়া ঠিকই তো বলেছে, গ্রামের জমি দিয়ে আমরা করব কী? ভাইয়া যদি দুইজনের জায়গা নিয়ে একটা বড় বিল্ডিং বানায় তাহলে তো বাড়িটা সুন্দরই দেখাবে।’

‘রাখ তোমার সুন্দর দেখানো। আমাদের দুটো ছেলে, ওদের ভবিষ্যৎ আছে না! উনি ওনার অংশে ঘর বানাক। কিন্তু আমার অংশ আমি ছাড়ব না।’

মা যে এতটা কঠোর অবস্থান নেবেন বুঝতে পারিনি। তিনি তার দুই ভাইকে রাতেই ডেকে পাঠালেন। তারা চেঁচিয়ে উঠে বললেন, ‘খবরদার তুই ছাড়বি না। উনি যত বড় চাকরিই করুন, পৈতৃক সম্পত্তিতে দুইজনের সমান হক। সমান অধিকার।’

বাবা শুরুতে একটু আপত্তি করলেও মামাদের সঙ্গে কথা বলার পর নিজেও গ্রামের বাড়ির অংশ না ছাড়ার পক্ষে চলে গেলেন। মামারা বলে গেলেন, ‘উনি ক্ষমতাবান হতে পারেন কিন্তু দেশে কি আইন নেই? তুমি না দিতে চাইলে কেউ তোমার এক ইঞ্চি জায়গাও নিতে পারবে না।’

বাবা ক্ষীণ গলায় বললেন, ‘উনি তো বলেছেন, ন্যায্যমূল্যে কিনে নেবেন। টাকা দিয়ে দেবেন।’

‘এক টাকাও দেবে না। ঘোরাবে শুধু। তুমি বোধহয় ভয় পেয়ে গেছ একটু। ভয়ের কিছু নেই। মনে রেখ আমরাও ভেসে আসিনি।’

মামাদের উসকানিতেই বাবা বেশকিছু সাহসের কাজ করে ফেললেন। বড় চাচা গাড়ি পাঠিয়েছিলেন এই বিষয়ে কাগজপত্র ঠিক করার জন্য। বাবা বাসায় থেকেও বলে দিলেন তিনি নেই। বড় চাচা ফোন করলেন দুইবার। ধরলেন না।

বড় চাচা অবশ্য বসে থাকলেন না। গ্রাম থেকে খবর এলো, ইট-বালু সব চলে এসেছে। শুক্রবার দিন কাজ শুরু হয়ে যাবে।

মা মামাদের ফোন করলেন। মামারা বাবাকে। এসব ফোনাফুনি মিলে বিরাট একটা ঘটনা ঘটে গেল শুক্রবার।

বড় চাচা কাজ শুরু করে ঢাকায় ফেরার পথেই বাবার ঠিক করা স্থানীয় গ্রাম্য মাতব্বর এবং গুণ্ডা কাজে বাধা দিয়ে বলল, ‘আমরা খবর পেয়েছি জায়গার ভাগাভাগি নিয়ে ঝামেলা আছে। আপনারা কাজ বন্ধ রাখেন।’

তারপর কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে এক গুণ্ডা নাকি রাজমিস্ত্রিকে দুটো চড়ও মেরেছে।

এর মধ্যে আরেকটা ঘটনা ঘটল। পত্রিকায় বড় চাচার ছবি বের হলো। তার প্রমোশন হয়েছে। আমাদের বাসায় এই উপলক্ষে বিরাট হৈচৈ হওয়ার কথা ছিল। উল্টা এমন ভাব করতে থাকলাম, যেন আমরা এই মানুষটাকে চিনি না। পরিচিতদের কেউ কেউ ফোন করে বাবাকে অভিনন্দন জানাল। বাবা গম্ভীর গলায় ‘হ্যাঁ’ ‘হুঁ’তে তাদের সঙ্গে কথা সারলেন।

এ ছাড়া করবেন কী? আমরা যে এখন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। বাবার বিরুদ্ধে মামলা হয়ে গেছে। দুটো মামলা। ট্রেপপাস এবং অ্যাটেম্পট টু মার্ডার। ওয়ারেন্ট বেরিয়ে গেছে একদিনের মধ্যে। পুলিশ আমাদের বাসায় তল্লাশিও চালিয়েছে সেদিন রাতেই। তার আগেই পালাতে পেরেছি বলে রক্ষা।

এসব ক্ষেত্রে কী করতে হয় সেটাও দেখা গেল বাবা জানেন না। জানার সুযোগও ছিল না। এর আগে যত পুলিশের ঝামেলা হয়েছে সব তো বড় চাচার রুমে বসে বাবা মিটিয়েছেন।

বাবার এক মুরব্বি চাচা আছেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি বাবাকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘তুই এত বড় বেয়াদব। বড় ভাই একটা সামান্য জিনিস চেয়েছে...।’

আরেক ফুফু শুনে বললেন, ‘নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে নে। গিয়ে পায়ে পড়। পায়ে পড়লে ও তোকে মাফ করে দেবে। নইলে তোর রক্ষা নেই।’

পায়ে পড়তে এখনই বাবা রাজি হচ্ছেন না বলে আমরা আজ এখানে, কাল ওখানে কাটাই। আর ভাবি, বড় আত্মীয়স্বজন থাকাটাকে সবাই সুবিধাজনক মনে করে কিন্তু এরও যে এমন একটা উল্টা পিঠ আছে তা বোধ হয় অনেকেই জানে না।

এরা পক্ষে থাকলে কী দারুণ আর বিপক্ষে গেলে কী যন্ত্রণা!

ভাইয়া বলে, ‘সুবিধা-অসুবিধা সব নিজের কাছে। তাকে নিজের সুবিধায় যখন অন্যায়ভাবে কাজে লাগিয়েছ তখন অসুবিধায় একদিন পড়বেই। দুনিয়ার নিয়ম।’

ভাইয়া ফালতু কথাই বেশি বলে। তাই তর্ক জুড়ে দেই। কিন্তু আজ তর্ক করতে গিয়ে দেখলাম ঠিক সুবিধা করতে পারছি না। 

সর্বশেষ খবর